২০০১ সালের ১৪ নভেম্বর রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব ছাড়ার পর থেকে গত দুই দশক তিনি নিভৃত জীবনযাপন করেছেন। নিভৃত মানে একেবারেই নিভৃত। গুলশানের বাসায়ই থাকতেন। একসময় সকালে গুলশান পার্কে হাঁটতে যাওয়া কেউ কেউ হয়তো তাকে দেখেছেন। তবে তিনি নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন সবরকম সামাজিকতা থেকেও। গত ২০ মার্চ সকালে যখন সাবেক রাষ্ট্রপতি ও সাবেক প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের মৃত্যুর খবর এল, তখন অপ্রত্যাশিত না হলেও সেটা বড় ধাক্কা। আড়ালে হলেও তিনি ছিলেন, এটা আমাদের সাহস জোগাত, অনুপ্রাণিত করত।
বরাবরই আড়ালে থাকা সাহাবুদ্দীন আহমদ হঠাৎ সব কিছুর কেন্দ্রে চলে আসেন ৯০-এর গণ-অভ্যুত্থানের সময়। ৯০-এর শেষ দিকে স্বৈরাচার এরশাদের পতন যখন সময়ের ব্যাপার, তখনও তার মন্ত্রীদের হুংকার কমেনি। একসময়ের আওয়ামী লীগ নেতা, পরবর্তী সময়ে বিএনপি নেতা শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন তখন ছিলেন এরশাদ সরকারের মন্ত্রী।
‘জনতার দাবি এক, এরশাদের পদত্যাগ’ এই প্রশ্নের জবাবে শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন বলেছিলেন, পদত্যাগপত্র কি জিরো পয়েন্টে উড়িয়ে দেয়া হবে? এক পর্যায়ে এটি আসলেই প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়, এরশাদ কার কাছে পদত্যাগ করবেন? টুকটাক মতভেদ থাকলেও তখন আন্দোলনের মাঠে থাকা তিন জোট প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকেই ক্রান্তিকালে জাতির অভিভাবক হিসেবে মেনে নেয়।
প্রক্রিয়া ঠিক হয়, ভাইস প্রেসিডেন্ট ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ পদত্যাগ করলে তার জায়গায় বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে নিয়োগ দেবেন এরশাদ। এরপর এরশাদ পদত্যাগ করলে সাহাবুদ্দীন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেবেন। এভাবে গণ-অভ্যুত্থানেও সাংবিধানিক ক্ষমতা হস্তান্তরের পথ উন্মুক্ত হয়। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে সাহাবুদ্দীন আহমদ রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নিতে অস্বীকৃতি জানান। বিশ্বজুড়ে যখন ক্ষমতার জন্য হানাহানি, রক্তারক্তি, ষড়যন্ত্র; তখন সবাই মিলে যাকে রাষ্ট্রপতি বানাতে চাইছেন, তখন তিনি রাজি হচ্ছেন না! এটা বাংলাদেশেই নয়, গোটা বিশ্বেই বিরল। শেষ পর্যন্ত এক শর্তে রাজি হলেন তিনি। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচন অনুষ্ঠান শেষে তাকে আবার প্রধান বিচারপতি পদে ফিরে যাওয়ার সুযোগ দিতে হবে।
প্রথম কথা হলো- ক্ষমতার চেয়ে বিচারাঙ্গন তার প্রিয়। দ্বিতীয়ত, চাকরির বাকি মেয়াদটাও তিনি পূর্ণ করতে চেয়েছিলেন। তার শর্তে সম্মত হয়েছিল তিন জোট এবং তাকে প্রধান বিচারপতির পদ ফিরিয়ে দিতে সংবিধান সংশোধন করতে হয়। সাহাবুদ্দীন আহমদের সমালোচকরা একজন ব্যক্তির জন্য সংবিধান সংশোধন করাকেই বার বার সামনে আনেন। যদিও সংবিধানের এই সংশোধনীতে রাষ্ট্রীয় নীতির কোনো বদল হয়নি। সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বেই ১৯৯১ সালের ২৭ জানুয়ারি নজিরবিহীন এক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। হেরে যাওয়া দল আওয়ামী লীগ সূক্ষ্ম কারচুপির অভিযোগ আনলেও দেশে-বিদেশে সে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা ছিল প্রশ্নাতীত।
অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির হিসেবে স্বল্পকালীন সময়েই বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ গণমাধ্যমের স্বাধীনতাসহ অনেকগুলো সংস্কার প্রক্রিয়ার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তার অনড় অবস্থানের কারণেই বিএনপি রাষ্ট্রপতি পদ্ধতি থেকে সংসদীয় পদ্ধতির সরকারে যেতে বাধ্য হয়েছিল। প্রধান বিচারপতি পদে ফিরে গিয়ে দায়িত্ব পালন শেষে ১৯৯৫ সালে তিনি অবসরে যান। কিন্তু ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে রাষ্ট্রপতি পদে সাহাবুদ্দীন আহমদকেই পছন্দ করে। কিন্তু এবারও তাকে রাষ্ট্রপতি হতে রাজি করাতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল আওয়ামী লীগকে। সংসদীয় পদ্ধতির সরকারে রাষ্ট্রপতির প্রায় কিছুই করার থাকে না। তবু সাহাবুদ্দীন আহমদ দলীয় সরকারের নির্দলীয় রাষ্ট্রপতি হিসেবে অনন্য এক নজির স্থাপন করেছিলেন। আওয়ামী লীগ সরকারের অনেক সিদ্ধান্তের সঙ্গে তিনি দ্বিমত পোষণ করেছিলেন। সংসদে পাস হওয়া ফিরিয়ে দেয়ার নজিরও সাহাবুদ্দীন আহমদেরই।
সাহাবুদ্দীন আহমদ রাষ্ট্রপতি থাকাকালে ’৯১ সালের মতো ২০০১ সালের নির্বাচনেও হেরে গিয়েছিল আওয়ামী লীগ। ২০০১ সালে হেরে যাওয়াটাকে আওয়ামী লীগ নিয়েছিল ‘বেইমানি’ হিসেবে। সেই থেকে আওয়ামী লীগের চোখে তিনি ‘ভিলেন’। সাহাবুদ্দীন আহমদই সম্ভবত একমাত্র ব্যক্তি, বাংলাদেশের প্রধান তিনটি রাজনৈতিক দলই যাকে ‘অপছন্দ’ করে।
জাতীয় পার্টির অভিযোগ, এরশাদের কাছ থেকে ক্ষমতা নিলেও সাহাবুদ্দীন আহমদই তাকে জেলে পাঠিয়েছিলেন। ’৯১ সালের নির্বাচনে সমান সুযোগ না পাওয়ার অভিযোগও জাতীয় পার্টির বরাবরের। আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রপতি বানালেও ২০০১ সালের পর থেকে তিনি ছিলেন তাদের চক্ষুশূল। আর আওয়ামী লীগের মনোনয়নে রাষ্ট্রপতি হওয়া বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে কখনই নিজেদের বলে মনে করেনি বিএনপি। তিন বড় দলের এই অপছন্দের মাত্রাটা টের পাওয়া গেছে তার মৃত্যুর পর।
জাতির ক্রান্তিকালের এই অভিভাবকের মৃত্যুতে শোকের আনুষ্ঠানিকতা থাকলেও আন্তরিকতা ছিল না। কোনো দলেরই সিনিয়র নেতাদের দেখা মেলেনি সিএমএইচে, বাসায় বা জানাযায়। তিনি ক্ষমতা চাননি। তাকে অনেকটা জোর করে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং রাষ্ট্রপতি বানানো হয়েছিল। তিনি ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য বা ক্ষমতায় থাকার জন্য কোনো দলের আনুগত্য প্রকাশ করেননি। বরং বরাবরই তিনি তার নীতি-আদর্শে অবিচল থেকেছেন। সাহাবুদ্দীন আহমদের সততা বাংলাদেশের বিবেচনায় রীতিমতো রূপকথাতুল্য। বঙ্গভবনে তার সাধারণ জীবনযাপনের গল্প এখনও লোকের মুখে মুখে ফেরে। ক্ষমতার শীর্ষে থেকে এমন নির্মোহ জীবনযাপন যে সম্ভব, তার একমাত্র উদাহরণ ছিলেন সাহাবুদ্দীন আহমদ।
বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের মৃত্যুর পর শোক প্রকাশে কার্পণ্য আমাদের রাজনীতিবিদদেরই আরও খাটো করেছে। রাজনীতিবিদরা বুঝিয়ে দিয়েছেন, অন্ধ আনুগত্য আর তেলবাজ ছাড়া আর কেউই তাদের আপন নয়। গুণী মানুষকে কদর করার মতো উদারতাও তাদের নেই। তবে রাজনীতিবিদদের কার্পণ্য সাহাবুদ্দীন আহমদকে একটুও খাটো করতে পারেনি। জীবনে কোনোদিন রাজনীতি না করেও, কোনোদিন নির্বাচনে অংশ না নিয়েও তিনি সারা জীবন জনগণের রাষ্ট্রপতি হয়ে; সততা, দৃঢ়তার প্রতীক হয়ে বেঁচে থাকবেন।
লেখক: সাংবাদিক, কলাম লেখক।