দেশ এখন যেন আগুনে পুড়ছে। একদিকে খরা, তাপপ্রবাহ, আরেক দিকে জিনিসপত্রের লাগামছাড়া দাম। শহর-নগর-গ্রামে উত্তাপ, বাজারেও উত্তাপ। এ এক অসহনীয় পরিস্থিতি।
বৈশাখে প্রকৃতি তপ্ত হয়। এটা আবহমানকাল ধরেই হচ্ছে। কিন্তু দিন দিন তা যেন মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। গত কয়েকদিন ধরে ঢাকা ও রাজশাহীর অধিবাসীরা রীতিমতো মরুভূমির মতো লু হাওয়ার অনুভূতি পাচ্ছেন। এতে করে খেটে খাওয়া মানুষ সীমাহীন কষ্টের মধ্য দিয়ে দিনাতিপাত করছেন।
এবার চৈত্রের শুরু থেকেই খরতাপে পুড়ছে দেশ। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত প্রখর তাপ নিয়ে আলো ছড়াচ্ছে সূর্য। কড়া রোদ আর ভ্যাপসা গরমে বিপর্যস্ত জনজীবন। তীব্র দাবদাহে প্রকৃতিও নিস্তেজ। হালকা বাতাস থাকলেও সেটিও গরম ছড়াচ্ছে। প্রাণিকুলও ছড়াচ্ছে তপ্ত নিশ্বাস।
রমজান মাসে এমন গরমে হাঁপিয়ে উঠেছে মানুষসহ পশু-পাখিরাও। বিশেষ করে রোজাদাররা বেশি কষ্টের মধ্যে পড়েছেন। ঘরে-বাইরে কোথাও স্বস্তি নেই। সবখানেই তপ্ত আবহাওয়া। একটু স্বস্তির খোঁজে খেটে খাওয়া দিনমজুর ও অটোরিকশা চালকরা গাছের নিচে আশ্রয় নিচ্ছেন। সেখানেও তেমন একটা স্বস্তি পাচ্ছেন না।
বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলে কিছুটা বৃষ্টি হলেও দেশের বিরাট অঞ্চলজুড়ে কার্যত এখন খরা পরিস্থিতি বিরাজ করছে। কৃষিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। এ বছর এখন পর্যন্ত রাজশাহীতে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৪২ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আট বছর আগে ২০১৪ সালের চৈত্রে রাজশাহীতে ৪২ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল।
তবে পারদ যন্ত্রের হিসেবে তাপমাত্রা যা-ই থাকুক, বাস্তবে তা অনুভূত হচ্ছে হচ্ছে অনেক বেশি। যেমন রাজধানী ঢাকায় কয়েক দিন ধরে তাপমাত্রা গড়ে ৩৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলেও মানুষের কাছে এর অনুভূতি ছিল ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর রাজশাহীর তাপমাত্রা গড়ে ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলেও স্থানীয় ব্যক্তিদের অনুভূতি ছিল ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মতো। মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার হিসাবে মরুভূমিতে দিনের গড় তাপমাত্রা সাধারণত ৩৬ থেকে ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকে। তবে রাতে তা প্রায় অর্ধেকে নেমে আসে।
ঢাকা, রাজশাহীসহ বিভিন্ন এলাকায় রাতের তাপমাত্রা ২৬ থেকে ২৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকছে। ফলে দিন ও রাত দুই সময়ে তাপমাত্রার খুব বেশি পার্থক্য থাকছে না। ফলে মানুষ গরমের অনুভূতি থেকেও রেহাই পাচ্ছে না। মাঝেমধ্যে আকাশে মেঘ আর দমকা বাতাস থাকছে। তাতে অল্প সময়ের জন্য গরম কমলেও আবারও তীব্র গরমের অনুভূতি ফিরে আসছে।
বাংলাদেশের আবহাওয়া বিভাগ তাপমাত্রা বেড়ে ৩৬ থেকে ৩৮ ডিগ্রি হলে সেটিকে মৃদু তাপপ্রবাহ, ৩৮-৪০ ডিগ্রি হলে মধ্যম মাত্রার তাপপ্রবাহ, ৪০-৪২ ডিগ্রি হলে তীব্র বা মারাত্মক এবং ৪২ ডিগ্রির বেশি হলে অতি তীব্র তাপপ্রবাহ হিসেবে বিবেচনা করে। সে হিসেবে বাংলাদেশে তাপপ্রবাহ বা দাবদাহ শুরু হয় ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে। তবে এটা আসলে পুরোটা নির্ভর করে মানবদেহের খাপ খাইয়ে নেয়ার সক্ষমতার ওপর। গত বছর এক পর্যালোচনায় আবহাওয়া অধিদপ্তর দেখেছে যে মধ্য মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ের মধ্য হিট বা তাপমাত্রা বাড়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এতে করে জনজীবন স্থবির হয়ে পড়ছে। বাড়ছে মানুষের কষ্ট।
