প্রীতি গাড়ির পাশে একটি রিকশায় বসে ছিলেন। গুলিবাজদের উদ্দেশ্য ছিল জাহিদুল ইসলাম টিপুকে খুন করা। জাহিদ খুন হয়েছেন, তবে এক খুন করতে গিয়ে আরেকজন মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
গণমাধ্যমে জাহিদকে নিয়েই সব কথা হচ্ছে। তিনি রাজনীতি করেন, তাই গুরুত্বপূর্ণ। তার পরিবারের ক্রন্দনরত ছবি ছাপা হয়েছে। প্রীতির মৃত্যুকে খুন বলা যাবে কি না আমি ঠিক জানি না; এবং এই মুহূর্তে প্রীতির কথা ভেবে আমার হায়দার হোসেনের গানের পঙক্তি মনে পড়ছে– ‘আমি চিৎকার করে কাঁদিতে চাহিয়া করিতে পারিনি চিৎকার; বুকের ব্যথা বুকে চাপায়ে নিজেকে দিয়েছি ধিক্কার।’
আমার আশেপাশে কেউ প্রীতিকে নিয়ে চিৎকার করছেন না। তবে অনুমান করতে ইচ্ছে করে যে অনেকেই আমার মতো নিজেকে ধিক্কার দিচ্ছেন। ধিক্কার দিচ্ছেন যে, নিজেরা এমন পরিস্থিতি থামাতে বা ইতি টানতে কিছুই করতে পারছেন না। নিজেকে ধিক্কার দেয়ার একটি ইতিবাচক দিক আছে। নিজেকে ধিক্কার দেয়ার অর্থই হচ্ছে নিজের মাঝে এখনও কিছু বোধ কাজ করে। আমাদের অনেকেরই করছে। যাদের করছে, তাদের ধন্যবাদ জানাই।
মৃত্যু দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গেলে এমন হয়। কিছুই আর গায়ে লাগে না। যেমন মশার কামড়, ক্ষুধা ইত্যাদি। মনে আছে প্রায় ষোল-সতেরো বছর আগে আমাদের একজন মন্ত্রী এক শিশুর মৃত্যু নিয়ে বলেছিলেন– ‘কী আর করবেন? আল্লার মাল আল্লায় নিয়ে গেছে।’
ওই মন্ত্রীর কথা নিয়ে আমরা হাসাহাসি করেছি, কিন্তু চিন্তা করে দেখলে বোঝা যাবে যে তিনি অতি সত্য কথা বলেছিলেন। তার বলার মধ্যে এক ধরনের চরম অসহায়ত্বও ছিল, যা আমরা বুঝতে চাইনি। তিনি মন্ত্রী হতে পারেন, কিন্তু এমন কোল্যাটেরাল ড্যামেজ বা [দু]র্ঘটনাজনিত ক্ষতি কমানোর ক্ষেত্রে তিনি অসহায়।
মন্ত্রী সাহেব যে কতটা সত্য বলেছেন, তা বোঝা যায় প্রীতির মা-বাবার কথায়। শুক্রবার সন্ধ্যায় প্রীতির মা হোসনে আরা বলেছেন, ‘বিচার চাই না। শুধু মেয়ের লাশ পৌঁছে দিলেই হবে।’ আর প্রীতির বাবা মো. জামাল উদ্দিন বলছেন, ‘কার কাছে শাস্তি চাইব? কার কাছে বিচার চাইব?’
আমরা যদি মনে করি যে এই কথাগুলো তাৎপর্যপূর্ণ, তাহলে ধরে নেয়া যেতে পারে আমরা কিছুটা বুঝি। হোসনে আরা এবং জামাল উদ্দিনের আর এখন কোনো চাওয়া নেই।
কেন থাকবে না, কোনো না কোনো চাওয়া তো অবশ্যই আছে।
গণতন্ত্রপূর্ণ রাষ্ট্রে আমি, আমরা, হোসনে আরা এবং জামাল উদ্দিনের মতো কোটি মানুষের এক চমৎকার পরিস্থিতিতে বসবাস করে সময় কাটানোর কথা। রাষ্ট্র বলবে, তুমি আপিসে যাও; আমি যাব। রাষ্ট্র বলবে, তুমি কাজ কর; আমি করব। রাষ্ট্র বলবে, তোমার বেতন ১০০০ টাকা; আমি ১০০০ টাকাই নেব। রাষ্ট্র বলবে, তোমার সন্তানকে ইশকুলে পাঠাও; আমি পাঠাব। রাষ্ট্র বলবে, তোমার সন্তান শান্তিতে থাকবে; আমি বিশ্বাস করব। রাষ্ট্র বলবে, তোমাকে আগলে রাখব; আমি বিশ্বাস করব।
আমরা বিশ্বাসের রাষ্ট্র চাই। এটাই আমাদের চাওয়া।
হোসনে আরা এবং জামাল উদ্দিনের কথা শুনে বোঝা যায়, তারা আর কিছু বিশ্বাস করেন না। তারা ঈশ্বরের কাছে নিজেদের সমর্পণ করেছেন, রাষ্ট্রের কাছে নয়।
কিন্তু রাষ্ট্র চায় চমৎকার জনগোষ্ঠী [চমৎকার ভেড়ার পাল বলা যায়] রাষ্ট্রের কাছে সমর্পিত হোক। গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষা সেটাই। আমরা ভোটের মাধ্যমে সম্মতি দেব এবং তারপর চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে বসে প্রসেনিয়াম-পর্ব সারব খৈ চিবুতে চিবুতে।
আমরা বর্তমানে কতটা চমৎকৃত সেই হিসাব মনে হয় আমাদের রাষ্ট্র করছে না। আমাদের এক চমৎকার ঘোরের মধ্যে রেখে সব কার্যক্রম চালানোর কথা রাষ্ট্রের ভাবা উচিত।
রাষ্ট্রের কাছে সমর্পিত জনগোষ্ঠীর জন্যে রাষ্ট্রের কিছু দায়িত্ব নিতে হয়। অনেক দায়িত্বের মধ্যে একটি হচ্ছে, বিনা কারণে যেন নাগরিকদের মৃত্যু না হয়, তা নিশ্চিত করা। তাদের বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষা যেন পূর্ণ হয়। তাদের শারীরিক নিরাপত্তা যেন থাকে।
সেদিন শীতলক্ষ্যার বুকে একটি প্রকাণ্ড জাহাজ এসে ছোট্ট এক লঞ্চকে চাপা দিয়ে ডুবিয়ে দিল এবং তার ফলে কিছু মানুষের বিনা কারণে মৃত্যু হলো। এমন মৃত্যুর মুখে এ দেশের নাগরিকরা পড়ছেন প্রতিদিনই। বাড়ির বাইরে বেরিয়ে নিজকে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করা এখন আমাদের অন্যতম কাজ। কিন্তু নিজেকে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করতে গেলে অন্যের সাহায্য প্রয়োজন। রাস্তায় গাড়িচালকের সাহায্য প্রয়োজন; হাসপাতালে ডাক্তার-নার্সের সাহায্য প্রয়োজন; আইন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাহায্য প্রয়োজন; খাবার বিক্রেতার সাহায্য প্রয়োজন; এবং নেতাদের সদিচ্ছা প্রয়োজন।
এমন আরও অনেক পেশাজীবী আছেন, যাদের নিজের পেশার প্রতি এবং মানুষের প্রতি আন্তরিকতা কমে যাওয়ায় আমাদের বিনা কারণে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে চলেছে। এখন কিছু মানুষের অযাচিত মৃত্যু হলে আমাদের মনে আর কষ্টের উদ্রেক হয় না। কোনো এক সময় আমরা অচেনা কোনো এক নাগরিকের মৃত্যুতে কষ্ট পেতাম; তার জন্যে প্রার্থনা করতাম। এখন মৃত্যু এতই সহজলভ্য হয়েছে যে, মৃত্যু হলেইবা কী, না হলেইবা কী।
অন্য মানুষের মৃত্যু নিয়ে আমাদের হৃদয় আর সিক্ত হয় না। এখন আমাদের সহ্য ক্ষমতা এখন অনেক বেশি। আমরা মেনে নিয়েছি যে, এমন করেই আমাদের দিন চলবে। নিজেদের মৃত্যুও যে বিনা কারণে হতে পারে, তাও মেনে নিয়েছি।
মেনে নিয়ে দৈবশক্তির হাতে নিজেকে সমর্পণ করলে নিজেকে ধিক্কার দেয়ার দায়িত্বটুকু থেকে বেঁচে যাই; পরিবর্তনের আশায় দিনানিপাত আর করতে হয় না। খাওয়া-দাওয়া, ইশকুল-কলেজ-আপিস, টেলিভিশন-সিনেমা দেখা এবং ঘুম। ব্যস, আমাদের জীবন যাপিত হয়েছে। আমরা সুখী; বৈশ্বিক সুখী তালিকায় আমাদের নাম দেখে আরও খুশি।
এমন নির্বাক জীবনযাত্রা খুব বেশিদিন টেকসই না-ও হতে পারে। এমন উদাসীন প্রশান্তির জীবন-যাপন মানবের পক্ষে বেশিদিন মেনে নেয়া সম্ভব না-ও হতে পারে। এক সময় না এক সময় সে নিজের অসাড়তার কারণেই নিজেকে ধিক্কার দেবে। কিছু করতে না পারার কারণে নিজেকে অকর্মণ্য মনে হবে।
তখনই সে জেগে উঠবে; নিজেকে ধিক্কার দেয়া শেষ করে বেঁচে থাকার অর্থ খুঁজে পেতে চাইবে। সেই সময় আসার আশায় রইলাম।
লেখক: গল্পকার ও যোগাযোগ পেশায় নিয়োজিত।