বাংলাদেশে ইংরেজি বর্ষবরণের উচ্ছ্বাস উচ্চবিত্তের আঙিনা ছাপিয়ে এখন মধ্যবিত্ত, নিম্ন–মধ্যবিত্তের দুয়ারেও আছড়ে পড়ছে। ইংরেজি নববর্ষ ঘিরে তৈরি হয় একটা সাজ সাজ রব। বৃহস্পতিবার রাতে শুরু হওয়া ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’-এর শুভেচ্ছা বিনিময় আজও চলছে। এমনকি আরও কয়েকদিন চলবে।
অনেকে আবার নতুন বছরে নতুন সংকল্প বা শপথের কথা বলেন। এটা অবশ্য মানুষের বহুদিনের অভ্যাস। মানুষ বাঁচে নতুন স্বপ্ন ও সংকল্প নিয়ে। গেল বছর যা হয়নি, নতুন বছরে তা যেন হয়, সেই প্রত্যাশা সামনে চলে আসে। কিন্তু সব স্বপ্ন ও প্রত্যাশা সরকার, বিরোধী দল কিংবা অন্য কেউ পূরণ করে দেবে– তা কি হয়? প্রতিশ্রুতি কি শুধুই অন্যদের জন্য? নিজের কাছে নিজের প্রতিশ্রুতিও কিন্তু এই নতুন বছরটা এনে দেয়।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এর একটা গালভরা নামও দেয়া হয়েছে– ‘নিউ ইয়ার রেজুলিউশন।’ আমাদের দেশেও ক্রমে এটা বিস্তৃত হচ্ছে। রেজুলিউশন অবশ্যই আপনার। তাই বলে তাতে অন্যরা নাক গলাবে না, তা–ও কি কখনও হয়? আমাদের নাকের সাইজ যতই বোঁচা বা খ্যাঁদার দিকে হোক না কেন, যত্রতত্র তার পুটুস করে গলে যাওয়ার ইচ্ছার দৈর্ঘ্য যে এভারেস্টের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে! নাক গলানোর সেই বিপুল ইচ্ছেসহ আপনার রেজুলিউশনে কিছু টিপস দেয়া যেতেই পারে।
এই বছরটায় প্রতিজ্ঞা করুন, অন্তত একটা বছর পরনিন্দা, পরচর্চা, গিবত করবেন না। কারো নামে অকারণে কুৎসা রটাবেন না। গুজব ছড়াবেন না। গুজবের পেছনে দৌড়াবেন না। নিতান্তই যদি তা না পারেন, অন্তত ‘সহনীয় মাত্রা’য় তা করুন!
করোনার ব্যাপারে নিজে মনগড়া সব বক্তব্য না দিয়ে একটু যুক্তিশীল হোন। ডাক্তারদের কথা শুনুন। উদ্ধৃতি দিলে অবিকৃতভাবে দিন। শুধু জল আর মল নয়, একটু হলেও স্বার্থত্যাগ করতে করতে শিখুন।
কাফকা থেকে অরুন্ধতী, রবীন্দ্রনাথ থেকে ভিক্টোর হুগো, যত খুশি, যার নামে খুশি মন দিয়ে উদ্ধৃতি দিন, কিন্তু শুধু ফ্ল্যাপের সামারি, শেষ পাতা কিংবা একটা–দুটো কোটেশন নয়, এ বছর অন্তত পুরো বইটা পড়ার সংকল্প নিন। অ্যাটলিস্ট চেষ্টা করুন।
‘কাঁকড়া শিল্পে’ আপনার দক্ষতা আকাশচুম্বী। ‘তৈলাক্ত পদার্থের’ ব্যবহারেও আপনি অনন্য। তবে এ বছরটা নেতা বা বসের পেছনে মাখনের আড়তটা উপুড় করার বদলে একটু–আধটু নিজের কর্মদক্ষতা বাড়ানোর প্রতিজ্ঞাটা করে ফেলুন।
প্রচুর পড়াশোনা করে কে-ইবা কবে কোন মহাভারতটা উদ্ধার করেছে? আপনারও সে চান্স বিশেষ নেই। শুধু ঠিক করুন পরীক্ষার সময় অন্যের খাতা দেখে লেখা এবং পরীক্ষার আগে কীভাবে প্রশ্নপত্র হাতে পাওয়া যায় সেই চেষ্টাটা কম করবেন।
‘পর স্ত্রী’-কাতরতা বঙ্গজীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, শুধু এই বছরটায় অঙ্গীকার করুন, নিজেরটির দিকেও মাঝেসাঝে সময় পেলেই তাকাবেন।
এ নেশা করে, ও নেশা করে শেষ হয়ে গেল, ওরা তো বাই ডিফল্ট নেশাতুর। কিন্তু আপনি একটু নিজেকে বদলান। নেশা করুন, শুধু এর ওর গায়ে সে নেশার রেশ বিশেষ না ছড়ানোর প্রতিজ্ঞা করেই ফেলুন।
শুধু ফেইসবুক নয়, বাস্তব জীবনেও উদার–মহৎ হোন। ‘হ্যান করেঙ্গা ত্যান করেঙ্গা’ থেকে যেকোনো বিপ্লব বা সব কিছু বদলে ফেলার ইচ্ছাটা এবার ফেইসবুক থেকে রাস্তাতেও নামিয়ে আনার শপথটা মনে মনে বছরের শুরুতেই করে ফেলুন।
এ বছরটা অন্তত গরিব রিকশাচালকের সঙ্গে পাঁচ টাকা বেশি ভাড়া নিয়ে তর্কটা আলমারির তাকে তুলে রাখুন।
শপথ করুন, কোনো ক্ষেত্রেই নিজের লাম্পট্যকে লুকাতে মেয়েদের ঘাড়ে সব দোষ চাপাবেন না, কেবলই মেয়েদের খুঁত ধরবেন না।
পরিচ্ছন্নতা নিয়ে মেয়র–কমিশনারদের গুষ্টি–উদ্ধারে আপনার যে স্বতঃস্ফূর্ত উদ্যোগ তা অব্যাহত থাকুক। কেননা এটা ঠেকানোর সাধ্যি কারো নেই। শুধু, এই বছরটায় ঠিক করুন, নিজে যেখানে–সেখানে থুতু বা ময়লা ফেলার আগে সাড়ে ২৫ বার ভাববেন।
ছেলে কিংবা মেয়ের ক্লাস ফাইভের রিপোর্ট কার্ড হাতে পেয়ে, কম নম্বর তার ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা কম্পিউটার সায়েন্টিস্ট হওয়ার পথে কত বড় বাধা সে বিষয়ে বিস্তারিত জ্ঞান বিতরণের আগে নিজের ক্লাস ফাইভের নম্বরটা একবার স্মরণ করে নেবেন।
কার প্রেমিক কার দিকে উঁকি মেরেছেন, কার মেয়ে কার ভাইপোর সঙ্গে ‘ইটিসপিটিস’ করছেন, কার ব্লাউজের ঝুল কত, কে পর্দা করে, আর কে করে না, তা নিয়ে এই বছরটা কম মাথা ঘামান। নিজের চোখের পর্দাটা একটু পুরু করার শপথ নিন।
রোজ সকালে উঠে দৌড়াতে বা হাঁটতে যাবেন যান। সন্ধ্যায় জিমেও যেতে পারেন। শুধু মনে রাখবেন, সেখান থেকে ফিরে এসে কিছুতেই গরুর মাংস ভুনা কিংবা ডিম–পরোটা দিয়ে ব্রেকফাস্ট করবেন না। তাহলে লাভ কিছুই হবে না।শুধু অন্যের পকেট কীভাবে কাটা যায়– সেই চিন্তাতেই মগ্ন থাকবেন না, মাঝে মাঝে নিজের পকেট কেটে অন্যদেরও খাওয়াবেন।
বাইরে সম-অধিকার নিয়ে মস্ত বড় লেকচার ঝেড়ে অফিস থেকে বউয়ের সঙ্গে প্রায় একই সময়ে বাড়ি ফিরে এক কাপ চায়ের জন্য সেই বউয়ের উপরেই ভরসা করে থাকবেন না।
শপথ নিন ‘ওহ, আমার না টুডে ভেরি হট লাগছে’র বদলে ‘আমার ভারি গরম লাগছে’ বলায় জোর দেবেন। ‘বাংরেজির’ বদলে কথা বলার সময় শুধু বাংলা অথবা ইংরেজি বলা প্র্যাকটিস করুন।
শুধু একুশে ফেব্রুয়ারিতেই নয়, অন্য সময়ও ছেলেমেয়েকে বাংলা পড়া ও বাংলা লেখার ব্যাপারে উদ্যোগ নেবেন, শপথ নিন। কুমড়োপটাশ, রামগড়ুর, হিজবিজবিজ–এর অমর স্রষ্টা ‘ত্রিকালদর্শী’ সুকুমার রায় নামক এক কবির লেখাগুলো নিজের ও আশপাশের পিচ্চিপাচ্চাকে পড়তে শেখাবেন, এবং বাংলাতেই।
কেউ ক্যাপিটালিজম নিয়ে তর্ক করতে এলে তাকে মন দিয়ে বোঝান সোশ্যালিজম ঠিক কতটা ভালো, আর কেউ সোশ্যালিজম কপচালে তাকে স্ট্রেইট জানান ওসব ইউটোপিয়া, ক্যাপিটালিজম ছাড়া গতি নেই।
আওয়ামী লীগের সমালোচনা করুন, বিএনপির গুষ্টি উদ্ধার করুন। মোট কথা ডান বাম নয় আপনি মধ্যপথের বিশ্বাসী। মনে যা-ই থাকুক এলিটিজম বোঝাতে নিজেকে ‘অ্যা-পলিটিকাল’ বলতেই ভালোবাসেন আপনি। এ বছর, গা না বাঁচিয়ে দিক বাছবেন, মনে মনে সংকল্প করুন।
অসহিষ্ণুতা ইস্যুতে আরও একটু কম অসহিষ্ণু হবেন। অন্য ধর্মের মানুষদের ‘বিধর্মী’ বলে অবজ্ঞা করবেন না! কারো নামে ধর্ম–অবমাননার মিথ্যা অভিযোগ আনবেন না।
প্রতিজ্ঞা করুন শুভ সকাল, শুভরাত্রিসহ এর–ওর ইনবক্সে কোনো কিছুই চালান করবেন না, তা সে যত আকর্ষণীয় জিনিসই হোক। নিজে শান্তিতে থাকতে না পারলে ঘুমের ওষুধ খান, কিন্তু দয়া করে অন্যের শান্তিতে ব্যাঘাত ঘটাবেন না।
কথায় না পারলে কার চরিত্র কত খারাপ, কে কত খারাপ বংশের লোক, কার মামাতো শাশুড়ির ছোট ননদের দেবরের ভাইজি কার সঙ্গে পালিয়ে গিয়েছিল, কার মেজ ভাসুরের খালাতো শালির চাচা শ্বশুরের মাছের দোকান আছে সে-সব প্রসঙ্গ টেনে আনবেন না। একটু যুক্তির মুখাপেক্ষী হবেন, নিজের দিকে তাকাবেন।
মুখে উদারপন্থি কিন্তু মনে–মননে জিহাদপন্থি হবেন না। ধার্মিক না ‘সেজে’ ধার্মিক ‘হওয়ার’ চেষ্টা করুন।
নিজের মত শ্রেষ্ঠ মত– এই বিশ্বাস থেকে সরে আসুন। অন্য কেউও যে আমার চেয়ে ভালো একটা আইডিয়া বা ভাবনা ভাবতে পারে– কষ্ট করে হলেও তা বিশ্বাস করতে শিখুন।
পুনশ্চ: অভিজ্ঞতা বলে, আমাদের ব্যক্তিগত কিংবা রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি ও সংকল্পের একটা বৈশিষ্ট্য আছে। এসব সংকল্প জন্ম নেয় মাঝরাস্তায় হঠাৎ করে উধাও হয়ে যাওয়ার জন্যই। কাজেই নিউ ইয়ার রেজুলিউশন নিতে আপত্তি কী? আমাদের সব শপথ ও প্রতিশ্রুতিই তো গ্রহণ করা হয় তা ভঙ্গ করার জন্য! কি আমাদের জাতীয় জীবনে, কি ব্যক্তি জীবনে!
লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা, প্রবন্ধকার।