পরবর্তী নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ যে সংলাপ করছেন, তাতে প্রথম অংশগ্রহণকারী দল ছিল জাতীয় পার্টি। ২০ ডিসেম্বর বঙ্গভবনে এই সংলাপ হয়। তারা নির্বাচন কমিশনারদের খুঁজে বের করার জন্য সার্চ কমিটির সদস্য হিসেবে চারজনের নাম প্রস্তাব করেছে। সংবাদটি এ পর্যন্তই শেষ হতে পারত। কিন্তু একটি নতুন ডাইমেনশন পাওয়া গেল এর ফলোআপ সংবাদে।
যেখানে বলা হয়েছে, সার্চ কমিটির সদস্য হিসেবে চারজনের পাশাপাশি তারা নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগের জন্য দলের মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুর স্ত্রীর নামও প্রস্তাব করেছে। মুজিবুল হক চুন্নুর স্ত্রী রোকসানা কাদের অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব। এটি নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেকেই রসিকতা করছেন।
প্রশ্ন হলো, একটি দলের মহাসচিবের স্ত্রী বলে কি তার নাম নির্বাচন কমিশনার হিসেবে প্রস্তাব করা যাবে না কিংবা তিনি যদি নির্বাচন কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালনের মতো যোগ্য ব্যক্তি হন, তাহলে কি তাকে নিয়োগ দেয়া যাবে না?
সহজ উত্তর হলো, একটি দলের মহাসচিবের স্ত্রীকে যে নৈতিক কারণেই নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দেয়া হবে না— সেটি জাতীয় পার্টিরও জানার কথা। কিন্তু তারপরও তারা কেন তার নাম প্রস্তাব করল, এর ব্যাখ্যা তারাই দিতে পারবে ভালো। তবে এই তর্কে না গিয়ে বরং দেখা যাক, নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে রাষ্ট্রপতির এই সংলাপের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিল কেন এবং এই সংলাপের সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক তাৎপর্যইবা কী?
সংবিধানের ৪৮(৩) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে-
“কেবল প্রধানমন্ত্রী এবং প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্র ব্যতীত রাষ্ট্রপতি তার অন্য সকল দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করিবেন।”
এখন প্রশ্ন হলো, নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগে সার্চ কমিটি গঠনের জন্য রাষ্ট্রপতি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যে সংলাপ করছেন; সেখানে প্রাপ্ত মতামত, সুপারিশ ও প্রস্তাবগুলো তিনি কতটুকু গ্রহণ করতে পারবেন? কারণ এই ইস্যুতে এককভাবে তার কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার এখতিয়ার নেই বরং তিনি প্রস্তাবগুলো নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করতে পারবেন।
সেইসঙ্গে সংবিধানের ৪৮(৫) অনুচ্ছেদে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে তিনি এই বিষয়টি মন্ত্রিসভায় বিবেচনার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে পেশ করতে পারবেন। তবে সিদ্ধান্তটি আসবে মূলত প্রধানমন্ত্রীর তরফেই। আরও বৃহৎ অর্থে, প্রধানমন্ত্রী যেহেতু একইসঙ্গে ক্ষমতাসীন দলেরও প্রধান, তাই তিনি যে সিদ্ধান্ত দেবেন; সেখানে দলের মতামতেরও প্রতিফলন থাকবে। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে এই সংলাপে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি দলও অংশ নেবে।
গত ২০ ডিসেম্বর যে সংলাপ শুরু হয়েছে তাতে এখন পর্যন্ত সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি এবং জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) অংশ নিয়েছে। আগামী ২৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি এবং বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ); ২৭ ডিসেম্বর বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশন এবং খেলাফত মজলিস; ২৮ ডিসেম্বর বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি; ২৯ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট (বিএনএফ) এবং ইসলামি ঐক্যজোটের সঙ্গে সংলাপ হওয়ার কথা রয়েছে। যদিও মাঠের রাজনীতিতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি সংলাপে যাবে কি না— তা এখনও নিশ্চিত নয়।
নির্বাচন কমিশন অত্যন্ত স্পর্শকাতর এবং গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান— যাদের আচরণ ও কর্মকাণ্ডের ওপর জাতীয় সংসদ থেকে থেকে শুরু করে স্থানীয় সরকারের নির্বাচনগুলো কেমন হবে, তার অনেকখানি নির্ভর করে। অনেকখানি এই অর্থে যে, নির্বাচন কমিশন যেভাবে চাইবে সেভাবে নির্বাচন হওয়ার কথা থাকলেও মাঠ প্রশাসন এবং রাজনৈতিক দলগুলোর আচরণও একটা ভালো, অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য বড় নিয়ামক।
সুতরাং, প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং আরও চারজন নির্বাচন কমিশনার হিসেবে কারা নিয়োগ পেলেন বা পাবেন, সেটি ক্ষমতার বাইরে থাকা দলগুলোর জন্য বিরাট কনসার্ন। অতএব, যে বিষয় নিয়ে বিরোধী দলগুলোর কনসার্ন যত বেশি, ক্ষমতাসীন দল সেসব বিষয়ে তত বেশি সতর্ক। সুতরাং, রাজনৈতিক দলগুলোর সংলাপের মাধ্যমে একটি সার্চ কমিটি হবে এবং সার্চ কমিটি নির্বাচন কমিশনের জন্য সবচেয়ে যোগ্য, দলনিরপেক্ষ এবং সাহসী পাঁচজন লোককে সার্চ করে নিয়ে আসবে— সেটি জনগণের প্রত্যাশা হতে পারে, কিন্তু এত সহজ নয়।
প্রশ্ন হলো, নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগের জন্য কেন এই সার্চ কমিটি? সংবিধানের ১১৮(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে-
“প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অনধিক চারজন নির্বাচন কমিশনারকে লইয়া বাংলাদেশের একটি নির্বাচন কমিশন থাকিবে এবং উক্ত বিষয়ে প্রণীত কোনো আইনের বিধানাবলী-সাপেক্ষে রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগদান করিবেন।”
যদিও বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠনের ৫০ বছরেও এ সম্পর্কিত একটি আইন প্রণয়ন করা হয়নি।
সংবিধানে নির্দেশনা থাকার পরেও কেন ৫০ বছরেও এরকম একটি আইন করা গেল না? আইন হলে নিজেদের পছন্দমতো লোকদের নিয়োগ দেয়া যাবে না বলে? নির্বাচন কমিশন গঠনে আইন থাকলে যেহেতু সেখানে কোন প্রক্রিয়ায় কমিশন গঠিত হবে, সেটি সুস্পষ্ট থাকবে; আইন হলে সেখানে কারা নির্বাচন কমিশনের সদস্য হতে পারবেন, কে প্রধান নির্বাচন কমিশনার হবেন, তাদের যোগ্যতা কী হবে; পেশাগত জীবনে তাদের ট্র্যাক রেকর্ড; রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা, সততা, প্রশাসনিক দক্ষতা ও নিরপেক্ষতা ইত্যাদি বিষয় যেহেতু আইনে উল্লেখ থাকবে; নিয়োগ পাওয়ার আগেই তাদের ব্যাপারে যেহেতু নাগরিকরা জানতে পারবেন এবং গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ায় তাদের ব্যাপারে মতামত জানানোর সুযোগ থাকবে; এমনকি তাদের ক্ষমতা ও এখতিয়ারও আইনে স্পষ্ট উল্লেখ থাকবে— ফলে সেই প্রক্রিয়ায় ক্ষমতাসীনদের পক্ষে ‘নিজেদের পছন্দের লোকদের’ দিয়ে কমিশন গঠন কঠিন হবে বলে এ বিষয়ে আইন করা হচ্ছে না?
স্মরণ করা যেতে পারে, ২০০৭ সালে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ইসি গঠনে আইন করার জন্য একটি খসড়া তৈরি করেছিল এটিএম শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশন। তবে সেটি আলোর মুখ দেখেনি। গত ২০ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতির সঙ্গে অনুষ্ঠিত সংলাপে জাতীয় পার্টিও নির্বাচন কমিশন গঠনে আইন প্রণয়নের প্রস্তাব দিয়েছে।
এখনও যেহেতু আইন নেই, তাই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগ দিয়ে থাকেন। ২০০৭ পর্যন্ত এভাবেই চলে আসছিল। তবে ২০১২-এর ২২ জানুয়ারি সেসময়ের রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের উদ্যোগে প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগে বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম সার্চ কমিটি গঠন করা হয়। এর কদিন পরে পাঁচ সদস্যের নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়।
বিএনপি ও তাদের জোট ওই সার্চ কমিটির বিরোধিতা করেছিল। ২০১৭ সালেও বর্তমান কমিশন গঠনের আগে ৬ সদস্যের সার্চ কমিটি করেছিলেন রাষ্ট্রপতি। ওই কমিটির প্রধান ছিলেন বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। তখনও সার্চ কমিটির সদস্যদের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল বিএনপি।
কেএম নুরুল হুদার নেতৃত্বে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হচ্ছে আগামী ফেব্রুয়ারিতে। এবারও যে গত বছরের মতো সার্চ কমিটির মাধ্যমেই কমিশনারদের নিয়োগ করা হবে, সেটি গত ৪ অক্টোবর সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই নিশ্চিত করেন।
সার্চ কমিটির কার্যপরিধি কেমন হবে, কারা এই কমিটিতে থাকবেন সে বিষয়ে কোথাও সুস্পষ্টভাবে বলা না হলেও অতীত অভিজ্ঞতা বলছে, এবারও হয়তো পাঁচজনের একটি কমিটি করা হবে যেখানে আপিল বিভাগের এক বা একাধিক বিচারপতি, কোনো সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের এক বা একাধিক ব্যক্তি, একজন স্বনামধন্য অধ্যাপক ও একজন সাবেক আমলা থাকতে পারেন।
যাদেরকে নিয়েই সার্চ কমিটি করা হোক না কেন, তারা সার্চ করে নির্বাচন কমিশনের জন্য কোন পাঁচজনের নাম প্রস্তাব করবেন অথবা তারা প্রতিটি পদের বিপরীতে একাধিক ব্যক্তির নাম প্রস্তাব করবেন কি না— তা এখনই বলা মুশকিল। তবে নির্বাচন কমিশনার হওয়ার যোগ্যতা রাখেন, এমন কাউকে যাতে সার্চ কমিটিতে না রাখা হয়, সে বিষয়টি মাথায় রাখা দরকার।
তর্কটা অন্য জায়গায়। তা হলো- দেশের সবচেয়ে নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের নিয়েও যদি নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়, তারপরও যদি নির্বাচন কমিশনের মাঠ প্রশাসন, রিটার্নিং কর্মকর্তা, প্রিজাইডিং কর্মকর্তা, আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী এবং নির্বাচনের প্রধান যে পক্ষ রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীরা সহায়তা না করেন তাহলে দেশের সবচেয়ে ভালো মানুষেরাও নির্বাচন কশিনার হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে কিছুই করতে পারবেন না। আইন যতই ভালো হোক- সেটার প্রয়োগকারীরা যদি ভালো না হয়, প্রয়োগকারীদের ইনটেনশন যদি ভালো না হয় তাহলে ভালো আইনও নিরর্থক।
ভালো নির্বাচনের জন্য একটি ভালো সংস্কৃতি দরকার— যা নির্বাচন কমিশনের একার পক্ষে গড়ে তোলা অসম্ভব এবং এটি একদিনে বা এক বছরে তৈরি হয় না। এরশাদের পতনের পরে দেশের নির্বাচনি ব্যবস্থায় যে ইতিবাচক পরিবর্তনটি শুরু হয়েছিল, সেটিও সাম্প্রতিক বছরগুলোয় যেভাবে বিতর্কিত হয়েছে, সেই জায়গা থেকে আবারও ইতিবাচক ধারায় ফেরানোও গুরুত্বপূর্ণ। সেই কাজটি করতে হলে প্রথমত, দ্বিতীয়ত এবং তৃতীয়ত যে জিনিসটি দরকার, তা হচ্ছে পলিটিক্যাল উইল বা রাজনৈতিক সদিচ্ছা; যে কাজটি নির্বাচন কমিশনের সহায়তা করতে হবে রাজনৈতিক দলগুলোকেই। আরও সুনির্দিষ্টভাবে বললে এই কাজে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে হবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকেই।
লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।