বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

অনাকাঙ্ক্ষিত যুদ্ধ, অসহায় মানবতা

  • চিররঞ্জন সরকার   
  • ৪ মার্চ, ২০২২ ১৫:১৯

যুদ্ধ মানেই পরাশক্তিগুলোর অর্থনৈতিকভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর খেলা। নিজের সামর্থ্য ঝালিয়ে নেয়া ও অস্ত্র বিক্রির নতুন বাজার খোঁজা। এখন এর সঙ্গে যোগ হয়েছে তেল-গ্যাসের বাজার দখল। পরাশক্তি হিসেবে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে রাশিয়ার সামনে দুর্দিন।

জঙ্গিবাদ দমনের নামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশগুলো ইরাক-আফগানিস্তানে অন্যায় যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছিল। এই দেশগুলোয় হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়েছে। দুটো দেশকে চিরতরে পঙ্গু বানিয়ে দেয়া হয়েছে। আফগানিস্তানে শেষ পর্যন্ত তালেবানের মতো জঙ্গি শাসকের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বিদায় নিতে হয়েছে।

এমন ঘটনা শুধু ইরাক-আফগানিস্তানেই ঘটেনি, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের নামে পাকিস্তান, সিরিয়া, লিবিয়া, তিউনিসিয়া, ইয়েমেনসহ পুরো মধ্যপ্রাচ্যকেই নরক বানানো হয়েছে। কখনও সেনা অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে, কখনও অর্থ-অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করা হয়েছে। কখনও ড্রোন হামলা পরিচালনা করা হয়েছে। এসব অভিযানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ন্যাটো ছিল এক জোট।

গত এক দশকে আন্তর্জাতিক রাজনীতির নানা ঘটনাক্রম ও অর্থনৈতিক হিসাব-নিকাশের ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের প্রতিদ্বন্দ্বী একটি জোটের সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছিল। ইউক্রেনকে কেন্দ্র করে মার্কিন রাষ্ট্রপতি বাইডেন ও ন্যাটোর ভুলনীতির কারণে, সেই জোটটিই এখন দৃশ্যমান হতে চলেছে। চীন, রাশিয়া, ইরান, তুরস্ক ও উত্তর কোরিয়া মিলে যে জোট গড়ে উঠছে। এই দেশগুলোর সম্মিলিত অবস্থান এক নতুন শঙ্কা তৈরি করেছে। এই অক্ষ শক্তি শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপীয় ইউনিয়ন-বিরোধী নয়, এরা মানব জাতিকে পৃথিবীর বুক থেকে মুছে দিতে সক্ষম।

ইউক্রেনে সামরিক অভিযানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা রাশিয়ার বিরুদ্ধে বেশ কিছু নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। ভবিষ্যতে কঠিন পরিণতি নেমে আসবে বলেও হুঁশিয়ার করে দিয়েছে। কিন্তু তাতে কি পরিস্থিতি বদলাবে? রাশিয়া যদি চীনের সমর্থন পায়, তাহলে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রাশিয়াকে খুব বেশি কাবু করা যাবে না। উল্টো বরং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রর মিত্র দেশগুলোই সংকটে পড়তে পারে।

অনেক ইউরোপীয় দেশ রাশিয়ার জ্বালানির ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল, বিশেষ করে বেশ কটি গুরুত্বপূর্ণ পাইপলাইনের ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। রাশিয়ার জ্বালানির ওপর এই নির্ভরশীলতার কারণে ইউরোপীয় দেশগুলো তাকে এখনই আন্তর্জাতিক পেমেন্ট ব্যবস্থা সুইফট থেকে বিচ্যুত করতে চায় না। রাশিয়া থেকে ইউরোপের গ্যাস সরবরাহ এখনই পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবে, এমন সম্ভাবনা কম। তবে এই সরবরাহে সামান্য ব্যাঘাত ঘটলেও বড় ধরনের প্রভাব পড়তে পারে। আর তাতে ইউরোপীয় দেশগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

জ্বালানির পর খাদ্য সরবরাহেও বড় ধরনের সংকট হওয়ার শঙ্কা আছে। বিশ্বের এক-চতুর্থাংশের বেশি গমের সরবরাহ আসে রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে। আর বিশ্বের অর্ধেকেরও বেশি সূর্যমুখী তেল সরবরাহ করে ইউক্রেন। তবে গমের ব্যাপারটা গুরুত্বপূর্ণ, কারণ বিশ্বের অধিকাংশ মানুষের প্রধান খাদ্য রুটি। দেশে গত কয়েক মাসে কেজিপ্রতি আটার দাম ১০ টাকার মতো বেড়েছে। এর প্রভাবে বেকারি পণ্যের দামও বেড়েছে। এ পরিস্থিতিতে গমের সরবরাহ বিঘ্নিত হলে দেশে গমের দাম আরও বাড়তে পারে।

