বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

ইউপি নির্বাচন আওয়ামী লীগকে কতটা শক্তিশালী করবে

  •    
  • ৩০ জানুয়ারি, ২০২২ ১৮:৫৩

আওয়ামী লীগ দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার কারণে অনেক কিছুই বদলে গেছে। অনেকেরই এখন বিত্তবৈভবও গ্রামে কিংবা শহরে পর্যাপ্ত হয়েছে। তারাই একদিকে ক্ষমতা, অন্যদিকে ভোগবিলাসী জীবনযাপন করতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন। এদের তৃণমূলে যাওয়া এত দরকার কেন?

সাত পর্বের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন শেষ হবে আগামী ৭ ফেব্রুয়ারি। ৩১ জানুয়ারি ষষ্ঠ ধাপের ভোটাভুটি। নির্বাচন কমিশনের মেয়াদও ১৪ ফেব্রুয়ারি শেষ হচ্ছে। ইউপি নির্বাচনের আগামী দুই পর্বের ভোটাভুটি শেষ করে নির্বাচন কমিশনও বিদায় নিতে যাচ্ছে।

এ নির্বাচনের যে পাঁচটি পর্ব শেষ হয়েছে, তার অভিজ্ঞতা খুব সুখকর নয়। হানাহানি, দ্বন্দ্ব-সংঘাত ইউপি নির্বাচনের অনুষঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্ষমতার তৃণমূলে ইউপি সবচাইতে বিস্তৃত সংস্থা। মেম্বার চেয়ারম্যানদের নানা ধরনের প্রভাব সমাজের ওপর বিস্তার করার সুযোগ দীর্ঘদিন থেকেই সবাই উপলব্ধি করে আসছে। রাজনৈতিক দলগুলো তাই ইউনিয়ন পরিষদে নিজেদের প্রভাব বিস্তারের জন্য মরিয়া হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে থাকে। যে দলের মুঠোয় ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার চেয়ারম্যানরা থাকবেন, সেই দলের প্রভাব ও কর্তৃত্ব রাজনীতিসহ সর্বত্র পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে দলগুলো মনে করে থাকে। বর্তমানে এই সংস্থার অধীনে গ্রাম পর্যায়ে অসংখ্য কাজের ক্ষেত্র ন্যস্ত হওয়ায় সুযোগ সুবিধা নেওয়া ও পাওয়ার অবস্থান থেকেই দলগুলো পরিষদের ক্ষমতা হাতছাড়া করতে চায় না। তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা তাই এই নির্বাচনে সর্বশক্তি নিয়ে নামার চেষ্টা করে থাকে। তা থেকে মনোনয়ন লাভ নিয়েই শুরু হয় দলের অভ্যন্তরে দ্বন্দ্ব, বিরোধ, এমনকি হানাহানি, মারামারিও। প্রতিদ্বন্দ্বী দলের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় যতোটা না বেশি শক্তি ব্যয় করতে হয়, তার চাইতে বেশি বোধ হয় দলগুলোর অভ্যন্তরেই ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়া না হওয়ার বিষয়গুলো চাঙ্গা হয়ে ওঠে। ফলে প্রতিটি ভোটাভুটিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতার চাইতে চতুর্মুখী প্রভাব, দ্বন্দ্ব-সংঘাত, হানাহানি, মারামারি বিস্ফোরণমুখ থাকে। সেটির বহিঃপ্রকাশও অনেক ক্ষেত্রেই ঘটে । তা থেকেই দলের অভ্যন্তরে একে অপরের বিরুদ্ধে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী দলীয় নাকি বিরোধী পক্ষের তা বিবেচ্য থাকে না । মুখ্য হয়ে ওঠে যার যার জয়কে নিশ্চিত করা। এই প্রবণতাগুলো এখন প্রায় সর্বত্রই ক্রিয়াশীল হয়ে উঠেছে। এর থেকে মুক্ত থাকতে পারেনি বর্তমান ইউপি নির্বাচনও। যদিও এই নির্বাচনে বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে অংশ না নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল। কিন্তু স্থানীয় পর্যায়ে বিএনপির বহু নেতা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছে, অনেকে জয়লাভও করেছে। অন্যান্য রাজনৈতিক দলেরও স্থানীয় পর্যায়ের কোনো কোনো নেতা অংশগ্রহণ করেছে, কেউ কেউ জয়লাভও করেছে। সে সংখ্যাটি খুব বেশি নয়। তবে এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ চেয়ারম্যান পদে দলীয় প্রতীকের অনুকূলে অনেক জায়গায় মনোনয়ন দিলেও কোনো কোনো জায়গায় প্রতীক বাদ দিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বীদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে সুযোগ করে দিয়েছে।

প্রধান বিরোধী দল বিএনপি দলগতভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অংশ না নিলেও স্থানীয় পর্যায়ের বিএনপি নেতাকর্মীদের নিবৃত্ত করা যায়নি। তারা নির্বাচন করেছেন, কোথাও কোথাও জয়লাভ করে এসেছেন। তবে আওয়ামী লীগে নেতাকর্মীরা সর্বত্র নির্বাচনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। সে কারণে বেশিরভাগ জায়গাতেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে আওয়ামী লীগ বনাম আওয়ামী লীগের মধ্যে। যেখানে বিরোধী দলের প্রার্থীরা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আসেনি, সেখানে চেয়ারম্যানসহ অনেক মেম্বার পদেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অনেকে নির্বাচিত হয়েছেন। তবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতার এই বিজয়ী চেয়ারম্যান মেম্বারগণ দলের প্রতিদ্বন্দ্বিচ্ছুদের মানসিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে নিজেদেরকে খুব বেশি মুক্ত রাখতে পেরেছেন বলে মনে হয় না। ভেতরে ভেতরে তাদের দ্বন্দ্ব ঠিকই তুশের আগুনের মতো জ্বলছে। ওপর থেকে প্রভাবশালী মন্ত্রী এমপিদের হিসাব-নিকাশে কোথাও কোথাও এমন চিত্র পরিদৃষ্ট হলেও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত চেয়ারম্যান মেম্বারগণও দলের প্রতিদ্বন্দ্বীদের কাছে খুব বেশি ভিড়তে পারছেন না। ফলে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক কিংবা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যারাই নির্বাচিত হয়েছেন, তাদের কতো শতাংশ এলাকায় রাজনৈতিকভাবে দলের শক্তি বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখতে পারবেন, তা নিয়ে নিশ্চিত হওয়া সম্ভব নয়। তাছাড়া দল থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, দলের মনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে যারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হবেন, তাদেরকে দল থেকে বহিষ্কার করা হবে। সেটি করা হয়েছেও। দেখা গেছে হয়তো ৫ পর্বের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীর চাইতে মনোনয়নবঞ্চিত, মনোনয়ন বিদ্রোহী প্রার্থীদের অনেকেই জয়লাভ করেছেন। কোথাও কোথাও মনোনীত প্রার্থী জামানত হারিয়ে পরাজিত হয়েছেন। এতে বোঝা যাচ্ছে, দলের মনোনীত প্রার্থীদের অনেকেই মনোনয়ন লাভে জনসমর্থনের চাইতে স্থানীয় নেতাদের কারো কারো বিশেষ আনুকূল্য পেয়েছিলেন।

ইউপি নির্বাচনে মনোনয়ন পাওয়া না পাওয়া নিয়ে নানা অভিযোগ রয়েছে। এইসব অভিযোগ খতিয়ে দেখা দলের জন্যই প্রয়োজন। দলের বৃহত্তর অংশকে যিনি স্থানীয় পর্যায়ে ঐক্যবদ্ধ কিংবা সংহত করতে দক্ষতা রাখেন না, তিনি উপজেলা, জেলা পর্যায়ের নেতা কিংবা সংসদ সদস্য বা মন্ত্রী অথবা দলের অন্য কারো আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে যতোই ক্ষমতাবান হন না কেন, জাতীয় নির্বাচনে স্থানীয় পর্যায়ে ভোট পাওয়ার ক্ষেত্রে খুব বেশি উপকারে তিনি আসবেন না। এ ধরনের পরিস্থিতি অনেক ইউপিতেই বিরাজ করছে বলে ধারণা পাওয়া যাচ্ছে ।

তেমন ইউপি মেম্বার বা চেয়ারম্যান দিয়ে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের খুব একটা লাভ হবে কি? অন্যদিকে যারা প্রার্থী হয়ে নির্বাচনে জয়লাভ করে এসেছেন, তাদেরকে যদি দলে ফিরিয়ে নেওয়া না হয়, তাহলে নির্বাচনের প্রাক্কালে দলকে তৃণমূলে সংঘটিত করবে কারা? তারা দলে ফিরে না আসতে পারলে তৃণমূলের সাধারণ মানুষকে সংগঠিত করার দায়িত্ব তারা নিজ থেকে পালন করতে পারবেন না। আবার দলের পরাজিত প্রার্থীরাও চাইবেন না যে বিজয়ী চেয়ারম্যান মেম্বাররা দলে ফিরে আসেন। দলের জন্য জনগণের কাছে অবদান রাখার মতো ভিত্তি অনেকেরই আছে কিনা সন্দেহ আছে। যাদের সেই ভিত্তি দুর্বল, কিন্তু ক্ষমতার বলয় পোক্ত, তারা তো শেষ বিচারে তৃণমূলে দলকে ক্ষতিগ্রস্তই করতে ভূমিকা রাখবেন।

সমস্যাটি খুবই জটিল। এখনই যদি নিরসনের উদ্যোগ না নেওয়া হয়, তাহলে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এমন সব জায়গায় আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীদের বেশ নাকানিচুবানি খেতে হতে পারে, সেই জায়গাটি বিরোধীরাই দখল করে নিতে পারে। অথচ জায়গাগুলোতে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীরা ইউপি চেয়ারম্যান মেম্বার পদে নির্বাচিত হয়ে আছেন। তাদের হয়তো ভালো জনসমর্থনও রয়েছে। আগামী দু বছর তারা সরকারি নানা ভাতা প্রদানের ক্ষেত্রে অনেকেরেই ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ পাবেন। নানা উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে তাদের ভূমিকা থাকবে। সুতরাং তৃণমূলে তাদের ভিত্তি যতোটা শক্ত থাকবে, প্রভাবশালী নেতার আশ্রয়ে থাকা পরাজিত কিংবা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়া অনেক চেয়ারম্যান মেম্বারের সেই ভিত্তি নাও থাকতে পারে। অভিযোগ আছে ওই ধরনের অনেক ইউপি চেয়ারম্যান এলাকায় থাকেন না, শহরে থাকেন। মন্ত্রী-এমপির ঘনিষ্ঠ হিসেবে আশেপাশেই থাকেন। ইউপি চেয়ারম্যান মেম্বার হওয়া সত্ত্বেও তাদের কর্মস্থলে তারা প্রায়ই অনুপস্থিত থাকেন।

