পানির অপর নাম জীবন, সেই পানির জন্য আত্মহত্যা করতে দেখলাম আমরা। দ্বিমত পোষণ করার সুযোগ নেই যে, মানুষের জীবন তার কাছে সবচেয়ে প্রিয়। কিন্তু সেই জীবন কখন আর কীভাবে সে আত্মহনন করতে পারে? যখন সামনে আর কোনো পথ খোলা থাকে না, অপমান আর ক্ষোভে বিচার বিবেচনা হারিয়ে ফেলে তখন সে নিজেই জীবনের সমাপ্তি টেনে দেয়।
স্বাধীনতার মাস, মার্চ। ১৯৭১ সালের এই মাসের ২ তারিখে স্বাধীন দেশের পতাকা উড়িয়েছিল ছাত্ররা, ৩ মার্চ স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করা হয়েছিল, ৭ মার্চ তারিখে লাখ লাখ মানুষের সমাবেশে পাকিস্তানিদের হুঁশিয়ার করে বলা হয়েছিল, আমরা তোমাদেরকে ভাতে মারব, পানিতে মারব। আর ৫০ বছর পর ভাত খাওয়ার জন্য ধান চাষের জমিতে পানি দিতে না পেরে সেই মার্চ মাসে আত্মহত্যা করলেন দুই ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী নাগরিক। রাজশাহীর বাগমারায় রবি মারান্ডি (২৭) ও অভিনাথ মারান্ডি (৩৬) বিষপানে আত্মহত্যা করেছেন। দুজনেই কৃষক, আদিবাসী এবং সাঁওতাল জাতিগোষ্ঠীর।
এখন বোরো ধান পুষ্ট হওয়ার সময়। পানি না পেলে ধান চিটা হয়ে যাবে। তিন মাসের পরিশ্রম, টাকা পয়সা খরচ সব শেষ হয়ে যাবে পানি না দিতে পারলে। কিন্তু দিনের পর দিন এই দুই ভাই বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) কাছে গভীর নলকূপ থেকে জমিতে সেচের পানির জন্য ধরনা দিলেও পানি পাচ্ছিলেন না। তারা কর্তৃপক্ষকে বলেছিলেন, পানি না দিলে এমনিতেই তো না খেয়ে মরে যেতে হবে।
তার চেয়ে তারা আত্মহত্যা করবেন। বহু বঞ্চনা আর প্রতারণার পরও আদিবাসীরা তাদের সম্ভ্রমবোধটুকু এখনও বাঁচিয়ে রেখেছেন। তারা যা বলেন তা করার চেষ্টা করেন। কিন্তু বিএমডিএর কর্তাব্যক্তিরা হয়তো ভাবতে পারেননি এই দুজন সত্যিই আত্মহত্যা করবেন। দুই ভাই একসঙ্গে গভীর নলকূপের সামনে কীটনাশক পান করেন ২৩ মার্চ সন্ধ্যায়। রাতেই অভিনাথের মৃত্যু হয়। আর রবি মারা যান রাজশাহী মেডিক্যাল হাসপাতালে ২৫ মার্চ রাতে। এরা দুজন সম্পর্কে চাচাতো ভাই। তাদের পরিবারের দাবি, ১০–১২ দিন অপেক্ষার পরও ধানের জমিতে পানি নিতে না পারার ক্ষোভ থেকে তারা আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন।
অতীতের অনেক ঘটনার মতো এ ক্ষেত্রেও জমিতে পানি না পেয়ে তাদের বিষপানের ঘটনা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ) ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। বিএমডিএর অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আবদুর রশিদের ভাষ্য, তারা দুই কৃষকের বিষপানের কথা শুনেছেন। পানির অভাবে তাদের জমির ধান মারা যায়নি। সেই শোকে তারা বিষপান করেছেন— এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। এখন পানি দেয়ার ক্ষেত্রে অপারেটরের কোনো অনিয়ম থাকলে তার বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে। কী দায়িত্বহীন উদাসীনতা আর সেই পুরাতন কথা! কে নেবে ব্যবস্থা আর কে করবে কার বিচার?