জ্বালানির দাম বাড়লে পরিবহন খরচ বৃদ্ধি পায়—এটা অবশ্যম্ভাবী। তবে এই যুদ্ধের সঙ্গে আরও কিছু বিষয় জড়িত। ২০১১ সালে চীনের সঙ্গে রাশিয়ার রেল যোগাযোগ শুরু হয়। ইতোমধ্যে এই রুটে ৫০ হাজার ট্রেন চলাচল করেছে। তবে সম্প্রতি এই লাইন ইউক্রেন থেকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। ফলে যুদ্ধের কারণে এ যোগাযোগ তেমন একটা বিঘ্নিত হওয়ার সম্ভাবনা নেই।

বিশ্বের সবচেয়ে বেশি লোহা, নিকেল ও কপার উৎপাদিত হয় রাশিয়া ও ইউক্রেনে। এ ছাড়া নিয়ন, প্যালাডিয়াম ও প্লাটিনামের মতো আরও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ধাতু উৎপাদন ও বিপণনের সঙ্গে যুক্ত এসব দেশ। রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞার এই হুমকির ভীতিতে ইতোমধ্যে এসব ধাতুর মূল্য বেড়ে গেছে। গত ডিসেম্বরের পর প্যালাডিয়ামের দাম ইতোমধ্যে ৮০ শতাংশ বেড়েছে। গাড়ির ধোঁয়া নির্গমন ইউনিট থেকে শুরু করে মোবাইল ফোন, দাঁতের ফিলিং—এ রকম অনেক কিছুতেই প্যালাডিয়াম ব্যবহৃত হয়।

এ ছাড়া ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিমানশিল্প রাশিয়ার টাইটেনিয়ামের ওপর নির্ভরশীল। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বোয়িং কোম্পানিগুলো ইতোমধ্যে বিকল্প উৎস থেকে টাইটানিয়াম সংগ্রহ শুরু করেছে। এতে করে ইউরোপ-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও অসুবিধায় পড়বে।

মাইক্রোচিপের ক্ষেত্রেও সমস্যা তৈরি হবে। যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ায় মাইক্রোচিপ সরবরাহ বন্ধের হুমকি দিচ্ছে, অন্যদিকে মাইক্রোচিপের প্রয়োজনীয় উপকরণ- যেমন নিয়ন, প্যালাডিয়াম ও প্লাটিনামের উৎস হচ্ছে রাশিয়া। নিয়নের ৯০ শতাংশই জোগান দেয় রাশিয়া। কাজেই রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করলে তার ফল নিজেদেরও ভোগ করতে হবে।

রাশিয়ার গ্যাস, তেল ও খনিজের অভাবে ইউরোপ অনেকটা অচল হয়ে যাবে। চাইনিজ সস্তা জিনিস না পেলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গরিবেরা চলতে পারবে না। ওদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বন্ডের সবচেয়ে বড় ক্রেতা চীন, রাশিয়ার কাছে ৬০০ বিলিয়ন ডলার থাকায় পুটিন নিষেধাজ্ঞা বা ‘স্যাংশান’-কে ভয় পাচ্ছেন না।

এটা প্রচলিত প্রবাদ যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যার বন্ধু তার শত্রুর দরকার হয় না। নতুন বিশ্ব বাস্তবতায় চীনারা কারো বন্ধু নয়, ওরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-বিরোধীদের বন্ধু বণিক। আর মানবতা ও শান্তির ধারকবাহক হিসেবে পরিচিত রাশিয়া এখন একটি মাফিয়া রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। সাম্রাজ্য দখলের নেশা ক্ষমতাসীন পুতিনকে এক ভয়ংকর রাষ্ট্রনায়কের পরিচিতি দিয়েছে। রাশিয়া এখন নিজের শক্তি-সামর্থ্য বাড়ানো ছাড়া অন্য কিছুকে গোনায় ধরে না। মানবতা তাদের অভিধান থেকে বিলুপ্ত একটি শব্দ।

