‘জয় বাংলা’কে জাতীয় স্লোগান করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সরকার। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে থেকে এ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২২-এ অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভা বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সরকার এই নির্দেশনা জারি করেছে বলে প্রজ্ঞাপনে জানানো হয়।
কখন ও কোথায় জয় বাংলা স্লোগান ব্যবহার করতে হবে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ‘তিন-চারটি ক্যাটাগরির কথা উচ্চ আদালতের রায়ে উল্লেখ করা আছে বলে জানিয়েছে। সাংবিধানিক পদধারী, রাষ্ট্রের সব কর্মকর্তা-কর্মচারী রাষ্ট্রীয় বা সরকারি অনুষ্ঠানের শেষে এটা বলবেন। এ ছাড়া সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা-ইউনিভার্সিটিসহ তাদের কোনো সভা-সেমিনার যদি হয়, অ্যাসেম্বলি বা যেকোনো ধরনের সমাবেশ হলে সেখানে জয় বাংলা স্লোগান দিতে হবে। এটা জাতীয় স্লোগান হিসেবে ব্যবহার করতে হবে। এটাই কেবিনেটের সিদ্ধান্ত।’
এমন সিদ্ধান্তে সবাই আনন্দিত। মুক্তিযোদ্ধারা বলছেন, জয় বাংলা মুক্তিযোদ্ধাদের স্লোগান, জয় বাংলা মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান। বিশ্বের প্রায় ষাটটি দেশে জাতীয় স্লোগান আছে। আমাদের ছিল না। জয় বাংলা আমাদের জাতীয় ঐক্য ও প্রেরণার প্রতীক। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে মিশে থাকা জয় বাংলা স্লোগানকেই করা হয়েছে জাতীয় স্লোগান। এটি যেমন আশাজাগানিয়া খবর তেমনি গৌরবেরও বিষয়।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, জয় বাংলা বাংলাদেশের জাতীয় স্লোগান হবে। সাংবিধানিক পদাধিকারীরা, দেশ ও দেশের বাইরে কর্মরত সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও সংবিধিবদ্ধ সংস্থার কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা সব জাতীয় দিবস উদযাপন এবং অন্যান্য রাষ্ট্রীয় ও সরকারি অনুষ্ঠানে বক্তব্যের শেষে জয় বাংলা স্লোগান উচ্চারণ করবেন। সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রত্যেক দিনের সমাবেশ শেষ হওয়ার পর এবং সভা-সেমিনারে বক্তব্যের শেষে শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীরা জয় বাংলা স্লোগান উচ্চারণ করবেন।
বাংলা একাডেমির অভিধান অনুসারে ‘জয়’ শব্দের অর্থ হচ্ছে- ‘সাফল্য, বিজয়, যুদ্ধাদি’ দ্বারা অধিকার, পরাভূত করা, দমন, শত্রু দমন, আনন্দ, ফুর্তি, খুশি ইত্যাদি। জয়বাংলার অর্থ দাঁড়ায় বাংলা ভাষা, বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির জয়। আমাদের অস্তিত্বে এই জয়বাংলা শব্দের শ্লোগানের ব্যবহার ও কার্যকারিতা আরও অনেক ব্যাপকভাবে বিস্তৃত। ‘বাংলা বাঙালির হোক, বাংলার জয় হোক, বাঙালির জয় হোক।’ বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের এই অবিনাশী পঙক্তিমালা; সাতকোটি কণ্ঠে বেজে ওঠে বাঙালির হৃদয়ে লালিত ‘জয় বাংলা’ স্লোগান।
১৯৪৭-এর পর থেকেই আওয়ামী লীগের নেতা শেখ মুজিব হয়ে ওঠেন স্বাধিকার আন্দোলনের অগ্রপথিক। বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে দায়ের করা হয় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। সারা বাংলায় সেই একই স্লোগান জয় বাংলা, জয় শেখ মুজিব দেয়া হয়। সরাসরি এই নামকরণের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের গণ্ডি অতিক্রম করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার বজ্রকণ্ঠে উচ্চারিত ‘জয়বাংলা’ স্লোগান হয়ে যায় সব মুক্তিকামী মানুষের।
জয় বাংলা স্লোগান জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সবাইকে একত্রিত করেছিল মুক্তিযুদ্ধে। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর সেই ঐক্যে ফাটল ধরে। গত ৫০ বছরে এসব বিষয়। ‘জয় বাংলা’ মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান। এই স্লোগান কীভাবে বাংলাদেশের হয়েছিল এ নিয়ে নানা আলোচনা রয়েছে।
১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানের চূড়ান্ত পর্যায়ে যাওয়ার আগেই রাজপথে ছাত্রদের মিছিলে উচ্চারিত হতে থাকে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান।
১৯৭০ সালের ২৮ নভেম্বর এক সাংবাদিক সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বলেন-“ঘূর্ণিঝড়ে ১০ লাখ মারা গেছে, স্বাধিকার অর্জনের জন্য বাংলার আরো ১০ লাখ প্রাণ দিবে”। ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের মোট ১৬৯ আসনের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে জয় বাংলা ধ্বনিতে আওয়ামী লীগ জয় করে ১৬৭ আসন। প্রমাণিত হয় বাঙালি জাতির বজ্রকঠিন ঐক্য। আরও অপরিসীম হয়ে ওঠে বঙ্গবন্ধু মুজিবের মৃত্যুঞ্জয়ী মন্ত্র জয় বাংলার শক্তি! যা ছিল- বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে ধর্ম-বর্ণ-মতভেদ নির্বিশেষে আমাদের একাত্ম হওয়ার মূল মন্ত্র, বাংলার মানুষের বুকের গভীরে বাঙালিত্ব জাগানোর সফল হাতিয়ার, সাধারণ বাঙালিকে বিশ্বসেরা বীর বাঙালিতে পরিণত করার কার্যকর দাওয়াই।
‘জয় বাংলা/ জয় বঙ্গবন্ধু', 'তোমার নেতা আমার নেতা/ শেখ মুজিব, শেখ মুজিব, বীরবাঙালি অস্ত্র ধরো/ বাংলাদেশ স্বাধীন করো, তোমার আমার ঠিকানা/ পদ্মা মেঘনা যমুনা, জাগো জাগো/ বাঙালি জাগো। 'জয় বাংলা, জয় বাংলা, জয় বাংলা...'।
স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষে তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতা আসম আব্দুর রব ১৯৭১ সালের ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উত্তোলন করেন বাংলাদেশের প্রথম পতাকা। সেইসঙ্গে বার বার উচ্চারিত হয় জয় বাংলা স্লোগান। ভঙ্গ করা হয় কারফিউ। ‘জয় বাংলা, জয় বাংলা’ ধ্বনিতে উদ্বেলিত বাঙালি।
পাকবাহিনীর হামলায় রাজপথে হতাহত হয় অসংখ্য মুক্তিকামী মানুষ! ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ পল্টন ময়দানে পরিবেশন করা হয় বঙ্গবন্ধুর ভালোবাসার কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’- 'বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত' হিসেবে গাওয়া হয়। সেইসঙ্গে উত্তোলন করা হয় আমাদের জাতীয় পতাকা। প্রচার করা হয় স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ঘোষণাপত্র।
৭ মার্চে দেয়া জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর দিকনির্দেশনা অনুসারে যার যা-কিছু আছে তাই নিয়ে দেশের সব মানুষ এই বাংলাকে শত্রুমুক্ত করার জন্য 'জয় বাংলা' বলে ঝাঁপিয়ে পড়ে মরণপণ যুদ্ধে। সবার বুকে স্পন্দিত ও মুখে উচ্চারিত আকাশে-বাতাসে প্রতিধ্বনিত জয়বাংলা স্লোগান ছিল এই যুদ্ধেরও প্রধান হাতিয়ার।
১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানের চূড়ান্ত পর্যায়ে যাওয়ার আগেই রাজপথে ছাত্রদের মিছিলে উচ্চারিত হতে থাকে জয় বাংলা স্লোগানটি। ছাত্র আন্দোলনের মুখে বঙ্গবন্ধু কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার সময়টাতেও এই স্লোগান দিয়েছিলেন ছাত্রনেতারা। একাত্তরে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কিছু মূল নীতির ভিত্তিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যার মূলে ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতা। জয় বাংলা স্লোগান জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সবাইকে একত্রিত করে একাত্তরে। মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস অর্জনের পথ ছিল কণ্ঠ আকাশে তুলে জয় বাংলা স্লোগান দেয়া। আর তাদের বীরত্ব প্রকাশের ভাষাটিও ছিল জয় বাংলা।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মুক্তিকামী মানুষ বার বার উচ্চারণ করে জয়বাংলা স্লোগান। 'জয়বাংলা' নামে রণাঙ্গন থেকে তখন প্রকাশিত হতো একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা। সবার বুকে ও মুখে ছিল জয়বাংলা স্লোগান।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে 'জয় বাংলার লোক' অভিহিত করেই আমাদের স্বাধীনতার পক্ষের লাখ লাখ নিরীহ মানুষকে নির্যাতন ও হত্যা করেছে পাকিস্তানের সমর্থক বাহিনী। অবশেষে বীর বাঙালির ৯ মাসের মরণপণ যুদ্ধে পরাস্ত হয়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বিকেল ৫ টায় বাংলাদেশ ও ভারতের মিত্রবাহিনীর কাছে পাকিস্তানি সৈন্যরা করে শর্তহীন আত্মসমর্পণ। বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠা লাভ করে মুজিবের চির কাঙ্ক্ষিত স্বাধীন বাংলাদেশ।
১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন ও দিল্লি হয়ে শেষে ১০ জানুয়ারি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের রক্তাক্ত মাটিতে পা রাখেন বিশ্বনন্দিত বিজয়ী বীর বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সবার কণ্ঠে সেদিন জয়বাংলাই ছিল প্রিয় নেতাকে বরণ করার স্লোগান।
জয়বাংলা আমাদের সবচেয়ে শক্তিশালী ও সফল হাতিয়ার! মূলত এই হাতিয়ারের বলেই আমরা পরাভূত করেছি পাহাড় সমান প্রতিপক্ষ। জয় করেছি আমাদের আসল পরিচয় বাঙালি জাতীয়তাবাদ, মায়ের মুখের বাংলাভাষা ও মাতৃভূমি বাংলাদেশ। কিন্তু তা সঠিকভাবে জানে না আমাদের নবীন প্রজন্ম!
জয় বাংলা উপমহাদেশে সবচেয়ে প্রেরণাদায়ী, তাৎপর্যপূর্ণ স্লোগান। অথচ ভারতে ‘জয়হিন্দ’ ও পাকিস্তানে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ যে সার্বজনীনতা পেয়েছে, জয় বাংলার ক্ষেত্রে তাকে পাড়ি দিতে হয়েছে খুবই বন্ধুর পথ। সর্ব্বোচ্চ আদালতের রায়ের পরেও এখন জয় বাংলা রাষ্ট্রীয়ভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। জয় বাংলা কিন্তু অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে আজ এখানে এসেছে। স্বাধীনতার ৫০ বছর পর।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বিভিন্ন সময় ‘জয় বাংলা’ ব্যবহার করা হতো। এই বেতার কেন্দ্রের স্বাক্ষরসংগীত ছিল জয় বাংলা, বাংলার জয়। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ১১ এপ্রিল ১৯৭১ প্রচারিত প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের প্রথম বেতার ভাষণটি শেষ হয়েছিল ‘জয় বাংলা, জয় স্বাধীন বাংলাদেশ’ স্লোগান দিয়ে।
যারা নতুন প্রজন্ম, তাদের একাত্তর দেখা হয়নি; তবে প্রথমবারের মতো ‘জয় বাংলা’র শক্তি অনুভব করেছে ১৯৯২ সালে দিবসে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গণ-আদলত গঠনের সময়। ২০১৩ সালে দ্বিতীয়বার অদেখা মুক্তিযুদ্ধের স্বাদ পেয়েছে কোনো রকম দলীয় রাজনৈতিক নেতৃত্ব ছাড়া গড়ে ওঠা শাহবাগের গণ-জাগরণের সময়। অনেক বছর পর রক্ত দিয়ে কেনা হারিয়ে যাওয়া প্রিয় ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে প্রকম্পিত হয় সারা দেশ। জয় বাংলা কোনো দলীয় স্লোগান নয়, এর মালিক বাংলাদেশ তাই যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে দল-মত নির্বিশেষে আপামর গণমানুষের মুখে স্বতঃস্ফূর্তভাবে উচ্চারিত হয় জয় বাংলা।
এক সময় ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটিকে নির্বাসিত করা হয়েছিল কিন্তু বঙ্গবন্ধু আবার ফিরে এসেছেন আরও তেজোদীপ্তভাবে। ‘জয় বাংলা’কে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা অনেক সহজতর হয়েছে। যেহেতু সর্ব্বোচ্চ আদলত জয় বাংলাকে জাতীয় স্লোগান হিসেবে ঘোষণা করেছে এবং মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল দেশ পরিচালনা করছে তাই কাজটি সহজ হয়েছে।
বিভক্তির রাজনীতি থেকে মুক্তিযুদ্ধের স্লোগানকেও দলীয় স্লোগান হিসেবে দেখিয়ে বিতর্কিত করা হয়েছে। অবশেষে জয় বাংলা পেল স্বীকৃতি জাতীয় স্লোগান হিসেবে।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও গবেষক