এ বছর এখনও বৃষ্টির দেখা নেই। সাধারণত এ সময় কালবৈশাখী ঝড় হয়। এবার যেন সেই ঝড়ও উধাও। আমাদের দেশে কাশবৈশাখীর আগমন ফুটোফাটা মাটিকে ভিজিয়ে রাখার জন্য। সে না এলে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার যথেষ্ট আশঙ্কা থাকে। গত কয়েক দিন ধরেই আকাশটা সকালের দিকে মেঘলা করে আসছে।
অনেকেই ভাবছেন, আজ বিকেল বা সন্ধ্যার দিকে নিশ্চয়ই একটা কালবৈশাখী ঝড় উঠবে। কিন্তু কোথায় কী! বেলা বাড়তেই মেঘ ঠেলে সূর্য যখন মুখ বাড়াচ্ছে, তখন প্রাণ ওষ্ঠাগত। তাপমাত্রার পাশাপাশি মেঘের জন্য বাড়ছে আর্দ্রতা। তা উঠে উঠে যাচ্ছে ৯০ শতাংশের আশপাশে। আর তাতেই কালবৈশাখী মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছে। এমনই বলছেন আবহাওয়াবিদেরা।
তাদের মতে, মালভূমিতে তাপমাত্রা যত বাড়ে, ততই বাড়ে কালবৈশাখীর সম্ভাবনা। তার জন্য মূলত দুটি প্রাকৃতিক অবস্থার প্রয়োজন। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উঁচু সমতল ভূমিতে লাগামছাড়া তাপমাত্রা এবং বঙ্গোপসাগরের উচ্চচাপ বলয়। বাংলাদেশের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের ছত্তিশগড় ও ঝাড়খণ্ডের তাপমাত্রাও কালবৈশাখীকে প্রভাবিত করে। সেখানে তাপমাত্রা যত বাড়বে, ততই গরম হবে ভূপৃষ্ঠ। মাটি থেকে বিকিরিত তাপ বাতাসকে গরম করে দেয়। বাতাস যত গরম হয়, ততই তা উঠতে থাকে উপরের দিকে।
আবহাওয়ার এই অবস্থায় বঙ্গোপসাগরে তৈরি হয় উচ্চচাপ বলয়, যা জলীয়বাষ্পকে ঠেলে নিয়ে যায় বায়ুমণ্ডলের উপরের স্তরে। জলীয়বাষ্প সেই গরম বাতাসের সংস্পর্শে এলে উল্লম্ব মেঘপুঞ্জ তৈরি হয়। এক সময় তা জলীয় বাষ্প ধারণের ক্ষমতা হারিয়ে ভেঙে পড়ে। জন্ম নেয় কালবৈশাখীর।
গত কয়েক বছর ধরে স্বাভাবিক এই অবস্থার পরিবর্তন এসেছে। দেশের উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলের তাপমাত্রা মার্চ থেকেই চড়চড় করে বাড়ছে। কিন্তু বঙ্গোপসাগরের বায়ুপ্রবাহের ধরন বদলে যাওয়ায় জলীয়বাষ্প ঢুকে পড়ছে। যা ঢুকে যাচ্ছে পরিমণ্ডলের অনেকটা ভিতরে। তাতেই তাপমাত্রা বেশি উঠতে পারছে না। তৈরি হচ্ছে না বজ্রগর্ভ মেঘ।
আবহাওয়াবিদদের মতে, কালবৈশাখীর তেমন কোনো নিয়ম না মানলেও এরও একটা পরিসংখ্যান আছে। পরিসংখ্যান বলছে, সাধারণত মার্চে দুটি, এপ্রিলে চারটি আর মে মাসে কমপক্ষে তিনটি কালবৈশাখী হওয়ার কথা। কিন্তু মার্চের কালবৈশাখী প্রায় বিলুপ্তই হয়েছে। অন্যবার নিয়ম মানতে চৈত্র মাসে দুটি বা অন্তত একটি কালবৈশাখী হয়। এবার চৈত্রের কপাল পুড়েছে। এখন তাকিয়ে থাকতে হবে বৈশাখের দিকে। এদিকে আবহাওয়া ক্রমেই উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। প্রবল প্রতীক্ষা বাড়ছে একটু ঝোড়ো হাওয়া আর বৃষ্টির।
এই যে কালবৈশাখীর দেখা না পাওয়া, তীব্র গরমে হাঁসফাঁস করা-এসব কিছুই আসলে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঘটছে। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রভাবে আমাদের প্রকৃতি ক্রমেই তেতে উঠছে, তারই ফল ভোগ করছি আমরা। বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদপ্তরের হিসাব বলছে, গত ১শ বছরে দেশের গড় তাপমাত্রা প্রায় ১ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে।
গত বছর পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য গবেষক আতিক আহসান একটি গবেষণা প্রতিবেদনে দেশের ৯টি জেলার ১৯৮০ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত তাপমাত্রা পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে দেখান, দেশে সবচেয়ে বেশি দিন প্রচণ্ড গরম থাকে যশোরে। এ জেলায় বছরে গড়ে ৭৫ দিন আবহাওয়া বেশি উষ্ণ ছিল, যা রাজশাহী (৬৭ দিন) ও ঈশ্বরদীর (৫৮ দিন) চেয়ে বেশি। ওই গবেষণায় আরও উঠে আসে যে ঢাকায় বছরে ৩৬ দিন স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি গরম ছিল।
এই অস্বাভাবিক ও অসহনীয় গরমে মানুষ যে কেবল কষ্ট পাচ্ছে, তাই নয়। এর ফলে আরও নানা জটিলতা সৃষ্টি হচ্ছে। সবচেয়ে বেশি যা কমছে, তা হলো মানুষের কর্মক্ষমতা ও উৎপাদনশীলতা। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিজ্ঞানবিষয়ক সাময়িকী ‘প্রসিডিংস অব দ্য ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস’-এ গত বছর ৫০টি শহরের ওপর করা একটি সমীক্ষার ফলাফল তুলে ধরে বলা হয়, যেখানে বলা হয় যে, বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রভাবে ঢাকাবাসীর কর্মক্ষমতা বিশ্বে সবচেয়ে বেশি কমেছে। অতিরিক্ত তাপমাত্রার কারণে ঢাকায় প্রায় ৫ কোটি ৭৫ লাখ মানুষ (বিভিন্ন কাজে ঢাকার বাইরে থেকে আসাসহ) তাদের স্বাভাবিক কর্মক্ষমতার চেয়ে কম কাজ করতে পারছেন।
বিশ্বের গড় তাপমাত্রা এখনকার তুলনায় ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লে প্রতিবছর বাংলাদেশে ২ হাজার ১০০ কোটি শ্রমঘণ্টা নষ্ট হতে পারে। যদি গড় তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়ে তাহলে নষ্ট হতে পারে ৩ হাজার ১শ কোটি শ্রমঘণ্টা। তাপমাত্রা যত বাড়বে, শ্রমঘণ্টার ক্ষতি ততই বাড়বে।
পৃথিবীর বেশির ভাগ শহরে জলাভূমি ও গাছপালা রক্ষার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে এবং বেশি বেশি গাছ লাগানো হচ্ছে, যাতে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। বাংলাদেশে কিছুই হচ্ছে না। উল্টো মহানগরের অপরিকল্পিত নগরায়ণ জেলা ও উপজেলা শহর এবং গ্রামে ছড়িয়ে পড়ছে। গাছপালা কেটে সাবাড় করা হচ্ছে।
পরিবেশবিদরা গত দুই দশক ধরে বলছেন, বাংলাদেশকে পরিকল্পিতভাবে ভূমির ব্যবহার করতে হবে, যেখানে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য জলাভূমি, বনাঞ্চল টিকিয়ে রাখার ব্যবস্থা থাকবে। যথাসম্ভব গাড়ি, এসির ব্যবহার কমাতে হবে। জীবাশ্ম জ্বালানির পরিবর্তে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়াতে হবে।
প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য রক্ষা করতে হবে। নদী-খালবিল উদ্ধার ও খনন করতে হবে। পাহাড় কাটা বন্ধ করতে হবে। প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। কিন্তু কে শোনে কার কথা? সরকারের কর্তাব্যক্তিরা ব্যস্ত আছেন সব মেগাপ্রকল্প আর উন্নয়নের ধারাপাত শোনানো নিয়ে। দেশ তাপে পুড়ুক, দেশের মানুষ গোল্লায় যাক, তাতে কার কী?
লেখক: প্রাবন্ধিক, সাবেক ছাত্রনেতা