বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

সত্য-ধারণা, বিকৃত তথ্য ও অর্ধসত্য

  •    
  • ৬ এপ্রিল, ২০২২ ১৮:৪৮

বলা হচ্ছে নাজমুল তারেককে পুলিশ আওতায় নিয়েছে। কিন্তু তাকে এখনও গ্রেপ্তার করা হয়নি, বরখাস্ত করা হয়েছে মাত্র। কিন্তু নাজমুল তারেক যা করেছেন, তা গোটা বাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছে। তিনি যা করেছেন, তা বেআইনি এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আমি দাবি করছি, অবিলম্বে নামজুল তারেককে গ্রেপ্তার করে পুলিশের আওতায় নয়, আইনের আওতায় আনা হোক।

তেজগাঁও কলেজের শিক্ষক ড. লতা সমাদ্দারকে হেনস্তা করার ঘটনা একটি ব্যতিক্রম মাত্র নয়। গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ বদলে গেছে। সাম্প্রদায়িকতার বিষ এখন ছড়িয়ে গেছে সমাজের সর্বস্তরে। লতা সমাদ্দারের মতো আরও অনেক নারীকেই এখন প্রতিনিয়ত রাস্তাঘাটে হেনস্তার শিকার হতে হচ্ছে। লতা সমাদ্দার সাহসী বলে তিনি প্রতিবাদ করেছেন। আর লতা প্রতিবাদ করেছেন বলেই এই বিষয়টি নিয়ে আজ এত আলোচনা, এত হইচই। কিন্তু প্রতিদিন অসংখ্য অসহায় নারী রাস্তায়-যানবাহনে হেনস্তা-যৌন হয়রানির শিকার হয়ে লজ্জায় মাথা নিচু করে বাসায় ফিরে যায়।

প্রতিদিন ঢাকার রাস্তায় ধ্বংস হয়ে যায় কত নারীর আত্মবিশ্বাস, তার খবর হয়তো আমাদের কান পর্যন্ত পৌঁছায় না। রাস্তায় নারীদের শত্রু মূলত বিকৃত রুচির পুরুষরা। তবে পুরুষতান্ত্রিক নারীরাও নারীদের কম শত্রু নয়। কদিন আগে দেখলাম টি-শার্ট পরার জন্য বাচ্চা একটি মেয়েকে ধমকাচ্ছে মধ্যবয়সী এক নারী। সেই অভদ্র নারীর কবল থেকে সেই বাচ্চা মেয়েটিকে বাঁচাতে কেউ এগিয়ে আসেনি। একা সেই মেয়েটি প্রতিবাদ করার সাহস পায়নি। হয়তো প্রতিবাদ করার মতো পরিবেশ ছিল না সেখানে। বাসে মাথা নিচু করে বসে থাকতে হয় মেয়েটিকে।

ড. লতা সমাদ্দার জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রতিবাদ করেছেন। থানায় অভিযোগ দিয়েছেন বলেই আমরা জেনেছি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, গণমাধ্যম হয়ে সংসদেও আলোচনা হয়েছে বিষয়টি নিয়ে। প্রতিবাদ যেমন আমাদের আশাবাদী করে, তেমনি টিপ নিয়ে কিছু ভুল ন্যারেটিভ আমাদের শঙ্কিতও করে। প্রতিবাদের পাশাপাশি বাঙালি নারীর শাশ্বত সৌন্দর্যের অংশ টিপকে অনৈসলামিক আখ্যা দেয়ার একটি অপচেষ্টাও চলছে। ইসলামের ভুল ব্যাখ্যা, ভুল গল্প, বিকৃত ইতিহাস সামনে এনে টিপের স্বাভাবিক সৌন্দর্যে বাধা দেয়ার চেষ্টা হচ্ছে।

পুলিশ বাহিনী চমৎকার কর্তব্যের পরিচয় দিয়েছে; তারা দক্ষতার সঙ্গে অতি দ্রুত অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যকে চিহ্নিত করে আওতায় নিয়েছে। এরই মধ্যে তাকে বরখাস্ত করে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তবে অভিযুক্ত পুলিশ কনস্টেবল নাজমুল তারেক নিজে বাঁচতে মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে উল্টো লতা সমাদ্দারকে ফাঁসাতে চেয়েছিলেন।

ঘটনার বর্ণনায় লতা সমাদ্দার জানিয়েছিলেন, তিনি হেঁটে তার কর্মস্থল তেজগাঁও কলেজে যাচ্ছিলেন। পথে এক ব্যক্তি তাকে উদ্দেশ্য করে বলে, ‘টিপ পরছোস ক্যান?’ লতা সমাদ্দার ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখেন মোটর সাইকেলে পায়ের ওপরে পা তুলে বসে থাকা পুলিশের পোশাক পরা এক ব্যক্তিই তার উদ্দেশে এ কথা বলছেন। তিনি মোটর সাইকেলের সামনে গিয়ে প্রতিবাদ করলে সেই পুলিশ উল্টো তাকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করে এবং তার গায়ের ওপর দিয়ে মোটর সাইকেল চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে। লতা সমাদ্দার কোনো রকমে সরে গেলেও তার পায়ের ওপর দিয়ে মোটর সাইকেল চালিয়ে সটকে পড়ে সেই ব্যক্তি।

ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর পুলিশ দ্রুতই অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যকে শনাক্ত করে। কিন্তু নাজমুল তারেক পুলিশের কাছে এক মানবিক গল্প ফাঁদে। তিনি দাবি করেন, অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে নিয়ে তিনি পুলিশ হাসপাতালে যাচ্ছিলেন। যানজট থাকায় তিনি ফার্মগেটে উল্টোপথে মোটর সাইকেল চালিয়ে আসছিলেন। তখনই তার স্ত্রীর পায়ের সঙ্গে লতা সমাদ্দারের ধাক্কা লাগে। এ নিয়ে তর্কাতর্কিও হয়। কিন্তু তিনি লতা সমাদ্দারের টিপ নিয়ে কিছু বলেননি।

বরং তর্কাতর্কির কারণে দেরি হয়ে যাওয়ায় তিনি স্ত্রীকে আর ডাক্তারের কাছে নিতে পারেননি। বরং স্ত্রীকে একটি সিএনজিতে তুলে দিয়ে তিনি কর্মস্থলে চলে যান। পুলিশ নাজমুল তারেকের স্ত্রীকে ডেকে আনলে তিনিও স্বামীর মতো একই কথা বলেন। নাজমুল তারেকের এই মানবিক গল্প কিছুক্ষণের জন্য হলেও গোটা ঘটনার দৃশ্যপট পাল্টে দেয়। পুলিশকে ধন্যবাদ তারা নাজমুল তারেকের গল্পটি যাচাই ছাড়া বাজারে ছাড়েনি। তারপরও ফিসফাস করে গল্পটি ফাঁস হয়ে যায়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লতা সমাদ্দারকে মিথ্যুক বানানোর আয়োজনও প্রায় সম্পন্ন হয়ে যায়।

আর বাংলাদেশে ভিক্টিম ব্লেমিঙের চেয়ে মজাদার আর কিছু নেই। আর ভিক্টিম যদি নারী হন, তাহলে তো কথাই নেই। কিছুক্ষণের জন্য হলেও অন্তত পুলিশের ভেতরে নাজমুল তারেকের জন্য সহানুভূতি সৃষ্টি হয়। পুলিশকে বিশেষ ধন্যবাদ এত আবেগ-সহানুভূতির পরও তারা নাজমুল তারেকের গল্পটি বিশ্বাস করেনি। সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, নাজমুল তারেকের সঙ্গে মোটর সাইকেলে তার স্ত্রী ছিলেন না। তার মানে স্বামী-স্ত্রী দুজন মিলে একটি মিথ্যা গল্প বানিয়ে লতা সমাদ্দারকে ফাঁসাতে চেয়েছিলেন।

আমরা জানি, ধারণা কখনও কখনও সত্যের চেয়েও ভয়ংকর। নাজমুল তারেক তেমনই একটি ধারণা তৈরি করতে চেয়েছিলেন, যাতে মিশিয়ে দিয়েছিলেন মানবিকতার দারুণ উপাদান। কারণ আমরা জানি, একটা মহল নাজমুল তারেকের গল্পটি বিশ্বাস করার জন্য ওঁত পেতে আছে। সুযোগ পেলেই তারা লতা সমাদ্দারকে পিষে ফেলতে চাইবে। নাজমুল তারেক খুব কৌশলে পুরো ঘটনায় বিভ্রান্তি সৃষ্টি করার চেষ্টা করেছেন। এরই মধ্যে কেউ কেউ লতা সমাদ্দারকে মিথ্যাবাদী বানানোর চেষ্টা করেছেন। তবে যেই পেশাদারিত্বের সাথে গোটা বিষয় দেখছে, তা আমাদের আশ্বস্ত করেছে। পুলিশ তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। আশা করি তারা তদন্তে সত্যিটাই তুলে আনবে।

বলা হচ্ছে নাজমুল তারেককে পুলিশ আওতায় নিয়েছে। কিন্তু তাকে এখনও গ্রেপ্তার করা হয়নি, বরখাস্ত করা হয়েছে মাত্র। কিন্তু নাজমুল তারেক যা করেছেন, তা গোটা বাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছে। তিনি যা করেছেন, তা বেআইনি এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আমি দাবি করছি, অবিলম্বে নামজুল তারেককে গ্রেপ্তার করে পুলিশের আওতায় নয়, আইনের আওতায় আনা হোক।

পুলিশ বাহিনীতে নাজমুল তারেক একা নন। তার মতো অন্ধকার মানসিকতার আরও অনেকে এই বাহিনীতে ঢুকে পড়েছে। টিপকাণ্ডের প্রতিবাদকারীদের হেয় করে ফেসবুক স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন লিয়াকত আলী নামে সিলেটে কর্মরত এক পুলিশ সদস্য। তাকেও প্রত্যাহার করে রংপুরে বদলি করা হয়েছে। তবে এই বদলি বা বরখাস্ত করে এদের নিবৃত্ত করা যাবে না। পুলিশ বাহিনীর ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার স্বার্থেই নাজমুল তারেক-লিয়াকত আলীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। পুলিশেই যদি এত অন্ধকার থাকে, সাধারণ মানুষ যাবে কার কাছে?

লেখক: সাংবাদিক-কলাম লেখক

এ বিভাগের আরো খবর