বাংলাদেশকে বাঁচিয়ে রেখেছে যে কৃষি তার উন্নতি নিয়ে সরকারের পদক্ষেপের বিবরণ প্রতিনিয়তই শুনছে দেশের মানুষ। কিন্তু অন্যান্য দেশের সঙ্গে তুলনামূলক বিচারে তা কতটুকু? নেদারল্যান্ডস কৃষি খাতে বছরে মাথাপিছু ৩১৪ ডলার, ভারত ৩৪ ডলার ও মিয়ানমার ২৬ ডলার বিনিয়োগ করে। সেখানে বাংলাদেশে মাত্র ১৬ ডলার বিনিয়োগ করা হয়। যে কারণে বাংলাদেশে হেক্টর প্রতি ধানের উৎপাদন ৪ হাজার ৭৩৫ কেজি। আর চীনে তা ৭ হাজার কেজির বেশি।
অপরদিকে দেশে কৃষিজমি কমে যাওয়া এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ নানা সমস্যা বাড়ছে। তাই খাদ্যনিরাপত্তাকে টেকসই করতে হলে কৃষিতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। একরপ্রতি ধানসহ অন্যান্য পুষ্টিকর খাবারের উৎপাদন বাড়াতে হবে। আর এটা তো আমরা জানি দেশে বহু ধরনের খাদ্য উৎপাদন বাড়লেও এখনও গরিব মানুষ মূলত ভাত থেকে তাদের পুষ্টিচাহিদার বড় অংশ মেটায়। তাই ভাত কম খান বললেই চলবে না, ভাতের উৎপাদনের পাশাপাশি পুষ্টিকর ও বহুমুখী খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে হবে।
উৎপাদন বাড়ানোর উপায় কি আছে? দেশের ৭৮ লাখ হেক্টর আবাদি জমির মধ্যে ৫৫ লাখ হেক্টর জমিতে বোরো ধান চাষ করা যায়। এক হেক্টর মানে সাড়ে সাত বিঘা। বিঘায় গড়ে ২০ মণ ধান উৎপাদন ধরলে হেক্টরে ৫ টনের বেশি উৎপাদন হয়। তাহলে বোরো মৌসুমে ২ কোটি ৭৫ লাখ টন ধান উৎপাদন সম্ভব। আমন মৌসুমে দেড় কোটি টন আর আউস মৌসুমে ৫০ লাখ ধান উৎপাদন তো সহজেই করা সম্ভব। তাহলে ৪ কোটি ৭৫ লাখ টন ধান উৎপাদন করতে খুব বেশি সমস্যা হওয়ার কথা নয়। ধান থেকে ৬৬ শতাংশ চাল উৎপাদন হয়। সে হিসেবে ৩ কোটি ১০ লাখ টন চাল তো উৎপাদিত হতেই পারে।
আমরা ভাত বেশি খাই বলে কৃষিমন্ত্রী যতই কটাক্ষ করুন না কেন তার হিসেবেই তো দিনে গড়ে ৪০০ গ্রাম চাল খাই আমরা। ছোট শিশু থেকে মৃত্যুপথযাত্রী বৃদ্ধ ১৭ কোটি মানুষের সবাইকে এই হিসেবে ধরলে বছরে চাল লাগার কথা ২ কোটি ৪৮ লাখ টন। প্রশ্ন উঠছে, তাহলে খাদ্যঘাটতি কেন, বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবহার করে বছরে ৬০ লাখ টন খাদ্যশস্য আমদানি করতে হয় কেন, ধান ওঠার মৌসুমেই চাল আমদানিতে এত ব্যস্ত হতে হয় কেন, সারা বছর চালের বাজার এত চড়া কেন?
কিছুদিন আগেই ডিজেলের দাম বাড়ানোতে সরকারের লাভ হলেও কৃষকের খরচ গেছে বেড়ে। উত্তরবঙ্গের কৃষকদের কেউ কেউ বলেছেন, বোরো মৌসুমে এক হেক্টর জমিতে ১০ থেকে ১৫ বার সেচ দিতে হয়। এতে প্রয়োজন হয় ৪৫-৫০ লিটার ডিজেল। এই হিসাবে প্রতি হেক্টরে বোরো চাষে ডিজেলের বাড়তি দামে কৃষকের অতিরিক্ত খরচ হবে ৭শ’ টাকার বেশি। তাদের মতে তেলের দাম বাড়ায় ধানের চাষ করাই দুষ্কর হয়ে গেছে। হালচাষের খরচ বেড়ে গেছে। শ্যালো মেশিনে সেচের খরচ বেড়েছে। খরচ বেড়েছে বলে কৃষক কি তাহলে ধান চাষ কমিয়ে দেবেন? না । কারণ ধান আবাদ না করে তার কোনো উপায় নেই।
ডিজেলসহ সব উপকরণের দাম বাড়ায় ১ একর জমিতে বোরো আবাদ করতে গত বছরের চেয়ে অতিরিক্ত ২-৩ হাজার টাকা বেশি খরচ হবে। তেলের দাম বাড়ায় একরপ্রতি সেচখরচ ৪০০ টাকা, ট্রাক্টর দিয়ে চাষে ৩শ’ টাকা ও মাড়াইয়ে ৩শ’ টাকার খরচ বেশি পড়েছে। সারসহ অন্য উপকরণের দামও চড়া। তাই প্রতিএকরে অতিরিক্ত খরচসহ মোট খরচ পড়ে ৪২ থেকে ৪৩ হাজার টাকা। অথচ প্রতি মণ ধানের দাম ৮শ’ টাকা ধরে একরে ৫০ মণ ফলন হলেও ৪০ হাজার টাকার বেশি উঠবে না। তাহলে চাষ করে কী লাভ? পেটের দায়ে এবং উপায় নেই বলে কৃষক যদি চাষাবাদ করে তাকে কি স্থায়ী উন্নয়নের কৃষি অর্থনীতি বলা যাবে?
কৃষিতে প্রচুর ভর্তুকি দেয়া হচ্ছে বলে যে বাহবা নিচ্ছে সরকার তার সুফল সাধারণ কৃষক কতটুকু পান? অভিনাথ মারান্ডির জমির পরিমাণ দেড় বিঘা। ফলন হলে সর্বচ্চ ৩০/৩৫ মণ ধান পেতেন। বর্গাদারকে দিয়ে, চাষের খরচ মিটিয়ে অভিনাথ নিজে আর কত পেতেন? ৫/৬ মণ ধান। দাম কত হতে পারে? ৬ হাজার টাকা। একজন ধনী ব্যক্তির একবেলার হোটেলের খাবার খরচের চেয়েও কম।
অথচ এর জন্য জীবন দিল অভিনাথ এবং রবি মারান্ডি। ড্রয়িং রুমের আড্ডায় অনেকেই হয়তো বলবেন কী বোকা এই সাঁওতালরা। কিন্তু বুকের ভিতর কতটা অপমান, অসহায়ত্ব আর ক্ষুব্ধতা জমলে কীটনাশকে জীবন বিসর্জন দিতে পারল এই দুই ভাই, তা বোঝার মন কি এই রাষ্ট্র আর ক্ষমতাসীনদের আছে? তেভাগার জন্য জীবন দিয়েছিল সাঁওতালসহ আদিবাসীরা। তা ছিল সংগ্রাম আর মর্যাদার মৃত্যু। তখন কণ্ঠে ছিল গান, আর দেব না, আর দেব না রক্তে ধান। আজ স্বাধীনতার ৫০ বছর পর ধান চাষ করতে পানির জন্য জীবন দিল যে আদিবাসী তারা কি দেখিয়ে দিল না ৫০ বছরের বৈষম্যের চিত্র?
লেখক: রাজনীতিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক