বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

করোনা: দুঃসময়ে শঙ্কিতভাবনা

  • নাসির আহমেদ   
  • ৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ১২:২৯

বর্তমান ওমিক্রন পরিস্থিতির ভয়াবহতা রোধে সবচেয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারত ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীসহ দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোর বিভিন্ন পর্যায়ের শাখাসমূহ এবং রাজনৈতিক দলগুলোর লাখ লাখ কর্মী। সরকারিভাবে পুলিশ প্রশাসন, জেলা- উপজেলা, গ্রাম ইউনিয়ন শহর তৃণমূল প্রশাসন যদি সক্রিয় থাকে এবং একই সঙ্গে যদি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মী নিজ নিজ উদ্যোগে নিজের এলাকায় জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ওমিক্রনের ভয়াবহতার কথা জানায় এবং মাস্ক বিতরণ শুরু করে, তাহলে বিশাল সুফল মিলবে।

করোনার ছোবলে বিপর্যস্ত বিশ্ববাস্তবতার নিরিখে বিবেচনা করলে আমরা মোটামুটি সহনীয় মাত্রার সংকটেই ছিলাম। যদিও গত দুই বছরে আমাদের জীবনধারা বদলে গেছে। অনেক স্বজন-প্রিয়জনকে হারিয়েছি আমরা। অসংখ্য মানুষ কর্মহীন হয়েছেন, দেশে বেকারত্বের সীমানা বেড়েছে। শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সরকারকেও বহু অর্থব্যয় করতে হয়েছে করোনায় ক্ষতিগ্রস্তদের ত্রাণ, পুনর্বাসন, অনুদান এবং প্রণোদনা জোগাতে। গত কয়েক মাস করোনার সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার কমে আসার ফলে জীবনের স্বাভাবিক ছন্দ প্রায় ফিরতে শুরু করেছিল। গার্মেন্ট পণ্যের উৎপাদন এবং রপ্তানি হার আশাব্যঞ্জক অবস্থানে পৌঁছাচ্ছিল।

করোনায় কর্মহীন হয়ে পড়া অনেক মানুষ বিভিন্ন বিকল্প পথে জীবিকার চেষ্টায় ব্রতী হয়েছেন। কেউ কেউ হৃত সাফল্য ফিরে পেয়েছেন। উন্নত বিশ্বের বিভিন্ন দেশ যেভাবে সংক্রমণ, মৃত্যু আর অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তার তুলনায় বাংলাদেশের করোনাজনিত ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা অনেক কম। এককথায় বলা যায়, কয়েক মাসের ব্যাপক দুর্যোগের কথা বাদ দিলে মোটামুটি সহনীয় মাত্রারই ছিল করোনাসৃষ্ট সংকট। কিন্তু সেই স্বস্তি হঠাৎ করে কেড়ে নিল নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রনের তাণ্ডব।

করোনা থেকে নিজে বাঁচা এবং অন্যকে নিরাপদে রাখার ক্ষেত্রে আমাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের যে অসচেতনতা আর উদাসীনতা দেখিয়েছে, তাতে বর্তমান পরিস্থিতি ভয়ংকর উদ্বেগজনক। বর্তমানে সংক্রমণ এবং মৃত্যুহার যেভাবে বাড়ছে তাতে যদি এখনই ব্যাপক জনসচেতনতা এবং স্বাস্থ্যবিধি সর্বস্তরে কার্যকর করা না যায়, তা হলে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসবে, যা সামাল দেয়া কারো পক্ষেই সম্ভব হবে না। আমরা আমেরিকায় মৃত্যুর মচ্ছব দেখেছি গণমাধ্যমে, সেই ভয়ংকর অবস্থাকে ছাড়িয়ে যেতে পারে বর্তমান ওমিক্রন- সুনামি।

করোনা পরিস্থিতি যে এ মুহূর্তে কত ভয়াবহ, তার একটি চিত্র সামান্য পরিসংখ্যান থেকে যে কেউ অনুমান করতে পারবেন।

গতবছর সংক্রমণ এবং মৃত্যুহার বেড়ে গিয়েছিল জুন-জুলাই-আগস্ট জুড়েই। সংক্রমণ আর মৃত্যুহার আশঙ্কাজনক পর্যায়ে পৌঁছেছিল, যাকে বলে চরম অবস্থা। প্রতি চারজনে একজনের বেশি মানুষের সংক্রমণ ধরা পড়ছিল। মৃত্যুহারও ছিল উদ্বেগজনক।

সৌভাগ্যই বলতে হবে- আগস্টের শেষ সপ্তাহ থেকে সংক্রমণ এবং মৃত্যুহার দ্রুত কমতে থাকায় জনজীবনে ফিরে এসেছিল স্বস্তি। যেখানে সংক্রমণ ছিল শতকরা ২৬-২৭জন, মৃত্যুর হার শতকরা ৮-৯জন, সেখানে সংক্রমণ শতকরা একজনে নেমে এসেছিল। কোনো কোনোদিন মৃত্যুশূন্য পরিসংখ্যানও প্রত্যক্ষ করেছি আমরা। কিন্তু সেপ্টেম্বর থেকে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত স্বস্তিকর অবস্থায় থাকলেও হঠাৎ আসা ওমিক্রন কী ভয়াবহ বিপর্যয় নিয়ে এসেছে!

নতুন বছরের প্রথম দিনে সারা দেশে পরীক্ষায় করোনা পজিটিভ হয়েছিলেন ৩৭০জন। মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে ৭ জানুয়ারি সংক্রমণ ধরা পড়ে ১১৪৬ জনের! অবিশ্বাস্য হলেও সত্য -সেই সংখ্যা সাত দিনের ব্যবধানে ২১ জানুয়ারি ১১গুণ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ১২ হাজার ৪৩৪ জনে! তাহলে কোথায় চলেছি আমরা? ২০২০ খ্রিস্টাব্দের মার্চ থেকে এ পর্যন্ত সবচেয়ে ভয়াবহ সময় যাপন করছে বাংলাদেশ এখনও!

যে সীমিত সংখ্যক মানুষের করোনা টেস্ট হচ্ছে তারও প্রতি তিনজনের একজন পজিটিভ পাওয়া গেছে। যে হারে সংক্রমণ এবং মৃত্যু বাড়ছে, তাতে আতঙ্কিত না হয়ে উপায় নেই। কিন্তু সমাধান তো আতঙ্কে মিলবে না। সমাধানের জন্য চাই করোনা সংক্রমণ রোধে সর্বাত্মক কার্যক্রম। বিশেষ করে স্বাস্থ্যবিধি পালন নিশ্চিত করা না গেলে এই বিপর্যয় রোধ করা অসম্ভব।

সংবাদপত্রসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের সর্বশেষ যে শঙ্কা প্রকাশ পেয়েছে, তাতে হাসপাতালগুলো রোগী সামাল দিতে পারবে কি না সন্দেহ। কোনো কোনো সংবাদপত্র শিরোনাম করেছে ‘হাসপাতালের শয্যা নিয়ে হাহাকারের আশঙ্কা’!

অবস্থা যখন এমন ভয়াবহ, তখন সমাজের চারদিকে তাকিয়ে দেখুন অবস্থাটা কী! শতকরা ৮০ ভাগের বেশি মানুষ মাস্ক ব্যবহার করছে না। স্বাস্থ্যবিধি মানার ব্যাপারে অধিকাংশ মানুষ চরম উদাসীন। বিশেষ করে গণপরিবহন হাটবাজারসহ জনসমাগমস্থলে স্বাস্থ্যবিধি না মেনে চলা কত বড় বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে তা গত বছরের দুটি ঈদের ছুটিতে আমরা দেখেছি ফেরি পারাপার এবং লঞ্চ-বাস ট্রেনে। তারই ভয়ংকর ফল ফলেছিল জুন-জুলাই-আগস্টে।

এখনকার অবস্থা সে সময়ের চেয়ে ভয়াবহ। এত সংক্রমণ হার তখনও ছিল না। এ অবস্থায় সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল সারা দেশে একযোগে গণটিকা কর্মসূচি চালু করা। যত বেশি সংখ্যক লোককে টেস্টের আওতায় নিয়ে এসে শনাক্তদের আইসোলেটেড করা যায়, ততই মঙ্গল। মাস্ক পরা এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা তথা শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখাটা বাধ্যতামূলক এবং নিশ্চিত করা এখন অগ্রাধিকার কর্মসূচি হওয়া প্রয়োজন।

সমস্যাটা সমাধান যত সহজে বলা গেল বাস্তবায়ন তত সহজ নয়। সে ক্ষেত্রে সরকারি উদ্যোগ তথা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সারা দেশে আরও ব্যাপকভাবে সক্রিয় করে তোলার পাশাপাশি প্রয়োজন বিভিন্ন এনজিও, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, সাংস্কৃতিক সংগঠন, পাড়া-মহল্লার ক্লাবসহ সবার সম্মিলিত প্রয়াস। একদিকে মানুষকে সচেতন করা অন্যদিকে স্বাস্থ্যবিধি মানতে বাধ্য করা।

বর্তমান ওমিক্রন পরিস্থিতির ভয়াবহতা রোধে সবচেয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারত ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীসহ দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোর বিভিন্ন পর্যায়ের শাখাসমূহ এবং রাজনৈতিক দলগুলোর লাখ লাখ কর্মী। সরকারিভাবে পুলিশ প্রশাসন, জেলা- উপজেলা, গ্রাম ইউনিয়ন শহর তৃণমূল প্রশাসন যদি সক্রিয় থাকে এবং একই সঙ্গে যদি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মী নিজ নিজ উদ্যোগে নিজের এলাকায় জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ওমিক্রনের ভয়াবহতার কথা জানায় এবং মাস্ক বিতরণ শুরু করে, তাহলে বিশাল সুফল মিলবে। রাজনৈতিক দলগুলোর ছাত্র, যুব ও পেশাজীবী সংগঠনসহ যদি নিজ এলাকায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করে তাহলে এই বিপর্যয় রোধে অনেক বড় শক্তি হয়ে উঠতে পারে।

বিশেষ করে গণপরিবহন, হাট-বাজার,পার্ক, বাসস্ট্যান্ড, লঞ্চঘাট, ফেরি, বিনোদন কেন্দ্রসহ জনসমাবেশ ঘটে এমন জায়গাগুলোতে মাস্ক ছাড়া কোনো মানুষকে গ্রহণ না করার মতো কঠোর কর্মসূচিও এভাবে সম্মিলিত উদ্যোগ নিলে কার্যকর করা সম্ভব।

করোনা পরিস্থিতির যে ভয়াবহ বিস্তার লক্ষণীয় হয়ে উঠেছে তাতে হাসপাতালগুলোকেও অতীতের চেয়ে তিন চারগুণ বেশি সংখ্যক রোগীর চিকিৎসা দেয়ার মতো সক্ষমতায় যেতে হবে। একইসঙ্গে বিভাগীয় শহরের বাইরের বিশেষ করে জেলা-উপজেলা, এমনকি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোকে করোনার চিকিৎসার উপযোগী করা যায় কি না ভাবতে হবে। এজন্য জরুরি কর্মসূচি গ্রহণ অনিবার্য হয়ে উঠেছে। শুধু স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয় নয়, সমাজের সর্বস্তরের অংশগ্রহণে জরুরি ভিত্তিতে জনমত নিয়ে আসা করণীয় নির্ধারণ করা প্রয়োজন।

লেখক: কবি ও সিনিয়র সাংবাদিক। সাবেক পরিচালক (বার্তা) বাংলাদেশ টেলিভিশন।

এ বিভাগের আরো খবর