বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

হাজার বছরের সাধনার নাম শেখ মুজিব

  •    
  • ১৭ মার্চ, ২০২২ ১৫:০০

সব কিছু ছাপিয়ে এই একুশ শতকেও আছেন বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির জন্য দিকনির্দেশনা নিয়ে। তার সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে জাতি শেখ মুজিব হত্যার বিচার পেয়েছে। পলাতক খুনিদের দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চালাচ্ছে। বঙ্গবন্ধু হত্যার আরও আসামি মৃত্যুদণ্ডাদেশ নিয়ে পলাতক রয়েছে। জেলহত্যার বিচারও হয়েছে।

১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জের গ্রাম টুঙ্গিপাড়ায় চৈত্রদিনের গান, বসন্তের হাওয়া প্রবাহিত তখন, আর এরই মাঝে আবির্ভূত সহস্র বর্ষের সাধনার নাম- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি শুধু একটি নাম নন, হলেন একটি জাগ্রত ইতিহাস। একটি স্বাধীন জাতিসত্তার অপরিমেয় অহংকার, বর্ণিল ঐশ্বর্য। বঙ্গবন্ধু, বাঙালি এবং স্বাধীনতা একসূত্রে গাঁথা। বাংলাদেশের অস্তিত্বস্পর্শী অমর নাম। ন্যায়, সত্য, কল্যাণ এবং আত্মমুক্তির পক্ষে সোচ্চার উদার হৃদয় মহান মানুষ। কোনো প্রকার সংকীর্ণতা, গোঁড়ামি এবং সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প তাকে স্পর্শ করেনি কখনও। বাঙালিত্ব ছিল তার অহংকার। এই বাঙালিকে তিনি জাগিয়ে তুলেছেন রাজনৈতিক এবং সাংগঠনিক দক্ষতায়। কোটি কোটি মানুষের ইচ্ছার অনিন্দ্য কুসুম ফুটিয়ে তুলেছিলেন তিনি। তারই আহ্বানে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল যুদ্ধজয়ের রক্তাক্ত অধ্যায়ে বাঙালি জাতি। সৃষ্টি করেছিল ইতিহাস।

জাতির শানিত শিরায় অকুতোভয় সাহস ছড়িয়ে দিয়েছিলেন তিনি। দুঃসময়, হতাশার সব বাধার দেয়াল ভেঙে শোষিত-বঞ্চিত জাতিকে স্বাধীনতার সূর্যস্নানে স্নাত করিয়েছেন। তাই তো প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম উচ্চারিত হয় ত্যাগের উজ্জ্বল মহিমায় সিক্ত একটি নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এই নাম অবিরাম প্রতি সূর্যোদয়ে, সূর্যাস্তে অক্ষয়-অম্লান। চিরদিন বাংলার আকাশে-বাতাসে-মাটিতে শৌর্যে-বীর্যে বহমান নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষের প্রিয় নাম হয়ে প্রজ্বলিত যুগ থেকে যুগে। বঙ্গবন্ধু তাঁর নিজের জীবনের কথা লিপিবদ্ধ করেছেন। অসমাপ্ত সেই জীবনী।

ঘাতকের উদ্যত সঙ্গিন সেই রচনা সমাপ্ত হতে দেয়নি। একাত্তরের পরাজিত শক্তি এবং তাদের দেশি-বিদেশি এজেন্টরা বাঙালিত্বের চেতনা এবং স্বাধীনতার সব অর্জনকে নস্যাৎ করে দিতে বঙ্গবন্ধুর ওপর আঘাত হানে। যে শালপ্রাংশু, সিংহহৃদয় মহান মানুষটি অসীম দেশপ্রেম, জনগণের প্রতি তর্কাতীত ভালোবাসা, অনমনীয় দৃঢ়তা, ভয়-দ্বিধাহীন প্রত্যয় এবং কঠোর অধ্যবসায়কে সম্বল করে ক্রমে ইতিহাসের দীর্ঘ কণ্টকাকীর্ণ পথ পাড়ি দিয়েছেন।

