সাংবিধানিকভাবে জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের ওপর ন্যস্ত হলেও নির্বাচন কমিশনের পক্ষে এ নির্বাচন পরিচালনা করে মূলত মাঠপ্রশাসন। আরপিও ১৯৭২-এ সংসদ সদস্যদের নির্বাচনে রিটার্নিং অফিসার ও সহকারী রিটার্নিং অফিসার হিসেবে কাকে নিয়োগ দেয়া হবে সে সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলা না থাকলেও কমিশন কর্তৃক জেলা প্রশাসককে রিটার্নিং অফিসার ও উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে সহকারী রিটার্নিং অফিসার হিসেবে নিয়োগ প্রদান একটা নিয়মে পরিণত হয়েছে। প্রতিনিধিত্ব আদেশে প্রাপ্ত ক্ষমতাবলে রিটার্নিং অফিসার মাঠপর্যায়ে নির্বাচন পরিচালনার জন্য প্রিসাইডিং অফিসার, সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার এবং পোলিং অফিসার নিয়োগ দেন।
এ আদেশে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে একজন রিটার্নিং অফিসার তার কর্তৃত্বাধীন এলাকায় সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন পরিচালনার স্বার্থে প্রয়োজনীয় যেকোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন। নির্বাচন কমিশন কোনো শর্তারোপসাপেক্ষে সহকারী রিটার্নিং অফিসার রিটার্নিং অফিসারের নিয়ন্ত্রণে থেকে রিটার্নিং অফিসারের ক্ষমতা ভোগ ও কার্যাবলি সম্পন্ন করেন। নির্বাচনের সময় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, এসপি, ওসিসহ পুলিশ ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
ডিসি, ইউএনও, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, এসপি, ওসি- এসব কর্মকর্তার নিয়ন্ত্রণ অর্থাৎ তাদের পদোন্নতি, বদলিসহ তাদের বিরুদ্ধে শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষমতা সরকারের হাতে থাকায় ক্ষমতাসীন সরকারের পক্ষে নির্বাচনে তাদের দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করা অনেকটা সহজ হয়। বিগত দিনে দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত যেকোনো সংসদ নির্বাচনে মাঠ প্রশাসনে ক্ষমতাসীন দলগুলোর প্রভাব বিস্তারের চিত্র দেখা গেছে। নির্বাচনকে দলীয় প্রভাবমুক্ত করার জন্য রিটার্নিং অফিসার ও সহকারী রিটার্নিং অফিসার নিয়োগের ব্যাপারে শুধু প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা না দিয়ে মাঠপর্যায়ে যেকোনো ক্যাডারের কর্মকর্তাদের নিয়োগ হওয়া বাঞ্ছনীয়। এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সংস্কার ও সংশোধনী আবশ্যক।
বাংলাদেশ স্বাধীনতার ৫০ বছরের মধ্যে ৪৫ বছর স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্বাচন হয়েছে নির্দলীয়ভাবে। আওয়ামী লীগ সরকারের ২০১৪-১৮ মেয়াদে স্থানীয় সরকার ইউনিয়ন পরিষদ সংশোধিত আইন-২০১৫, উপজেলা পরিষদ সংশোধিত আইন-২০১৫, পৌরসভা সংশোধিত আইন-২০১৫ এবং সিটি করপোরেশন সংশোধিত আইন-২০১৫-এর মাধ্যমে কেবল নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল মনোনীত এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীদের এসব স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী পদে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার যোগ্য ঘোষণা করা হয়।
এ নিয়ম এখনও বলবৎ রয়েছে। এতে শুধু স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী পদে নির্দলীয়ভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্যই লোপ পায়নি, বরং সমাজে, বিশেষ করে গ্রামীণ সমাজে হাজার বছরের সামাজিক বন্ধনে ফাটল ধরেছে। দলীয় আনুগত্যের কারণে একই পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সদ্ভাব নষ্ট হয়েছে। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্বাচন রাজনীতিকীকরণ, নির্বাচন কমিশনের দুর্বলতা এবং নির্বাচন পরিচালনাকারী মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের ক্ষমতাসীন দলের প্রতি আনুগত্য ও তোষণ নীতি ইত্যাদির কারণে বিগত সময়ের স্থানীয় ও সংসদ নির্বাচনগুলো প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। পাশাপাশি স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর নৈতিক ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়েছে।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করার জন্য সব রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও সিভিল সোসাইটির সদস্যদের ঐকমত্যের ভিত্তিতে ১৯৯৬ সালে ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা। যা দেশে-বিদেশে ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছিল। ২০১১ সালের ১০ মে বাংলাদেশে সুপ্রিম কোর্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের রায় ঘোষণা করলে বাংলাদেশের সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে এ সরকার ব্যবস্থাকে বাতিল করা হয়।
নির্বাচনকে স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য করতে বর্তমান রাজনৈতিক সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি, প্রধান বিরোধী দলের সীমাবদ্ধতা, সুশীল সমাজের সদিচ্ছা সর্বোপরি জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার নিরিখে আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এ বিষয়ে আমাদেরকে একটি জাতীয় ঐকমত্যে পৌঁছতে হবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা না থাকলেও বর্তমান জাতীয় সংসদ তথা সংসদীয় সরকার পদ্ধতির মধ্যেই আমরা মনে করি, একটি গ্রহণযোগ্য সমাধান সম্ভব।
রাজনীতি-সৎ ও যোগ্য প্রার্থী, দুর্নীতি-সন্ত্রাস, কালো টাকার প্রভাব ইত্যাদি বিষয় আজ আলোচনায় উঠে এসেছে দেখে প্রধানমন্ত্রী কিন্তু অখুশি নন। যে কথাটা আজ পঞ্চাশ বছর পর সবাই উপলব্ধি করলেন সে কথাটা কিন্তু জীবদ্দশায় জাতির পিতা উপলব্ধি করেছিলেন। আর সে কারণেই সাময়িকভাবে একটা পরিবর্তনও এনেছিলেন। কিন্তু তখন তা কেউই দূরদর্শিতার অভাবে বুঝতে পারেনি। অথবা হতে পারে স্বাধীনতাকে অর্থহীন করার জন্য কোনো ঝড়যন্ত্র এর পেছনে ছিল, তাই তা করতে দেয়নি। নির্বাচনে যাতে কালো টাকা ও সন্ত্রাসীরা প্রভাব ফেলতে না পারে তার জন্যই নির্বাচনপদ্ধতিতে একটা পরিবর্তন আনা হয়।
তাহলো, প্রার্থী যারা হবেন তাদের পোস্টার সরকার করে দেবে। নির্বাচনের সব খরচ জাতীয় সরকার বহন করবে। প্রার্থী শুধু বাড়ি বাড়ি যেতে পারবে। সভা-সমাবেশ একসঙ্গে করতে পারবে। একই মঞ্চে দাঁড়াবে এর জন্য সরকার ব্যবস্থা নেবে। কিন্তু যাবতীয় খরচ বহন করবে সরকার। নিরপেক্ষভাবে এভাবে দুটো উপনির্বাচন হয়েছিল। কিশোরগঞ্জে উপনির্বাচনে একজন স্কুল শিক্ষক জয়ী হন। উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের ভাই হেরে যান। ক্ষমতায় ছিলেন বলে তিনি ভাইকে জেতাতে কারচুপি করেননি খাটাননি ক্ষমতার প্রভাবও।
বর্তমান সমাজে আদর্শে বিশ্বাসী রাজনীতিবিদদের জন্য রাজনীতি করা কঠিন হয়ে পড়েছে। আর এ কারণে সুবিধাবাদী, তোষামোদী, খোষামোদীদের প্রাধান্য বাড়ছে। ত্যাগ নয়, ভোগের মানসিকতা নিয়ে রাজনীতিতে অবতরণ করেই জনগণকে শোষণ করা হচ্ছে। সে কারণেই স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও দেশের সাধারণ মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটেনি। মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ ধনী থেকে আরও ধনী হয়েছে, সাধারণ মানুষ বঞ্চিত হয়েছে। যদি আদর্শবাদী রাজনীতিবিদরা ক্ষমতায় থাকতে পারত তাহলে বাংলাদেশের অর্থনীতির ভিত অনেক আগেই মজবুত হতো।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ঘটনা যদি না ঘটত, বঙ্গবন্ধু যদি আর পাঁচটা বছর হাতে সময় পেতেন তাহলেই বাংলাদেশ পৃথিবীর জন্য উন্নয়নের রোল মডেল হতো অনেক আগেই। অর্থনৈতিক সমীক্ষা থেকেই এ তথ্য পাওয়া যাচ্ছে।