শুনতে অবাক ও বিস্ময়কর মনে হলেও বাস্তবে অনেক ইউপি চেয়ারম্যান ও মেম্বারও এলাকায় থাকেন না। জনগণের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক অন্য কারো মাধ্যমে ঘটে থাকে। ইউপি মেম্বার চেয়ারম্যানদের সময় দিতে হয় তৃণমূলের সাধারণ মানুষকে। কিন্তু তাদের কেউ কেউ যখন ‘অসাধারণ’ হয়ে ওঠেন, জীবনযাপনও যখন তাদের শহুরে হয়ে পড়ে, তখন তাদের গ্রামের ইউপি মেম্বার চেয়ারম্যান হওয়ার প্রয়োজনটা কী? সংসদ সদস্য কিংবা মন্ত্রী নেতারা এমন লোকদেরই বা কেন এইসব পদে বাছাই করেন? তৃণমূল পর্যায়ে নেতাকর্মীর তো আকাল পড়েনি। সেখানেই অনেকে দল ও আদর্শের জন্য কাজ করছে। কিন্তু বড় নেতাদেরদের মন ভোলাতে তারা পারেন না, তাদের আনুকূল্যও তাই পান না। এমন ‘বড়রা’ আসলে দলের জন্য কতোটা বড়, নাকি দলকে ছোট করার মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছেন, সেটি বোধ হয় দলের ওপর থেকে তদারকি করে দেখা দরকার। দলের শীর্ষ পর্যায় থেকে খোঁজখবর নিলে এমন অকল্পনীয় বিষয় নজরে আসা মোটেও অসম্ভব নয়।

আওয়ামী লীগ দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার কারণে অনেক কিছুই বদলে গেছে। অনেকেরই এখন বিত্তবৈভবও গ্রামে কিংবা শহরে পর্যাপ্ত হয়েছে। তারাই একদিকে ক্ষমতা, অন্যদিকে ভোগবিলাসী জীবনযাপন করতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন। এদের তৃণমূলে যাওয়া এত দরকার কেন? সেখানে তো কেউ তাদের কথায় আস্থা রাখেন না, বিশ্বাসও করেন না। নির্বাচনে তাদের ভূমিকা রাখার মতো কিছুই নেই। সুতরাং এমন ইউপিগুলোতে আগামী নির্বাচনের আগে দলকে কীভাবে সংগঠিত করা হবে, বিরোধ কীভাবে নিষ্পত্তি করা হবে, ভোটের ময়দান কীভাবে ঢেলে সাজানো হবে – তা নিয়ে যদি এখনই ভাবা না হয়, তাহলে ইউপি নির্বাচনের নানা ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া মাঠে যেভাবে আওয়ামী লীগের রাজনীতিকে ওলট-পালট, কোথাও বা স্থবির, কোথাও বা ভণ্ডুল করে রেখেছে, সেসবের পুনরুজ্জীবন কীভাবে ঘটানো হবে – তা নিয়ে দল কী ভাবছে, সেটি পরিষ্কার নয়।

তবে গ্রামের মানুষ এখন দীর্ঘ করোনা সংক্রমণের নানা অভিঘাতে জর্জরিত। নির্বাচনের সময় তারা কিছুটা উত্তাপ-উত্তেজনায় থাকলেও এখন শৈত্যপ্রবাহে জবুথবু হয়ে পড়েছে। তেমন কোনো আলোচনা-সমালোচনা নেই, আছে যে যার মতো জীবন সংগ্রামে। কিন্তু থেমে নেই প্রতিক্রিয়াশীলদের রাজনীতি। সরকারের বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচার কান পাতলেই চারপাশে শোনা যায়। কিন্তু এসবের প্রতিকার নেই, উত্তরও নেই। কারণ দল সেখানে অনেকটাই নিষ্ক্রিয়। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে এই পরিস্থিতিকে চাঙ্গা করার মনোবৃত্তি বা পরিকল্পনা কতোটা সুফল বয়ে আনবে বলা মুশকিল। প্রতিনিয়ত নানা বিষয় নিয়ে তৃণমূলের মানুষ বিভ্রান্ত হচ্ছে। তাদের বিভ্রান্তি কাটানোর মতো তেমন কেউ নেই। সুতরাং এই পরিস্থিতিকে এখনই যদি আওয়ামী লীগ বিবেচনায় নিয়ে মাঠে না নামে তাহলে কাঙ্ক্ষিত ফসল ঘরে তোলা কতোটা সফল হবে সেটি কেবল ভবিষ্যতই বলে দেবে।

মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী: গবেষক-অধ্যাপক

এ বিভাগের আরো খবর