শেখ মুজিব থেকে বঙ্গবন্ধু, জাতির পিতা এবং সর্বোপরি একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতার মর্যাদা পেয়েছেন। তাকে পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্ট দস্যুর মতো রাতের অন্ধকারে নিরস্ত্র অবস্থায় পরিজনসহ হত্যা করা হয়। এ যে জাতির জন্য কত বড়ো গ্লানি, অপমান ও লজ্জার কথা; তা অবর্ণনীয়। ইতিহাসের চাকা, সভ্যতার চাকাকে নিষ্পেষিত করে ঘাতকরা বাঙালি জাতির জীবনে সৃষ্টি করেছিল ট্র্যাজেডি।

টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম যে মহান মানুষটির, তার জীবন ও কর্ম একটি জাতির জীবনকে দিকনির্দেশনা দেয় প্রতিমুহূর্তে। মানুষের প্রতি দয়াদাক্ষিণ্য, মানুষের প্রতি মমত্ববোধ শেখ মুজিবকে এক মহানপ্রাণ মহামানবে পরিণত করার দিগন্ত উন্মীলিত করেছে। বাঙালি জাতির প্রাণপ্রবাহ এবং ধমনিতে তিনি সাহসের মন্ত্র বুনে দিয়েছেন। নির্যাতিত-নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর জন্য নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন তিনি। বাংলার অবহেলিত এবং হতভাগ্য জনগণের কল্যাণ কামনায় সর্বক্ষণ ব্যাপৃত ছিলেন। তাই জীবনের প্রতিটি ক্ষণ কেটেছে তার অত্যন্ত ব্যস্ততায়। একটি মুহূর্তকেও অপচয় খাতে প্রবাহিত করেননি।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজ একটি নাম, একটি ইতিহাস। বাঙালি জাতির সংগ্রামী জীবনধারার প্রতিটি সিঁড়িতে ছিলেন তিনি এককভাবে অগ্রসরমান। সবাইকে পেছনে রেখে তিনি এগিয়ে গিয়েছিলেন একটি পশ্চাৎপদ ঘুমন্ত জাতিকে জাগিয়ে তোলার কঠিন কাজটি সম্পাদনে। একটি জাতির জাগরণ, একটি জাতির অভ্যুত্থান, একটি রক্তাক্ত একাত্তর এবং একটি স্বাধীনতা- সব কিছুই সম্ভব হয়েছে একক নেতৃত্বে। আর এই যুগান্তকারী কালজয়ী নেতাই হলেন শেখ মুজিবুর রহমান।

বাঙালি যাকে ‘বঙ্গবন্ধু’ খেতাব দিয়ে সম্মানিত-সমৃদ্ধ করেছে নিজেদের। জাতি জানে, এসব অর্জন সম্ভব হয়েছিল একজন শেখ মুজিবের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও বিশাল ব্যক্তিত্বের কারণে। ছিলেন দূরদর্শী, দুঃসাহসী, আপসহীন। সততা, কর্মনিষ্ঠতা, কর্মকুশলতা সবকিছু মিলিয়ে এক অতুলনীয় মানবে পরিণত হয়েছিলেন শেখ মুজিব। হয়ে উঠেছিলেন বাঙালি জাতির জীবনে আপন দ্যুতিতে প্রজ্বল এক অবিনাশী ধ্রুবতারা। সহস্র বছরের সাধনা শেষে বাঙালি জাতি পেয়েছে তার মহানায়ককে, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালিকে।

শেখ মুজিবুর রহমানের পুরো জীবনটাই নিবেদিত তার দেশ, জাতি ও জনগণের জন্য। বুকের তাজা রক্ত দিয়ে জাতির প্রতি যে অপরিসীম ভালোবাসা, তা প্রমাণ করে গেছেন। জীবনের পুরো পথ পরিক্রমায় বাঙালির সুখ-দুঃখের সঙ্গে একাকার ছিলেন। নিরন্ন-দুঃখী, অভাবী-বঞ্চিত, লাঞ্ছিত-নিপীড়িত জাতির দুর্ভোগ মোচনে নিবেদিতপ্রাণ হিসেবে অগ্রসেনানীর দায়িত্ব পালন করেছেন।

দাঙ্গাপীড়িত বাঙালি-অবাঙালিকে রক্ষায় জীবন বাজি রেখে এগিয়ে গিয়েছেন। লোভ-মোহের ঊর্ধ্বে ছিলেন বলেই শাসকের নানা প্রলোভন উপেক্ষা করে দুঃসাহসে প্রতিবাদ-প্রতিরোধী হয়েছেন। দিনের পর দিন কেটেছে কারাগারে। লৌহকপাটের অন্তরালে কখনও ভেঙে পড়েননি। হতাশা গ্রাস করেনি। শাসকদের সমঝোতার পথকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছেন। ভোগ-বিলাস, ক্ষমতার অংশীদারত্ব ইত্যাদিকে তুচ্ছজ্ঞান করে বাঙালি জাতির ভাগ্যোন্নয়নের জন্য আপসহীনভাবে লড়াই করে গেছেন শেষদিন পর্যন্ত। নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে সগর্বে ঘোষণা করেছেন, ‘দাবায়ে রাখতে পারবা না।’ সেই সাহসী উচ্চারণ অহেতুক ছিল না। প্রমাণ করে দিয়েছেন যে, বাঙালি জাতিকে দাবিয়ে রাখা সহজসাধ্য নয়।

এই ঘুমন্ত জাতিটিকে আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ধাপে ধাপে এগিয়ে নিয়ে গেছেন চূড়ান্ত বিজয়ের দিকে। যে জাতি কখনও বন্দুক-বেয়নেট দেখেনি, সে জাতি একাত্তরে অস্ত্র হাতে লড়াই করেছে বাঁশের লাঠি, লগি-বৈঠা ফেলে। ‘জীবন-মৃত্যু পায়ের ভৃত্য’ হিসেবে জেনেছেন তিনি। ঘুমন্ত জাতির প্রতিটি শিরা-উপশিরায় রক্তপ্রবাহের উত্তাপ বঙ্গবন্ধু ধারণ করতেন। তাই জাতিকে নিজের মতো করে ধীরে ধীরে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। ইতিহাসের চাকাকে ঘুরিয়ে দিয়েছেন। হাজার বছর ধরে পরাধীন-পর্যুদস্ত থেকে থেকে যে জাতিটি আধমরা থেকে পুরো মড়ায় পরিণত হচ্ছিল ক্রমশ; বজ্রহুংকারে শুধু নয়, আদর-সোহাগে প্রাণের প্রবাহে স্পন্দন তুলে একটি বিন্দুতে এনে দাঁড় করিয়েছিলেন।

হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি তিনি। জীবনের পুরো সময়ই থেকেছেন আন্দোলন-সংগ্রামে। তার আজীবন স্বপ্ন ছিল পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে দেশকে মুক্ত করার। দেশ স্বাধীন করার। দীর্ঘ আন্দোলনের মাধ্যমে তিনি স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন। লাল-সবুজের পতাকায় বাঙালির মুক্তির জয়গান লিখেছেন। তার জীবন এক বীরত্বগাথা।

শুধু বাঙালি জাতি নয়, বাংলাভাষীসহ অন্য ভাষাভাষী মানুষের কাছেও মুক্তির প্রতীক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন শেখ মুজিব। বাঙালি-অবাঙালি দাঙ্গার সময় ছুটে গিয়েছেন কোনো পক্ষাবলম্বন না করেই। দুপক্ষকেই নিরস্ত করতে পেরেছিলেন। অবাঙালিদের বলেছিলেন, তোমরা আমার ভাই। পাশাপাশি স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন, আমার দেশের মানুষের রক্তে হোলিখেলার চেষ্টা করো না।

দেশে বসবাসরত বাংলাভাষী নয়, এমন মানুষকেও তিনি কাছে টেনেছেন। বলেছেন, সাম্য-মৈত্রীর বন্ধনে সবাই যেন যার যার স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেও এক হয়ে মিশি। ভুলে যাই যেন ভেদাভেদ। নিজের জীবনেও তিনি এই বিশ্বাসবোধের প্রমাণ রেখেছেন। উর্দুভাষীদের তিনি ঘৃণার চোখে কখনও দেখেননি। বরং তাদেরও বাঙালিদের সঙ্গে মিলেমিশে বসবাস করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। পৃথিবীর নিপীড়িত জাতিসত্তার বিকাশের ক্ষেত্র সম্প্রসারণের আহ্বান জানিয়ে জাতিসংঘে বক্তৃতাও করেছিলেন এবং তা বাংলা ভাষায়। বিশ্ব দরবারে বাংলা ভাষাকে তিনি দিয়েছিলেন উচ্চাসন।

বঙ্গবন্ধু স্কুলজীবন থেকেই স্বাধীনচেতা ও নির্ভীক ছিলেন। হিন্দু, খ্রিস্টান এবং মুসলমান অধ্যুষিত অঞ্চলে বেড়ে উঠেছেন। তাই জন্মগতভাবে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় লালিত ছিলেন। ধর্মীয় গ্রন্থ কোরআন পাঠ করেছেন। কারাগারের জীবনে এবং পাকিস্তানি কারাগারে একাত্তরের ৯ মাস বন্দিজীবনকালে নিয়মিত কোরআন তেলাওয়াত করতেন। কিন্তু কখনই ধর্মান্ধ ছিলেন না।

তাই ইংরেজি ভাষা ছাত্রজীবনেই চর্চা করেছেন। এ ভাষায় পারদর্শী ছিলেন বলেই এবং মেধাবী হিসেবে সেসময়ের কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হতে পেরেছিলেন। আইন বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা চলাকালেই বহিষ্কৃত হন। অপরাধ, বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের দাবি-দাওয়ার প্রতি সমর্থন দান।

বঙ্গবন্ধু বুঝতেন, পাকিস্তানিদের সঙ্গে আর বসবাস সম্ভব নয়। জোড়াতালি দিলেও মেলানো যাবে না। সুতরাং, ছয় দফা দাবিকে সামনে রেখে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু এক দফা ঘোষণা করলেন এবং তা স্বাধীনতা ও মুক্তির সংগ্রাম। সারা দেশ গর্জে উঠল সেই ডাকে। পাকিস্তানের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল বাংলাদেশ। বিশ্বের মানচিত্র থেকে মুছে গেল ‘পূর্ব পাকিস্তান’ নামটি।

উঠে এল ‘বাংলাদেশ’ নামক একটি নতুন রাষ্ট্র। বঙ্গবন্ধুর ডাকে অসহযোগ আন্দোলনকালে পুরো জাতি যে একটি বিন্দুতে এসে স্থির-প্রত্যয়ী হয়ে ওঠে, তা হচ্ছে স্বাধীনতা। পূর্ব বাংলার মানুষ স্বাধিকারের দাবি থেকে স্বাধীনতার দাবিতে পৌঁছে গেছে ততদিনে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে। পশ্চিমা সংবাদপত্রে বলা হলো- ‘ভয়েস অব বেঙ্গল’। সত্যিকার অর্থেই বঙ্গবন্ধু তখন বাংলার কণ্ঠস্বর।

৭ মার্চের ভাষণে তিনি পুরো জাতিকে স্বাধীনতার জন্য করণীয় সম্পর্কে দিকনির্দেশনা দিলেন। এমন পূর্বাভাসও দিলেন, ‘আমি যদি হুকুম দিবার না-ও পারি, তবে তোমাদের কাছে যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো।’

২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নিরস্ত্র মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। বাঙালি নীরবে আক্রমণ মেনে নেয়নি। বঙ্গবন্ধু ‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে’ তোলার জন্য বলেছিলেন। সাড়ে সাত কোটি মানুষের অবিসংবাদিত নির্বাচিত নেতা শেখ মুজিব। পাকিস্তানিদের আক্রমণের মুখে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন। সেই ঘোষণা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ল। সারা বাংলার মানুষ প্রতিরোধী হয়ে ওঠে।

গণহত্যার বিরুদ্ধে, স্বাধীনতার লক্ষ্যে বাঙালি অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিল শেখ মুজিবের ডাকে। গড়ে উঠল স্বাধীন বাংলাদেশের সরকার। যুদ্ধের নয় মাস বঙ্গবন্ধু অনুপস্থিত। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা তাকে গ্রেপ্তার করে পাকিস্তানে নিয়ে যায়। কিন্তু বাংলার জনগণ সশস্ত্র যুদ্ধ চালিয়ে যায় বঙ্গবন্ধুর নামে। বঙ্গবন্ধুর প্রভাব এমন সর্বব্যাপী ছিল যে, মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে পাকিস্তানের সঙ্গে আপস করার চেষ্টা যারা করেছিল, তারাও বঙ্গবন্ধুর নাম ব্যবহার করে।