নির্বাচনব্যবস্থা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে কার্যকর ভূমিকা পালনে সক্ষম হয়নি। তাই প্রয়োজন হয়ে পড়েছে নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কারের। বিগত সময়ে ভোটারদের ভোট দিতে না পারাসহ নানা অনিয়মের কারণে মানুষ ভোট প্রদানে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। জাতীয় নির্বাচন, উপনির্বাচন এবং স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্বাচনে খুব স্বল্পসংখ্যক ভোটারের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের ফলাফলে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হচ্ছে, যা গণতন্ত্রের জন্য অশনিসংকেত। তাই নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হতে ন্যূনতম ভোটের প্রয়োজনীয়তা নির্ধারণ করা দরকার হয়ে পড়েছে।
২০১৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বরে যুগান্তরে প্রকাশিত এক খবরে বলা হয়, ওই বছরের ৩০ আগস্ট অনুষ্ঠিত নির্বাচন কমিশনের বৈঠকে সংসদ সদস্যদের নির্বাচনে আসনভিত্তিক রিটার্নিং অফিসার নিয়োগের প্রস্তাব অনুমোদিত হয়। কমিশন থেকে সে অনুযায়ী আরপিওতে সংশোধনী আনার প্রস্তাব সরকারের কাছে পেশ করার সিদ্ধান্ত হয়। পরে এ বিষয়ে কোনো অগ্রগতি জানা যায়নি।
জেলাভিত্তিক নিয়োজিত রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয় থেকে সংসদ নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণায় মিডিয়া ক্যুর নজির দেশে রয়েছে। তাই আসনভিত্তিক রিটার্নিং অফিসার নিয়োগের বিষয়টি পর্যালোচনার দাবি রাখে। আনুপাতিক ভোটের ভিত্তিতে সংসদ সদস্য নির্বাচন, অর্থাৎ যে রাজনৈতিক দল নির্বাচনে যত শতাংশ ভোট পাবে, সে দল জাতীয় সংসদে তত শতাংশ সংখ্যক প্রতিনিধি পাঠাবে- ফর্মুলাটি বিবেচনার দাবি রাখে। মোটকথা, গত পাঁচ দশকের অভিজ্ঞতা বলে দেয়, নির্বাচনকে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক করতে জাতীয় ও স্থানীয় সরকার নির্বাচন ব্যবস্থায় সংস্কার আনা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।
পরিশেষে বলা যায়, নির্বাচনপদ্ধতিতে পরিবর্তন আনা আজ সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে। আমরা চাই সব দলের অংশগ্রহণে উৎসবমুখর পরিবেশে আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক। এ বিষয়ে সরকার, বিরোধী দল আন্তরিক ও দায়িত্বশীল হলেই নির্বাচনপদ্ধতি সংস্কার করা সম্ভব। আর নির্বাচনপদ্ধতির সংস্কারেই গণতন্ত্রকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হবে।
নির্বাচনব্যবস্থাকে অবাধ, সুষ্ঠু ও কার্যকর করা না হলে দেশ ও জাতির কল্যাণ হবে না। অধিকন্তু প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনব্যবস্থা সরকার, রাজনৈতিক দল ও জনগণের মধ্যে সম্পর্ক ও আস্থার সংকট তৈরি করবে। নির্বাচনব্যবস্থায় ত্রুটি, বিচ্যুতি ও তার কাঠামোগত দিক সংস্কারপূর্বক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা করে একটি অংশগ্রহণমূলক অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে দেশ ও জাতিকে গৌরাবান্বিত ও মহিমান্বিত করে তোলা জরুরি।
লেখক: গবেষক-কলাম লেখক। সাবেক উপমহাপরিচালক, বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি।