উড়ে এসে জুড়ে বসে কেউ একটা দেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে পারে না। মেজর জিয়া সেদিন বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা ‘পাঠ করেছিলেন’। এ জন্য তাকে কোনোভাবে খাটো করা যায় না। কারণ পরিস্থিতির কারণে তাকে দিয়ে তখন স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করানো হয়েছিল। নিজের জীবদ্দশায় তিনি নিজেকে কখনোই স্বাধীনতার ঘোষক দাবি করেননি। সে সময় তার এই ঘোষণা পাঠ চট্টগ্রামে মুক্তিযুদ্ধের প্রারম্ভে টানটান উত্তেজনার মধ্যে মানুষকে কিছুটা হলেও স্বস্তি দিয়েছিল, কিন্তু তার মৃত্যুর পর এ নিয়ে একটা অহেতুক বিতর্কের সৃষ্টি করা হয়। সেদিন যারা এ কাজটা মেজর জিয়াকে দিয়ে করিয়েছিলেন, তারাও তাদের ভুলটা পরে বুঝতে পেরেছিলেন।
আকস্মিক যেমন কোনো দেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়া যায় না, তেমনি যে কেউ স্বাধীনতার ঘোষণা দিতেও পারে না। এটাই স্বতঃসিদ্ধ কথা। একটা দেশের স্বাধীনতার ডাক বা ঘোষণা দেয়ার পূর্বে তার পেছনে যথেষ্ট যুক্তিসংগত প্রেক্ষাপট বা ভূমিকা থাকতে হয় এবং এর জন্য যথেষ্ট প্রস্তুতিও থাকতে হয়। সেটা আলোচনায় না আসার অর্থই হলো সত্যকে আড়াল করা এবং ইতিহাসকে বিকৃত করার অপপ্রয়াস।
১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান যেদিন স্বাধীন হয়, সেদিন থেকেই পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ধরেই নিয়েছিল যে, পূর্ব পাকিস্তানকে তারা তাদের একটা উপনিবেশ হিসেবে ব্যবহার করবে এবং বাঙালিদের শাসন ও শোষণের মাধ্যমে পশ্চিম পাকিস্তানকে গড়ে তুলবে। পরবর্তী সময়ে আমরা তেমনটাই দেখতে পাই। এমনকি তারা আমাদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক ভাবতেও দ্বিধাবোধ করেনি। পাকিস্তানের প্রথম ছাপানো মুদ্রা ও ডাকটিকিটে উর্দু এবং ইংরেজিকে স্থান দেয়া হলেও বাংলাকে স্থান দেয়া হয়নি।
তার পরের ইতিহাস আমাদের সবারই কম-বেশি জানা। আটচল্লিশ থেকে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, চুয়ান্নর যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা ষড়যন্ত্র করে ভেঙে দেয়া, আটান্নর সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন, ছেষট্টির ছয় দফা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের জাতীয় নির্বাচন এবং সব শেষে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ—সব ক্ষেত্রেই বঙ্গবন্ধুর বলিষ্ঠ ও কারিশম্যাটিক নেতৃত্ব সমগ্র বিশ্বের মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। তাই তো তাকে চে গেভারা, ফিদেল কাস্ত্রো, হুগো চাভেজ, নেলসন ম্যান্ডেলা, আব্রাহাম লিংকন, মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক পাশার সঙ্গে তুলনা করা হয়।
একবার কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল কাস্ত্রের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর দেখা হয়। সে সময় কাস্ত্রো বলেন, ‘আমি হিমালয় দেখিনি, তবে শেখ মুজিবকে দেখেছি।
‘ব্যক্তিত্ব ও সাহসে এই মানুষটি হিমালয়ের সমান। এভাবে হিমালয় দেখার অভিজ্ঞতাই লাভ করলাম।’
অধিকার, স্বাধিকার এবং সর্বোপরি স্বাধীনতার জন্য নেতার থাকতে হবে সে দেশের মানুষের চিন্তা, চেতনা ও ভাবনাকে একই সুতোয় গেঁথে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করার গুণ। স্বাধীনতা কোনো সুনির্দিষ্ট মিনিট, ঘণ্টা বা দিনের সময় ধরে আসে না। এটা একটা ইতিহাস। এর জন্য বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিতে হয়। দানবদের হাতে তুলে দিতে হয় অনেক অমূল্য জীবন।
নেতাকে অত্যাচারীদের অত্যাচার, নির্যাতন, অনাচার সহ্য করতে হয়। সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য বারবার জেল-জুলুম খাটতে হয়। সর্বজন নন্দিত নেতা হতে হয়; জনতার মনের কথা পড়ার মতো সক্ষমতা থাকতে হয়। জনগণের আদালতে বারবার দেশপ্রেমের প্রমাণ দিতে হয়।
এ ধরনের সব গুণে গুণান্বিত একজন সর্বজনস্বীকৃত মহান নেতারই শুধু এখতিয়ার রয়েছে এ ধরনের স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার। এসব কিছুরই মুখোমুখি হতে হয়েছিল বঙ্গবন্ধুকে। এগুলো তার সংগ্রামী জীবনের খণ্ড খণ্ড কাহিনী। অথচ এমন এক মহানায়কের বিপরীতে একজন স্বাধীনতার ঘোষণা-পাঠককে ‘ঘোষক’ হিসেবে দাঁড় করানোর অপচেষ্টা শুরু করা হয়।
একজন ধীশক্তি ও দূরদর্শী নেতার কণ্ঠে ৭ মার্চের ভাষণই স্বাধীনতার প্রকৃত ডাক বা স্বাধীনতার ঘোষণা। সেদিন তিনি সব কূল রক্ষা করে যেভাবে ভাষণটি দিয়েছিলেন, তা ছিল বিশ্বের বিস্ময়। তার সেই ভাষণ আজ বিশ্ববাসীর কাছে অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি ঐতিহাসিক দলিল।
বিপরীতে দুই দিন আগেও যার ওপর পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক জান্তার জন্য পাকিস্তান থেকে সোয়াত জাহাজে করে আনা অস্ত্র-শস্ত্র খালাসের দায়িত্ব অর্পিত ছিল, তিনি কীভাবে হঠাৎ করে স্বাধীতার ঘোষক হয়ে ওঠেন? স্বাধীনতার নেপথ্যে তার কী এমন ভূমিকা ছিল যে, রাতারাতি তিনি স্বাধীনতার ঘোষক হয়ে উঠলেন? তাহলে তাকে আপনি কী বলবেন? তাকে বড়জোর আপনি বাংলাদেশের মহানায়কের পক্ষে একজন স্বাধীনতার ঘোষণা-পাঠক বলতে পারেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রারম্ভে এটাও কিন্তু কম কথা নয়।
সে ক্ষেত্রেও বড় সমস্যা আছে। তৎকালীন চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ হান্নানকেই স্বাধীনতার প্রথম ঘোষণা-পাঠক বলতে হয়। কারণ তিনি সাবেক মেজর জিয়ার একদিন আগে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেছিলেন এবং বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের সপক্ষে সহায়তা চেয়েছিলেন।
২৫শে মার্চের গভীর রাতে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ নামক অভিযানের মাধ্যমে পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞ শুরুর আগে আগে বঙ্গবন্ধু তার ৩২ নম্বর ধানমন্ডির বাসায় আওয়ামী লীগ নেতা তাজউদ্দীন আহমদ, ব্যারিস্টার কামাল হোসেন এবং ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলামকে বলেন, ‘যে মুহূর্তে পাকিস্তানি বাহিনী আমাদের লোকের ওপর আক্রমণ করবে, সেই মুহূর্ত থেকে আমরা স্বাধীন। এ কথাটা আমাদের নেতা ও সংশ্লিষ্টদের জানিয়ে দিন।’
বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে তার বাসভবন ত্যাগের আগেই ওই নেতারা বিষয়টি বেশ কিছু রাজনৈতিক নেতা ও সংবাদ সংস্থাকে জানিয়ে দেন। পরবর্তী সময়ে ড. কামাল হোসেন বিবিসি বাংলা বিভাগের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে এগুলো বলেন।
২৬ মার্চের (শুক্রবার) প্রথম প্রহরে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে আটকের আগেই বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশকে ‘স্বাধীন’ ঘোষণা করে দেশবাসীর উদ্দেশে একটি তারবার্তা পাঠান। ইপিআরের ওয়ারলেস বার্তায় প্রচার করা হয় তার স্বাধীনতার ঘোষণা, যার কপি তাৎক্ষণিকভাবে চট্টগ্রামেও পাঠানো হয়।
এ বিষয়ে পাকিস্তানের তৎকালীন পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক বাহিনীর প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজির জনসংযোগ কর্মকর্তা মেজর সিদ্দিক সালিক তার ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ বইয়ে লিখেন, ‘যখন প্রথম গুলিটি ছোড়া হলো, ঠিক সেই মুহূর্তে পাকিস্তান রেডিওর সরকারি তরঙ্গের কাছাকাছি একটি তরঙ্গ থেকে ক্ষীণস্বরে শেখ মুজিবুর রহমানের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো। ওই কণ্ঠের বাণী আগেই রেকর্ড করে রাখা হয়েছিল। তাতে শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ ঘোষণা করেছেন।’
তিনি আরও লিখেন, ‘ঘোষণায় বলা হয়, এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। বাংলাদেশের মানুষ যে যেখানে আছেন, আপনাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে দখলদার সেনাবাহিনীর মোকাবিলা করার জন্য আমি আহ্বান জানাচ্ছি।
‘পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলাদেশের মাটি থেকে উৎখাত করা এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আপনাদেরকে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে।’২৫ মার্চ ১৯৭১। তখনও চট্টগ্রাম সম্পূর্ণ স্বাধীন এবং ইপিআরের নিয়ন্ত্রণে। নিয়ন্ত্রণ করছিলেন ইপিআরের সাবেক ক্যাপ্টেন রফিক। চট্টগ্রামের সকলে তখন ঢাকার পরিস্থিতি অত্যন্ত মনোযোগের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করছে।
আমি তখন চট্টগ্রাম কলেজে এইচএসসির একজন পরীক্ষার্থী। তখন খবরাখবর সংগ্রহের জন্য আমার একমাত্র সম্বল ছিল ভাঙা একটি ট্রান্সজিস্টর। চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগ নেতারা ঢাকা থেকে বঙ্গবন্ধুর তারবার্তা পেয়ে তা বাংলা ও ইংরেজিতে ছাপিয়ে ২৬ তারিখ সকাল থেকে মাইকিং ও লিফলেট আকারে বিতরণ করা শুরু করেন। চট্টগ্রামে অনেকে সেই মাইকিং শুনেছেন।
২৬ তারিখ সন্ধ্যার পর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ভেসে এলো চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ হান্নানের কণ্ঠে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা-পাঠ ও তার ভাষণ। আবার পরের দিন সন্ধ্যার পর মেজর জিয়াউর রহমানের কণ্ঠে ভেসে এলো বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা-পাঠ। চট্টগ্রামে তৎকালীন রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত রেডিও স্টেশনটি ছিল আগ্রাবাদে। সেখান থেকে তা স্থানান্তর করে সাময়িকভাবে কালুরঘাটে স্থাপন করা হয়। সেই রেডিও স্টেশনটির অন্যতম সংগঠক ছিলেন বেলাল মোহম্মদ। তার সহায়তায় তৎকালীন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার সকল ঘোষণা পাঠ করা হয়েছিল।
এ বিষয়ে তিনি বিবিসি বাংলাকে কী বলেছিলেন, তা শোনা যাক: ‘২৬ মার্চ সকালবেলা আমরা একটা মাইকিং শুনতে পেয়েছি যে গত রাতে ঢাকায় আকস্মিকভাবে পাকিস্তান আর্মি নিরস্ত্র জনপদে আক্রমণ করেছে এবং খণ্ড খণ্ড যুদ্ধ চলছে। এই অবস্থায় আমাদের মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘আওয়ামী লীগের নেতা ড. আনোয়ার আলী দুপুরে আমাকে একটা কাগজ দিলেন। উনি নিজে বললেন একটা তারবার্তা এসেছে ঢাকা থেকে। আমরা এটার অনুবাদ করে এখন লিফলেট আকারে ছেড়েছি আর মাইকিং করছি।’
বিবিসি বাংলার সঙ্গে সাক্ষাৎকারে তিনি আরও বলেন, ‘সেদিন সন্ধ্যা ৭টা ৪০ মিনিটে বঙ্গবন্ধুর সেই ঘোষণা প্রথম সম্প্রচার করি, যা বঙ্গবন্ধুর পক্ষে পাঠ করেন এম এ হান্নান এবং তার ভিত্তিতে তিনি একটা বক্তৃতা দেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘২৭ মার্চ সন্ধ্যাতেও দ্বিতীয়বারের মতো অনুষ্ঠান সম্প্রচারে সক্ষম হই। সেদিনের অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন মেজর জিয়াউর রহমান।’
বঙ্গবন্ধুর বাঙালি জাতির উদ্দেশে স্বাধীনতার ঘোষণা ২৭ মার্চ ১৯৭১ বিশ্বের অন্তত ২৫টি দেশের পত্রিকা বা সংবাদ সংস্থার খবরে বিষয়টি প্রকাশিত হয়। তা ছাড়া সিবিএস নিউজ এবং এনবিসি নিউজ এ বিষয়টির ওপর সরাসরি সংবাদ সম্প্রাচার করে।
এ বিষয়ে প্রকাশিত ওই সকল সংবাদপত্র খোঁজ করে কোথাও মেজর জিয়াউর রহমানের নাম একটি বারের জন্যেও দেখা পায়নি। শুধু ব্রিটেনের দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় বলা হয়, পাকিস্তান থেকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ভাষণের পরপরই একটি গোপন রেডিও থেকে শেখ মুজিবুর রহমান পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়। এ ক্ষেত্রে গোপন রেডিও থেকে হয় সাবেক মেজর জিয়াউর রহমান বা চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের নেতা মরহুম আব্দুল হান্নান বঙ্গবন্ধুর পক্ষে ওই ঘোষণা পাঠ করে থাকতে পারেন, তবে এটি আব্দুল হান্নান সাহেব হওয়ার সম্ভাবনাই শতভাগ। কারণ ২৭ তারিখ রাতের সংবাদ ২৭ তারিখ সকালের পত্রিকায় প্রকাশ করা যে একেবারে অসম্ভব।
জিয়াউর রহমান সাহেব বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণাটি পাঠ করেন ২৭ মার্চ, ১৯৭১ সন্ধ্যায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সম্প্রচার শুরু করার পর। আর মো. আবদুল হান্নান বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণাটি পাঠ করেন ২৬ মার্চ ১৯৭১ তারিখ সন্ধ্যায়। তাই চট্টগ্রাম থেকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার প্রথম ঘোষণা-পাঠক হচ্ছেন এম এ হান্নান। তা ছাড়া ততক্ষণে সারা বিশ্বের মানুষ জেনে গেছে কে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা। তাই কে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করল না করল, তা আন্তর্জাতিক সংবাদপত্রগুলোর কাছে মোটেই গুরুত্বপূর্ণ ছিল না; বরং বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা এবং ঘোষণাপত্রে কী ছিল, সেটাই ছিল সব পত্রিকার প্রতিবেদন লেখার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
সেদিন ছাত্রলীগের এক নেতা, নাম সম্ভবত আবদুর রউফ, তিনিও স্বাধীনতার পক্ষে এক জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিয়েছিলেন। তিনিও তার বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার কথা উল্লেখ করেছিলেন, কিন্তু এখন আর তার নাম ইতিহাসের তেমন কোথাও একটা খুঁজে পাওয়া যায় না বা আমার চোখে পড়ছে না, কিন্তু আমি আমার কৈশোরের স্মৃতিকে তো আর অস্বীকার করতে পারি না। তার অবদানও আমি জিয়াউর রহমান সাহেব এবং হান্নান সাহেবের পাশাপাশি স্মরণ করছি।
যা হোক, বঙ্গবন্ধু তখন স্বাধীনতার স্বপক্ষে যে ঘোষণাপত্রটি তারবার্তা করে পাঠিয়েছিলেন, তা ছিল নিম্নরূপ:Declaration of Independence"THIS MAY BE MY LAST MESSAGE. FROM TODAY BANGLADESH IS INDEPENDENT. I CALL UPON THE PEOPLE OF BANGLADESH WHEREVER YOU MIGHT BE AND WITH WHATEVER YOU HAVE, TO RESIST THE ARMY OF OCCUPATION TO THE LAST. YOUR FIGHT MUST GO ON UNTIL THE LAST SOLDIER OF THE PAKISTAN OCCUPATION ARMY IS EXPELLED FROM THE SOIL OF BANGLADESH AND FINAL VICTORY IS ACHIEVED."
বঙ্গবন্ধুর এ ঘোষণাপত্র আমাদের সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলে অন্তর্ভুক্ত করা রয়েছে। তা ছাড়া এ বিষয়ে কিছু রেকর্ডপত্র ঢাকার শেরে বাংলা নগরে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে।উপসংহারে এইটুকুই বলব, স্বাধীনতার ‘ঘোষক’ এবং ‘ঘোষণা-পাঠক’ এক কথা নয়। এর মধ্যে ব্যবধান বিস্তর। এত বিস্তর যে পার্থক্য নিরূপণ প্রায় অসম্ভব। তা ছাড়া যে কেউ চাইলে স্বাধীনতার ঘোষণাও দিতে পারেন না। সে জন্য প্রয়োজন দেশের প্রতি তার ত্যাগ ও তিতীক্ষার দীর্ঘ ইতিহাস, দেশের অধিকার আদায়ে তার সংগ্রামী ভূমিকা, দেশের মানুষকে এক সুতায় বেঁধে অভীষ্ট লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে নেয়ার মতো সক্ষমতা, তথা দেশের জনগণকে তার কথায় আন্দোলিত করার মতো ক্ষমতা। বিষয়গুলো একবার বিবেচনায় আনা গেলে স্বাধীনতার ঘোষক বিষয়ে বিতর্ক থেকে সহজেই বেরিয়ে আসা যাবে।
শামসুল ইসলাম চৌধুরী মামুন: সাবেক সরকারি কর্মকর্তা ও একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা