বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

আত্মহত্যা কতটা রোগ, কতটা লক্ষণ

  • ইকরাম কবীর   
  • ৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ২২:০০

বিশ্বজুড়ে বছরে ৮ থেকে ১০ লাখ মানুষ আত্মহত্যা করছেন। বাংলাদেশে এ হার ১১ থেকে সাড়ে ১৪ হাজার। বেশির ভাগই ঘটে মানসিক সমস্যা তৈরি হলে। তাহলে আমরা এ বিষয়ে কিছু করছি না কেন? আসলে আমরা ভাবিই না যে কিছু একটা করা যেতে পারে আত্মহত্যার সংখ্যা কমাতে। কেউ কি এ নিয়ে গবেষণা করছেন? করলেও তা নিয়ে সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কি কোনো কাজ হচ্ছে?

আমাদের মানসিক শক্তি কোথা থেকে আসে? ধরে নিলাম পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে, বন্ধুদের কাছ থেকে, কর্মস্থল থেকে, সমাজ থেকে এবং রাষ্ট্রের কাছ থেকে। এই শক্তির উৎসগুলো যদি বৎসল না হয় নিজস্ব শক্তি তৈরি হতে অনেক সময় লেগে যেতে পারে। অনেকেই হয়তো সারা জীবনেও সেই শক্তি অর্জন করতে পারে না।

যারা মানসিকভাবে দুর্বল, তাদের দুর্বলতার উৎস কী, কারা বা কোথায়? মানসিকভাবে ঘায়েল করল তার পারিপার্শ্বিকতা এবং সেই সমাজই তার দিকে আঙ্গুল তাক করে ভর্ৎসনা করে।

কয়েকদিন আগে মহসিন নামে এক ব্যক্তি সামাজিক মাধ্যমে তার কষ্টের কথা সরাসরি সম্প্রচার করার পর নিজের পিস্তলের গুলির মাধ্যমে মৃত্যুবরণ করেন। প্রায় সব কাগজেই খবর হয়েছে। বেশ ক’জন সাইকোলজিস্ট আত্মহত্যা বিষয়ে তাদের মতামত দিয়েছেন। গণমাধ্যমে মানসিক রোগের কথা উঠে এসেছে। অনেক পড়াশোনা জানা মানুষও বলেছেন আত্মহত্যা মানসিক রোগের কারণেই হয়।

এ বিষয়ে তেমন দ্বিমত নেই। বিদেশে অনেক গবেষণায় পাওয়া গেছে ৯০ ভাগ আত্মহত্যাকারীর কোনো না কোনো জানা বা অজানা মানসিক রোগ থাকে, যেগুলোর ‘একটি’ উপসর্গ হচ্ছে ‘আত্মহত্যার প্রবণতা’।

তবে মানসিক রোগ শেষ কথা নাও হতে পারে। আমার বন্ধু ব্যবসা প্রশাসন বিষয়ক অধ্যাপক কাজী আহমদ পারভেজ এ বিষয়ে কিছুটা গবেষণা করেছেন; তার ফেসবুকের একটি লেখা থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছি: ‘মনে রাখা দরকার, আত্মহত্যার প্রবণতা নিজে কোনো রোগ নয়, কিন্তু এটা - বাইপোলার ডিজঅর্ডার, স্কিৎজোফ্রেনিয়া, ডিপ্রেসিভ ডিজঅর্ডার, অ্যাংজাইটি ডিজঅর্ডার ইত্যাদি মানসিক রোগাক্রান্তদের অসুস্থতাকালীন একটি লক্ষণ।’

তিনি আরও জানাচ্ছেন: “মোট আত্মহত্যাকারীদের ৯০ শতাংশের ক্ষেত্রেই যেটিকে আমরা ‘আত্মহত্যার কারণ’ হিসাবে ভাবছি, সেটা আসলে আত্মহত্যার ট্রিগার, কারণ নয়। আত্মহত্যার আসল কারণ হলো তাদের আত্মহত্যার প্রবণতা যা তাদের মানসিক অসুস্থতার অনেক লক্ষণের একটি।"

এবার একটু অন্য দৃষ্টিতে দেখি। একটা ঘটনার কথা মনে পড়ছে। পড়েছিলাম ইতিহাসবিদ আফসান চৌধুরীর লেখায়। গল্পটি বলি।

মুক্তিযুদ্ধের সময় বেশ ক’জন মানুষ পালাচ্ছেন। না হলে পাকিস্তানি সৈন্যরা তাদের মেরে ফেলবে। একটা নদী পার হতে হবে, কিন্তু নৌকো নেই। আছে কচুরিপানা। পানা জড়ো করে ভেলা বানিয়ে পার হচ্ছেন। পানা এতো মানুষের ভার আর নিতে পারছে না। একজন নারী অন্য সবাইকে বাঁচানোর জন্য ভেলা ছেড়ে দিয়ে নিজে নদীর বুকে তলিয়ে গেলেন।

মেয়েটি কি আত্মহত্যা করলেন, নাকি আত্মত্যাগ করলেন? হয়তো সবাই বলবেন আত্মত্যাগ। কেন? তিনি তো নিজের জীবনের ইতি টানলেন। স্বেচ্ছায় নিজেকে মেরে ফেললেন। কিন্তু আমরা তা বলব না। তার মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আমাদের কোনো সন্দেহ নেই। সৈন্যরা যারা যুদ্ধ করতে যান, তারাও আত্মত্যাগ করেন, আত্মহত্যা নয়।

এভাবেই কি আমরা আত্মহত্যাকে মহিমান্বিত করি? বন্দুকের গুলিতে মৃত্যু হবে জেনেও যারা ঐ পেশায় নাম লেখান, তাদের মৃত্যুতে মহিমা আছে, লজ্জা নেই। শুধু মহসিনের মতো মানুষদের নামগুলো আমরা লজ্জায় আবৃত করে দেই।

আত্মহত্যার সহজ অর্থ হচ্ছে নিজের জীবনের ইতি টানা। নিজের দুঃখ-কষ্টের বোঝা আর বইতে না পেরে পার্থিব জীবন থেকে প্রস্থান। আমরা বলি – আহারে! ওর অনেক মানসিক সমস্যা ছিল।

ছিল। অবশ্যই ছিল। যার মানস আছে, তারই মানসিক সমস্যা তৈরি হয়। এক-একজন মানুষের মানস যেমন জনপ্রতি অনন্য, একজনের সাথে আরেক জনের মিল নেই, তেমনি তাদের মানসিক সমস্যাগুলোও অনন্য – জনে জনে ভিন্ন।

বিশ্বজুড়ে বছরে ৮ থেকে ১০ লাখ মানুষ আত্মহত্যা করছেন। বাংলাদেশে এ হার ১১ থেকে সাড়ে ১৪ হাজার। হ্যাঁ, বেশির ভাগই ঘটে মানসিক সমস্যা তৈরি হলে। তাহলে আমরা এ বিষয়ে কিছু করছি না কেন? আসলে আমরা ভাবিই না যে কিছু একটা করা যেতে পারে আত্মহত্যার সংখ্যা কমাতে। বাংলাদেশের সমাজ মানসিক বিষয় এবং আত্মহত্যা নিয়ে কতটা উদ্বিগ্ন, তা চারিদিকে তাকালেই বোঝা যায়। কেউ কি গবেষণা করছেন? করলেও তা নিয়ে সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কি কোনো কাজ হচ্ছে?

বাংলাদেশের সমাজ মানসিক পরিণতিগুলো নিয়ে হাসাহাসি করে। আমরা (তথাকথিত স্বাভাবিক লোকেরা) একে অন্যকে ‘পাগল’ (হালে শব্দটি ‘ক্রেইজি’) বলতে অভ্যস্ত। মানসিক দুর্দশাগ্রস্ত ব্যক্তির পাশে দাঁড়ানোর মতো শিক্ষা আমাদের দেয়া হয় না। দৃশ্যত স্বাভাবিক মানুষগুলো নিজেরা কতটুকু স্বাভাবিক তা উপলব্ধির শিক্ষাও আমরা পাই না। আসলে স্বাভাবিক এবং অস্বাভাবিকের সত্যিকার কোনো স্থিতিমাপ নেই। যা আছে, তা আমরা তৈরি করি একে অন্যকে শ্রেণিগতভাবে দূরে সরিয়ে রাখার জন্য।

মুক্তিযুদ্ধের সময় ওই ভেলায় আর যারা ছিলেন, তাদের মানস নিয়ে সন্দেহ জাগে না? সৈন্যদের যারা যুদ্ধের পাঠাচ্ছেন, তাদের মানসিক পরিস্থিতি নিয়ে চিন্তা হয় না? অর্থের উন্মাদনাকে একটা বিশেষ মানসিক দুরবস্থা বলে মনে হয় না? আমাদের সন্তানদের একটা অসুস্থ প্রতিযোগিতায় ঠেলে দেয়া আমাদের কোন মানসিক স্বাভাবিকতা?

আরেকটি ঘটনা বলি। কয়েকদিন আগে চাঁদপুরে হাসপাতালের বিল দিতে না পেরে নিজের সদ্যজাত শিশুকে পঞ্চাশ হাজার টাকায় বিক্রি করে দিয়েছিলেন এক মা। এই মা কি মানসিক রোগী? নাকি যে শিশুটিকে কিনল সে? নাকি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ?

এক গবেষণায় দেখলাম আমাদের বর্তমান জীবনযাত্রা বজায় থাকলে আত্মহত্যা একেবারে নির্মূল করা সম্ভব নয়। তার কারণ হচ্ছে আমাদের তৈরি করা সমাজের বিধি, নিষেধ, ব্যবস্থা, প্রতিযোগিতা – এসব কারণেই মানসিক পরিণতিগুলোর জন্ম হচ্ছে। চাহিদা বাড়ছে, লোভ- লালসা বাড়ছে, আক্রমণ বাড়ছে, বিশ্বাসহীনতা বাড়ছে, বিচ্ছিন্নতা বাড়ছে এবং সেই সাথে গভীর একাকীত্ব বাড়ছে।

মহসিন সাহেবের কথা থেকেই বোঝা যায়, তিনি বিশ্বাস করে ঠকেছিলেন। তার নিজের মাতাপিতাও তাকে প্রতারিত করেছেন বলে দাবি করেছেন। এ গল্প মহসিন সাহেবের একার নয়; কোটি কোটি মানুষ এ দেশে প্রতিনিয়তই বিশ্বাসভঙ্গের শিকার হচ্ছেন। আরেকজন মানুষকে এমন ঠকানোর প্রবণতা 'আমিই সব খাব' মানসিকতা থেকে আসে। যারা সব খেয়ে ফেলেন, তাদের আমরা স্বাভাবিক মনে করব এবং যারা আত্মহত্যা করেন বা করার কথা ভাবেন, তাদের আমরা মানসিক রোগী বলে ডাকব। এই বাস্তবতাতেই আমরা এখন বসবাস করছি, যা আমাদেরই তৈরি।

অনেকে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন তবে নিজেকে মেরে ফেলা তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। চিন্তা করুন যিনি নিজেকে খুন করতে গিয়ে বেঁচে গেলেন, এই ঘটনার পর, সমাজ তাকে কোন দৃষ্টিতে দেখবে? এখানেই আমাদের আসল দশা। আমরা তাকে কষাঘাত করব। আইনের কথা বলব, ধর্মের কথা বলব, কিন্তু সেই মানুষটির মনের আশা পূরণ করতে পারব না। তবে স্বাভাবিকতার বড়াই করব।

নিঃস্ব হয়ে যাওয়ার পর, মহসিন সাহেব নিজেও অনেক ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি নিজের দুঃখ-কষ্ট ছাড়া আর কারও কষ্টের কথা ভাবছিলেন না। ‘অন্য’ বলতে বোঝাতে চাইছি তিনি যদি একবার, একরাতে সময় করে ঢাকা শহরের ফুটপাথগুলো ঘুরে দেখতে পারতেন, সেখানে যেই মানুষগুলো দিনের পর দিন রাত্রিযাপন করেন, তাদের সঙ্গে কথা বলতে পারতেন, তাহলে তার মস্তিষ্কে ডোপামিন এবং সেরাটোনিনের একটা ভারসাম্য থাকার সম্ভাবনা ছিল।

হ্যাঁ, আমাদের শরীরে, বিশেষ করে মস্তিষ্কে, রাসায়নিকের আনাগোনা আমাদের শারীরিক এবং মানসিক ভারসাম্যের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। রাসায়নিকের আনাগোনা নির্ভর করে প্রতি মুহূর্তের অভিজ্ঞতা ও আমাদের মন সেই অভিজ্ঞতাকে কীভাবে গ্রহণ করছে, তার ওপর। মনের কথা যদি ভাবি, তাহলে বলে রাখা ভালো, মস্তিষ্কই যে আমাদের মনকে পরিচালিত করে, তা এখনও আমরা হলফ করে জানতে পারিনি। তবে জানার চেষ্টা চলছে।

মহসিন সাহেব একা নন; আমাদের সবার মধ্যেই সমষ্টিগত মনোভাব এড়িয়ে কেমন করে ব্যক্তিকেন্দ্রিক হওয়া যায়, তার তোড়জোর চলছে। আমাদের অর্থ, প্রযুক্তি, স্থাপত্য – সবই নিজেকে অন্যদের থেকে দূরে রাখার গতি পেয়েছে।

আত্মহত্যাকারীর মনকে আমরা দুর্বল মন মনে করতে পারি, তবে জীবিতকালে তাদের মনে শক্তি যোগানোর দায়িত্বটি আমরা নিতে পারছি না। দায়িত্ব দূরে ঠেলে দিয়ে তাদের নিয়ে হাসাহাসি করলে আমাদের ডোপামিন-সেরাটনিন ভারসাম্য ঠিক থাকে। পরিস্থিতির কারণে পিছিয়ে পড়া মানুষকে আমরা ‘হারু-পাট্টি’ বলে ডাকি। কেউ হেরে গেলে আমাদের আনন্দ হয়। কেউ নিজেকে মেরে ফেললে আমাদের সেই আনন্দই হয়।

এ প্রসঙ্গে আলজেরীয়-ফরাসি লেখক আলব্যের কামুর একটা বইয়ের কথা মনে পড়ছে: দ্য মিথ অব সিসিফাস। সিসিফাস ছিলেন এক অতি-চালাক রাজা (দেবতাদের মতে)। মৃত্যুর পর যখন তার বিচার হচ্ছে, তখন তিনি দেবতাদের কাছে অনুরোধ করলেন তাকে আবার জীবিত করে দেয়ার জন্য। মর্ত্তে কিছু কাজ বাকি রয়ে গেছে। দেবতা য্যুস্‌ বিশ্বাস করে তাকে ফিরে যাওয়ার সুযোগ দেন। কিন্তু সিসিফাস আর ওপারে ফেরেন না। দেবতারা রেগে গিয়ে এবার তাকে মস্ত শাস্তি দেন। পাতাল থেকে একটা বিরাট আকারের পাথর ঠেলে উপরে ওঠাতে হবে এবং ঢাল বিয়ে সেটা পাহাড়ের চূড়ায় তুলতে হবে। রাজা সিসিফাস শাস্তি পালন করতে গিয়ে বুঝতে পারেন এই বড় পাথর পাহাড়ের চূড়ায় তোলা অনেক কষ্টের। তিনি নিজের ভেতরের শক্তির দিয়ে পাথরের দিকে তাকালেন। বুঝলেন ওই পাথরের চেয়ে তাকে আরও বেশি শক্তিশালী হতে হবে। তিনি পাথর পাহাড়ে তোলেন এবং সেখান থেকে ছেড়ে দেন পাতালে গড়িয়ে পড়ার জন্যে। তিনি নিজে যখন পাহাড় থেকে নেমে সমতলে আসেন, তখন বুঝতে পারেন, সমতলে বসে তাকে শক্তি সঞ্চয় করতে হবে।

সিসিফাস নিজের শক্তি নিজেই সঞ্চয় করতে পারছেন, কিন্তু সবার পক্ষে তা সম্ভব হয় না। সাহায্যের প্রয়োজন হয় এবং আমরা সেই সাহায্যের হাতে পরিণত নই। দ্য মিথ অব সিসিফাস পড়লে বোঝা যায় আত্মহত্যা হচ্ছে একটি সাময়িক সমস্যার স্থায়ী সমাধান। আত্মহত্যা কোনো চূড়ান্ত সমাধান হতে পারে না এবং এই কথাটিই যেন আমরা সবাইকে বোঝাতে পারি সেই লক্ষ্যেই কাজ করা উচিৎ বলেই মনে করি।

মানসিক শক্তির যোগান বাড়াতে হবে।

ইকরাম কবীরঃ গল্পকার, যোগী ও যোগাযোগ পেশায় নিয়জিত।

এ বিভাগের আরো খবর