পৃথিবীতে বিশ্ব বাণিজ্যের কারেন্সি বা মাধ্যম হিসেবে যতদিন ডলার ব্যবহার করা হবে ততদিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রর শক্তি ও ঔদ্ধত্য কমবে বলে মনে হয় না। ডলার আর রিজার্ভের কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিরাট একটা সুবিধা ভোগ করছে। সারা বিশ্বের রিজার্ভ তার কাছে জমা। এটা দিয়ে সে নিষেধাজ্ঞার ভয় দেখায়। যতদিন ডলারের বিপরীতে নিরপেক্ষ কোনো কারেন্সি ঠিক না হবে ততদিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রর কর্তৃত্ব কমবে বলে মনে হয় না। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রর কর্তৃত্ব মানেই কোনো না কোনো দেশের ওপর অন্যায় শাসন চেপে বসা। এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রর প্রতিপক্ষ হিসেবে চীন ও রাশিয়া যা করছে, সেটা আরও ভয়ংকর। যেকোনো একটা পক্ষ দুর্বল না হলে পৃথিবী থেকে উত্তেজনা কমবে না।

যুদ্ধ মানেই পরাশক্তিগুলোর অর্থনৈতিকভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর খেলা। নিজের সামর্থ্য ঝালিয়ে নেয়া ও অস্ত্র বিক্রির নতুন বাজার খোঁজা। এখন এর সঙ্গে যোগ হয়েছে তেল-গ্যাসের বাজার দখল। পরাশক্তি হিসেবে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে রাশিয়ার সামনে দুর্দিন। রাশিয়ার অস্ত্রের বাজার ক্রেতাশূন্য হয়ে পড়েছে, তেল-গ্যাসও এখন আর কেউ নিতে অতটা আগ্রহী নয়, কারণ ডিসেম্বর ২০২১-এর ভেহিকেল রেজিস্ট্রেশনের হিসাব অনুযায়ী ইউরোপের মোট গাড়ির ২৯% ইলেক্ট্রিক ভেহিকেল যা ২০৩০-এ ৬০% ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে।

উন্নত দেশগুলোতে এখন বাসাবাড়িতেও ইলেক্ট্রিক চুলা ও বয়লার বিহীন ওয়াটার হিটার ব্যবহার করা হয়ে থাকে। অতএব, গ্যাস ও তেল বন্ধের হুমকি রাশিয়ার কোনো কাজে আসছে না। বিশ্বকে খাওয়ানোর মতো রশিয়ার হাতে আর তেমন কিছু নেই, ভবিষ্যৎ অন্ধকার বলেই মনে হচ্ছে। নিজে যেহেতু উন্নতি করতে পারছে না, যুদ্ধ বাধিয়ে অন্যের উন্নতি যদি কিছুটা বাধাগ্রস্ত করতে পারে তাতে হয়ত আরও কিছু দিন ভালো থাকা যাবে। দেশে যুদ্ধবাদীদের সমর্থন পাওয়া যাবে।

একথাও ঠিক যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররাও রাশিয়ার সঙ্গে শর্ত মেনে চলেনি। সোভিয়েত ইউনিয়ন যখন ভেঙে টুকরো টুকরো হয় তখন চুক্তি ছিল রাশিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া রাষ্ট্রগুলোকে ন্যাটোর সদস্য করা হবে না। কিন্ত পশ্চিমা বিশ্ব এই চুক্তির ধারাকে উপেক্ষা করে রাশিয়াকে দুর্বল করার জন্য ইউক্রেনকে ন্যাটোর সদস্য করতে গিয়েছে।

রাশিয়া এখন যখন তিনদিক থেকে ইউক্রেনকে আক্রমণ করে কিয়েভে উপস্থিত তখন অনেক রকম প্রতিশ্রুতি দেয়া বিশ্ব মোড়লরা কেউই সরাসরি জেলেনেস্কিকে সাহায্য কর‍তে এগিয়ে আসেনি ‘স্যাংশন’ আরোপ করা ছাড়া। বাইডেন এখন তুরস্ককে সঙ্গে নিয়ে পুতিনকে অনুরোধ করছে এই বিধ্বংসী যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য। এতদিন এত বড় বড় কথা হুমকি-ধমকি দিল তারা এখন নামে না কেন আসরে?

না, নামবে না। সবাই তার নিজের স্বার্থটা দেখছে। মাঝখান থেকে বলি হচ্ছে ইউক্রেনের সাধারণ মানুষ। আমরা সবাই জানি যুদ্ধ মানে কান্না-রক্ত, উদ্বাস্তু হয়ে নিজের ভূমি-আবাস হারানো, ধ্বংসলীলা। তারপরও অনাদিকাল থেকে যুদ্ধ চলছে। রাশিয়া-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রর মতো শক্তিধর দেশগুলোর কারণে তা হয়তো দীর্ঘায়িতও হতে পারে! টাকার ক্ষুধা, ক্ষমতার ক্ষুধা, কর্তৃত্বের ক্ষুধার তো মৃত্যু নেই!

লেখক: প্রবন্ধকার, সাবেক ছাত্রনেতা

এ বিভাগের আরো খবর