স্বাধীন বাংলাদেশের পরিস্থিতি নাজুকই ছিল। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে অস্ত্রের ব্যবহার নাগরিক সমাজকে বদলে দিয়েছিল। রাজনীতির ধরনটাই পালটে দিয়েছিল। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম এবং পরিণামে সব কিছুর মূল্য বেড়ে গেল। দেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য পাটের চাহিদা কমে গেছে। মানুষের প্রত্যাশা পূরণের সুযোগ তখন ঘটছিল না। দেশি ও বিদেশি ষড়যন্ত্র শুরু হয় বাংলাদেশকে ঘিরে।

কিছু বামপন্থি ও দক্ষিণপন্থিরা আদাজল খেয়ে লাগল। পরস্পরবিরোধী দাবিতে রাজপথ মুখর হতে থাকল। কেউ চায় পাকিস্তানি সেনাদের বিচার, কেউ চায় পাকিস্তানে আটক বাঙালিদের ফিরিয়ে আনার প্রয়োজনে যুদ্ধবন্দিদের মুক্তি। কেউ চায় ঘাতক-দালালদের বিচার। আবার দালাল আইন প্রত্যাহার না করলে আন্দোলন করবেন বলে স্বয়ং মওলানা ভাসানী ঘোষণা করলেন।

স্বাধীনতাবিরোধীদের চক্রান্ত বাড়তে থাকে। তারা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাতে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে। যারা তাকে হত্যা করেছিল, তারা পাকিস্তানের পুনঃপ্রতিষ্ঠা চেয়েছিল। তাই যে তাজউদ্দীন আহমদ এক বছর আগে বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভা থেকে বিদায় নিয়েছিলেন, সেই তাকেও ঘাতকরা রেহাই দেয়নি। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর আরও তিন জাতীয় নেতার সঙ্গে স্বাধীন বাংলা সরকারের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনকেও জেলখানায় হত্যা করে। পাকিস্তান অভিনন্দন জানিয়েছিল কথিত ‘ইসলামি প্রজাতন্ত্রী’ বাংলাদেশকে।

মুক্তিযোদ্ধাদের সেক্টর কমান্ডার মেজর জিয়া পঁচাত্তর সালের ৭ নভেম্বর ক্ষমতা দখল করার পর খুনি মোশতাকের ধারায় দেশকে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত করার সুযোগ নেয়। তিনি একাত্তরের পরাজিত শক্তিকে রাজনীতিতে পুনর্বাসন করার কাজটি করেন। এরা শাসনক্ষমতায় বসে। এরপর ছড়ি ঘোরাতে থাকে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে যায়। স্বাধীনতার ইতিহাস, মূলনীতি বিকৃত হয়। বিকৃত হয় জাতীয় সংগীত।

এভাবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস মুছে ফেলাই শুধু নয়, শেখ মুজিবের নামও মুছে ফেলার চেষ্টা চলে। কিন্তু ইতিহাসের পাতাজুড়ে শেখ মুজিবের নাম জ্বলজ্বল করে। সব কিছু ছাপিয়ে এই একুশ শতকেও আছেন বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির জন্য দিকনির্দেশনা নিয়ে। তার সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে জাতি শেখ মুজিব হত্যার বিচার পেয়েছে। পলাতক খুনিদের দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চালাচ্ছে। বঙ্গবন্ধু হত্যার আরও আসামি মৃত্যুদণ্ডাদেশ নিয়ে পলাতক রয়েছে। জেলহত্যার বিচারও হয়েছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার জীবনদানের মধ্য দিয়ে প্রমাণ করে গেছেন, তিনি তার দেশ, জাতি ও জনগণের প্রতি ছিলেন সৎ। তার সততা ছিল বাঙালির প্রতি, বাঙালির সংস্কৃতির প্রতি, বাঙালির স্বাধীনতার প্রতি। সততার মাত্রা তীব্র ছিল বলেই কোনো দিন রণক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যাননি। লড়াই করেছেন সাহসের সঙ্গে। তাই গুলি বঙ্গবন্ধুর বুকেই লেগেছিল, পিঠে নয়।

লেখক: একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক, মহাপরিচালক, প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি)

এ বিভাগের আরো খবর