একটি সুখবর দিয়েই লেখাটি শুরু করতে চাই। বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় এখন ২ হাজার ৫৯১ ডলার। গত বছরও যা ছিল ২ হাজার ৫৫৪ ডলার। সর্বশেষ মাথাপিছু আয় টাকার অঙ্কে দাঁড়ায় ২ লাখ ২৫ হাজার। আমাদের মাথাপিছু আয় বাড়ছে। আমরা এখন মধ্যম আয়ের দেশ। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে আমরা উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছি। সবদিক দিয়েই এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। তবে উন্নয়নের সুফল সব মানুষের কাছে পৌঁছাচ্ছে কি না সেই প্রশ্নটি রয়েই গেছে।
মাথাপিছু আয়ের হিসাব প্রকাশিত হলেই অনেকে মজা করে বলেন, আমার টাকাটা কোথায়? প্রশ্নটা মজার, কিন্তু একেবারে অমূলক নয়। মাথাপিছু আয় যেটা আমরা দেখি সেটা হলো গড় আয়। দেশের মোট আয়কে মোট জনসংখ্যা দিয়ে ভাগ করলে মাথাপিছু গড় আয় পাওয়া যায়। এখন সমস্যা হলো এই বাংলাদেশে কারো মাথাপিছু আয় কোটির ঘরে, কারো হাজারের। তাই মাথাপিছু আয় বাড়লেও যাদের বাৎসরিক আয় হাজারের ঘরে, তাদের কিছু যায় আসে না। মাথাপিছু আয় বাড়লে সামগ্রিকভাবে দেশের জন্য তা মর্যাদার। কিন্তু করোনায় যারা চাকরি হারিয়েছেন, যাদের ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যারা দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছেন; মাথাপিছু আয়ে তাতে আসলে কিছু যায় আসে না। এখনও দেশের অনেক মানুষের নুন আনতে পান্তা ফুরায়। মাথাপিছু আয় অনেকের কাছে তাই শুভংকরের ফাঁকি।
সমস্যা হলো, মাথাপিছু আয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বাজারদর। তাই মাথাপিছু আয়ের লাভের গুড় পিঁপড়ায় খেয়ে নেয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মূল্যস্ফীতি ঘটে। তাই জিনিসপত্রের দামও বাড়ে। টাকায় আট মণ চাল পাওয়ার শায়েস্তা খাঁর আমলে মানুষের আয়ও তো কম ছিল। তবে বাস্তবতা হলো, দ্রব্যমূল্যের বোঝা মানুষের কাঁধে এমনভাবে চেপে বসেছে, তা বহন করার সাধ্য অনেকের নেই।
মুক্তবাজার অর্থনীতিতে দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়ার লাগামটা সবসময় সরকারের হাতে থাকে না। তবে সরকারের কিছু কিছু সিদ্ধান্ত, জিনিসপত্রের দামের আগুনে ঘি ঢালে। কয়েকদিন আগে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর পর একদফা জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যায়। আর বাংলাদেশে একবার কোনো কিছুর দাম বাড়লে সেটা আর কমে না। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়ে যাওয়ার দোহাই দিয়ে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলে কি দেশে দাম কমানো হবে? আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি হবে না। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার একটা চক্রবৃদ্ধি প্রভাব আছে।
জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে পরিবহন ব্যয় বাড়ে। তাতে বেড়ে যায় সব কিছুর দামই। এবারের শীতে সবজির দাম গত কয়েক বছরের তুলনায় অনেক বেশি। কিন্তু আপনি ঢাকায় যে ফুলকপিটি ৫০ টাকায় কিনছেন, কৃষক যদি সেটির জন্য ৩০ টাকাও পেত, তাহলে না হয় সান্ত্বনা মিলত, গরিব কৃষক তো পাচ্ছে। কিন্তু সেই কৃষক হয়তো ১০ টাকা পায়। সবকিছুর দাম নিয়ে সাধারণ মানুষের মাথাব্যথা নেই। স্বর্ণের দাম বাড়ল না কমল বা ঘিয়ের বাজার চড়া কি না; তা নিয়ে সাধারণ মানুষের কিছু যায় আসে না। মোটা দাগে চাল-ডাল, আটা-তেল, পিঁয়াজ-সবজি, মাছ- এটুকু সহনীয় থাকলেই মানুষ একটি স্বস্তির নিঃস্বাস ফেলতে পারে। অন্তত এই কটি পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারের ভূমিকা রাখা জরুরি। প্রয়োজনের সময় আমদানি বাড়িয়ে, কর কাঠামো পুনর্বিন্যাস করে হলেও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম সহনীয় মাত্রায় রাখা জরুরি। কিন্তু সেটা সবসময় সরকারের মনে থাকে না।
পিঁয়াজের দাম বেড়ে গেলে আমদানি বা কর কমানোর উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু সেই আমদানি করা পিঁয়াজ দেশে আসতে আসতে সমস্যা মিটে যায়। তাই সরকারের নীতিনির্ধারকদের বাজারের দিকে কড়া নজর রাখতে হবে। আগে থেকেই সমস্যা আন্দাজ করে ব্যবস্থা নিতে হবে। কয়েকদিন আগেই বাড়ানো হয়েছে সয়াবিন তেলের দাম। বেড়েছে গ্যাসের দাম, বাড়ছে পানির দাম। অল্প অল্প করে প্রতি খাতের বাড়তি ব্যয় সাধারণ মানুষের জন্য বিশাল বোঝা হয়ে যায়। ‘বোঝার উপর শাকের আঁটি’ বওয়ার সাধ্যও আর নেই কারো। দিন দিন বাড়ছে টিসিবির ট্রাকের পেছনে মানুষের লাইন। নিম্ন মধ্যবিত্ত, এমনকি মধ্যবিত্তরাও চক্ষুলজ্জা ভুলে টিসিবির ট্রাকে লাইন দিচ্ছে।
এপ্রিলে শুরু হচ্ছে রমজান। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, রমজান এলেই চিনি, খেজুর, ছোলা, তেলের মতো কিছু পণ্যের দাম বেড়ে যাবে। সরকার যদি আগে থেকেই ব্যবস্থা নেয়, রমজানের বাড়তি চাহিদা বিবেচনা করে আমদানি বাড়িয়ে সরবরাহ ঠিক রাখে; তাহলে হয়তো পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। রমজান কবে হবে, এটা তো একবছর আগেই সবার জানা। কিন্তু সহজে সম্ভব কাজটিও সময়মতো করা হয়ে ওঠে না। তাই রমজান এলেই বাজারের পাগলা ঘোড়া আরও জোরসে ছোটে।
মাথাপিছু আয় বাড়ে, দ্রব্যমূল্য বাড়ে, মূদ্রাস্ফীতি বাড়ে। কিন্তু এই দেশে মানুষের দামই শুধু কমে। এখানেও বাজারের সেই নিয়মই খাটে। সরবরাহ বাড়লে দাম কম থাকে। বাংলাদেশে যেহেতু মানুষের সরবরাহ বেশি, তাই মানুষের জীবনের দাম কম। কখনো লঞ্চ ডুবে, কখনো আগুন লেগে মানুষ মারা যায়। আর বাংলাদেশের সড়ক তো যেন মৃত্যুফাঁদ। প্রতিদিনই সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষের মৃত্যুর খবর আসে। সব খবর আমাদের আমাদের আর স্পর্শও করে না।
কক্সবাজারের চকোরিয়ার সড়ক দুর্ঘটনা গোটা জাতিকে বেদনার্ত করেছে। সুরেশচন্দ্র শীলের মৃত্যুর খবরে দেশ-বিদেশে থাকা তার ৯ সন্তান গ্রামে একত্রিত হয়েছিলেন। গত ৮ ফেব্রুয়ারি বাবার শ্রাদ্ধের ধর্মীয় আচার শেষে স্থানীয় একটি মন্দির থেকে বাড়ি ফিরছিলেন ৯ ভাইবোন। দ্রুতগামী একটি পিকআপ ভ্যানের ধাক্কায় মারা যান পাঁচ ভাই। অপর দুই ভাই এবং এক বোনও মারাত্মক আহত হয়েছেন। আহতদের মধ্যে রক্তিম শীল লড়ছেন মৃত্যুর সঙ্গে। বাবার শ্রাদ্ধের জন্য বানানো মঞ্চে পাঁচ ভাইয়ের সারিবাঁধা লাশ গোটা জাতিকে কাঁদিয়েছে। স্বামীর শোক শেষ হতে না হতেই পাঁচ সন্তানের শোকে স্তব্ধ হয়ে গেছেন সুরেশচন্দ্র শীলের স্ত্রী মনু রানী। তবে শোক করার সময়ও নেই তার। আকুতি আহত সন্তানদের সুস্থতার জন্য।
মনু রানীর আহাজারি আর পাঁচ বিধবার সাদা শাড়ি আমাদের অপরাধী করে দেয়। র্যাব ঘাতক চালককে গ্রেপ্তার করেছে। সেই চালকের লাইসেন্স ছিল না, পিকআপের ফিটনেস ছিল না। অথচ ফিটনেস ছাড়া কোনো গাড়ি যাতে রাস্তায় নামতে না পারে, লাইসেন্স ছাড়া কেউ যাতে গাড়ি চালাতে না পারে; তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের। সরকার তার দায়িত্ব পালন করে না বলেই ঘরে ঘরে কান্নার রোল। মনু রানীর যে শোকের ভার তা আমাদের অপরাধী করে দেয়।
সরকারের কাছে তো আমাদের চাওয়া খুব বেশি নয়- দুবেলা দুমুঠো খাওয়া আর স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি। চাওয়াটা কি খুব বেশি?
লেখক: সাংবাদিক, কলাম লেখক