চলতি বছর আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করছি। একটি দেশের জন্য পঞ্চাশ বছর তেমন কোনো সময় নয়। বিশ্বের অনেক দেশ স্বাধীনতার দুই শতাব্দীর অধিক সময় পার করেছে কিন্তু এখনও তারা নানান সমস্যায় জর্জরিত। এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশ স্বাধীনতার দুই শতাব্দীর অধিক সময় পার করলেও এখনও বর্ণবাদ, লিঙ্গ বৈষম্যসহ অনেক সমস্যা তাদের মোকাবিলা করতে হচ্ছে। সেই তুলনায় পঞ্চাশ বছর আমাদের দেশের জন্য তেমন কিছু সময় নয় মোটেই। তদুপুরি এই পঞ্চাশ বছর আমাদের দেশ নানান উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে চলেছে। তাছাড়া বিগত পঞ্চাশ বছরে আমাদের দেশই শুধু নয়, সমগ্র বিশ্বই এক ধরনের বৈপ্লবিক প্রবর্তনের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়েছে।
বিশেষ করে তথ্যপ্রযুক্তির আবিষ্কার এবং মানুষের জীবনে এই প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার মানুষের জীবনযাত্রা এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে এমন গতিশীলতা এনে দিয়েছে যা আগে কখনও ঘটেনি। এই পরিবর্তনের হাওয়ায় আমাদের দেশও বসে থাকেনি, বরং যুগের হাওয়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে আমাদের দেশ ভালোই সক্ষম হয়েছে। বিশেষ করে বিগত দেড়যুগ ধরে একটানা বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা দেশ পরিচালনার সুযোগ পেয়ে দেশের আর্থসামাজিক উন্নতিকল্পে যুগান্তকারী সব কর্মসূচি হাতে নিয়েছেন। ফলে দেশ এগিয়েছে সব ক্ষেত্রে এবং পিছিয়ে নেই দেশের ব্যাংকিং খাতও।
ব্যাংকিং খাতের অভাবনীয় আগ্রগতি
স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে দেশের ব্যাংকিং খাত এগিয়েছে আশাতীতভাবে। পাকিস্তানের কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত জীর্ণ ব্যাংকিং ব্যবস্থা দিয়ে যাত্রা শুরু হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত। সে সময় দেশে মাত্র ছয়টি সরকারি মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংক এবং তিনটি সরকারি মালিকানাধীন বিশেষায়িত ব্যাংক চালু ছিল। সেই সঙ্গে নয়টি বিদেশি ব্যাংকের শাখাও চালু ছিল। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে দেশের এই ক্ষুদ্র ব্যাংকিং খাত বৃদ্ধি পেয়ে বিশাল এক আর্থিক খাতে রূপান্তরিত হয়েছে। বর্তমানে দেশে ৬১টি তফশিলি ব্যাংক চালু আছে।
এর মধ্যে ৬টি সরকারি মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংক, ৩টি সরকারি মালিকানাধীন বিশেষায়িত ব্যাংক, ৪৩টি বেসরকারি মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংক এবং ৯টি বিদেশি ব্যাংকের শাখা চালু আছে। এছাড়াও তফশিলিভুক্ত নয় এমন ৫টি ব্যাংকও চালু আছে। এর বাইরে প্রায় ৩৪টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানও এই খাতে অবদান রেখে চলেছে। সব মিলিয়ে দেশে বিরাজ করছে বিশাল আকৃতির এক ব্যাংকিং খাত যা অন্যান্য খাতের মতো স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরের এক উল্লেখযোগ্য অর্জন।
বঙ্গবন্ধুর সিদ্ধান্ত আবারও সঠিক হলো
বঙ্গবন্ধু দেশের ব্যাংকিং খাতকে জাতীয়করণ করে যথেষ্ট দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছিলেন। দেশের ব্যাংকিং খাত মূলত সরকারি মালিকানাধীন থাকা উচিত। বঙ্গবন্ধুর এমন সিদ্ধান্তে অনেকেই সমালোচনা করলেও এতদিন পরে এসে আবারও প্রমাণিত হয়েছে যে, বঙ্গবন্ধুর সিদ্ধান্তই সঠিক ছিল।
কিছুদিন আগে লন্ডন থেকে প্রকাশিত দি ব্যাংকার ম্যাগাজিন সমগ্র বিশ্বের সেরা ব্যাংকের একটি তালিকা প্রকাশ করছে। সেই তালিকায় দেখা গেল বিশ্বের সেরা বিশটি ব্যাংকের মধ্যে নয়টি ব্যাংকই চায়নিজ ব্যাংক। আর চায়নিজ ব্যাংক সবই রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন। এমনকি ব্যাংকিং খাতে সেরা পারফরমেন্স করেছে এমন দশটি দেশের প্রথম দেশটি হচ্ছে চীন। যেখানে আছে সরকারি মালিকানাধীন সব ব্যাংক। সঠিকভাবে পরিচালনা করতে পারলে সরকারি মালিকানাধীন ব্যাংকও সবচেয়ে ভালো ব্যাবসা করতে পারে তার বড় দৃষ্টান্ত সাম্প্রতিককালের চায়নিজ ব্যাংকের সফল পারফরমেন্স। ব্যা
ক হচ্ছে মানুষের অর্থের জিম্মাদার। আর এই অর্থের জিম্মাদারের দায়িত্ব বেসরকারি খাতে থাকা কতটা যুক্তিযুক্ত বা ঝুঁকিপূর্ণ তা ইতোমধ্যে প্রমাণিতও হয়েছে। আর এই কারণেই যখনই কোনো ব্যাংক সমস্যায় পড়েছে তখনই তাকে উদ্ধার করার জন্য সরকারকে এগিয়ে আসতে হয়েছে; তা সে উন্নত বিশ্ব হোক আর উন্নয়নশীল বিশ্বই হোক। উন্নত বিশ্বে কথায় কথায় বিভিন্ন কোম্পানি বা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান দেউলিয়া ঘোষিত হয়।
অথচ কোনো ব্যাংক দেউলিয়ার হওয়ার খবর খুব একটা শোনা যায় না। এর বড় কারণ হচ্ছে সরকার সব সময় এসব ব্যাংকের পিছনে রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে। আমাদের দেশও এর ব্যতিক্রম নয়। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে আমাদের দেশের সরকারও অনেক ব্যাংককে রক্ষা করতে এগিয়ে এসেছে। আগের আল বারাকা ব্যাংক বর্তমানের ওরিয়েন্টাল ব্যাংক এর বড় উদাহরণ।
এমনকি আজকের যে ইস্টার্ন ব্যাংক সেটিও এক সময় এক বিদেশি ব্যাংকের শাখা ছিল এবং একদিন ব্যংক অব ইংল্যান্ডের নির্দেশে হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেলে সরকারকেই এগিয়ে এসে সেই বিদেশি ব্যাংকের শাখাকে উদ্ধার করে দেশীয় ইস্টার্ন ব্যাংকে রূপান্তর করে। সেই বিবেচনায় সরকারি এবং বেসরকারি সব রকমের ব্যাংকের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ মালিকানা থাকে সরকারের কাছেই। সেদিক থেকে বিবেচনা করলে দেশের ব্যাংকিং খাতকে জাতীয়করণের অধীনে রাখার বঙ্গবন্ধুর সিদ্ধান্ত যে যথার্থ ছিল তা আবারও প্রমাণিত হয়েছে।
পঞ্চাশ বছরে ব্যাংকিং খাতের পারফরমেন্স
একটি দেশের ব্যাংকিং খাত কেমন আকার ধারণ করেছে তা শুধু ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা দ্বারা বিবেচনা করা যায় না। ব্যাংকের সংখ্যার সঙ্গে সঙ্গে যদি তার কার্যক্রমের পরিধি আনুপাতিক হারে বৃদ্ধি পায় তখনই বলা যেতে পারে যে, দেশের ব্যাংকিং খাতের উল্লেখযোগ্য আগ্রগতি সাধিত হয়েছে। ঠিক তেমনটাই ঘটেছে আমাদের দেশের ব্যাংকিং খাতে। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে আমাদের দেশে শুধু ব্যাংকের সংখ্যা বেড়েছে তাই নয়। এর সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধি পেয়েছে ব্যাংকিং পারফরমেন্সের দুটো উল্লেখযোগ্য দিক। তা হলো- একটি সঞ্চয় বা আমানত সংগ্রহ এবং আরেকটি ঋণ বিতরণ।
সন্তোষজনক ব্যাংক আমানত বৃদ্ধি
দেশ এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন হয়েছে। দেশের সরকার এবং মানুষের কাছে পোড়ামাটি ছাড়া আর কিছুই ছিল না। অথচ দেশের অর্থনীতি সচল করার জন্য মূলধনের প্রয়োজন, যার একটি অংশ আসে দেশীয় সঞ্চয় বা আমানত সংগ্রহের মধ্য দিয়ে। স্বাধীনতার পর পরই বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের সরকার আমাদের দেশের ব্যাংকিং খাতকে সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে পেরেছিল এবং ফলে খুব অল্পদিনের মধ্যেই আমাদের দেশে ব্যাংক আমানত সন্তোষজনকভাবেই বৃদ্ধি পেতে থাকে।
১৯৭৫ সালে যখন বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় তখনও সঞ্চয় এবং জিডিপি অনুপাত ছিল ৭.৯০%। দেশের টেকসই অর্থনীতির জন্য দেশের এই সঞ্চয় হার মোটেই সন্তোষজনক না হলেও, সদ্য স্বাধীনতা লাভ করা এবং যুদ্ধ বিধ্বস্ত একটি দেশের জন্য এই সঞ্চয় যথেষ্টই আশাব্যঞ্জক। পাকিস্তান থেকে প্রাপ্ত সীমিত আকারের ব্যাংকিং খাত দিয়ে এরকম সঞ্চয় সংগ্রহ অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে এবং এই সাফল্য সম্ভব হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর সাহসী নেতৃত্ব এবং দিকনির্দেশনার কারণে।
স্বাধীনতার পরপরই বঙ্গবন্ধু দেশের ব্যংকিং খাত বিনির্মাণে মেধাবী, যোগ্য এবং উপযুক্ত ব্যক্তিদের নিয়োগ দিয়েছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকে এবং তাদের অক্লান্ত পরিশ্রমের কারণে খুব অল্পসময়ের মধ্যে দেশের ব্যাংকিং খাতকে একটি ভালো অবস্থায় দাঁড় করানো সম্ভব হয়। তাদের অনেকে পরবর্তী সময়ে বিশ্বের অন্যান্য দেশের ব্যাংকিং খাত পুনর্গঠনে অবদান রেখে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যথেষ্টই প্রশংসিত হয়েছেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পট পরিবর্তনের পর যারা রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিলেন তারা জনগণের মধ্যে সঞ্চয়স্পৃহা জাগাতে সক্ষম হননি মোটেই। কেননা ১৯৭৫ থেকে ১৯৮০ সালের ব্যবধানে দেশীয় সঞ্চয় জিডিপির অনুপাত তেমন বৃদ্ধি পায়নি বললেই চলে অর্থাৎ এই হার বৃদ্ধি পেয়েছে মাত্র ০.৪৫%।
গত শতকের আশির দশকে এসে দেশের ব্যাংকিং খাতে এক নতুন মাত্রা যোগ হয়। দেশে শুরু হয় বেসরকারি ব্যাংকের অগ্রযাত্রা। ১৯৮০ থেকে ১৯৯০ সালের সময়ে দেশে বেশ কটি বেসরকারি ব্যাংক কার্যক্রম শুরু করে। ফলে এই সময়ে দেশে সঞ্চয় এবং জিডিপির অনুপাত বৃদ্ধি পেতে থাকে সন্তোষজনক হারে। এক দশকে এই সঞ্চয় হার বৃদ্ধি পায় ৬.৪৩% অর্থাৎ ৮.৩৫% থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ১২.৯৮% এসে দাঁড়ায়। পরবর্তীকালে দেশের অর্থনীতির ধারাবাহিক উন্নতি, মানুষের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি এবং জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশীয় সঞ্চয় বা ব্যাংক আমানত বৃদ্ধির হার সন্তোষজনকভাবে বৃদ্ধি পেলেও এর মাত্রা আন্তর্জাতিক মানকেও ছাড়িয়ে যায় বিগত পনেরো বছরে যখন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার সফল নেতৃত্বে দেশ এগিয়ে চলছে সবদিক থেকে।
এই সময় দেশের সঞ্চয় এবং জিডিপির অনুপাত এসে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫৭.৩৯%। এই অনুপাত যখন ৩০% অতিক্রম করে তখন সেই দেশের অর্থনীতিতে মূলধন জোগানের নিজস্ব সক্ষমতা বেড়ে যায় অনেকগুণ। এমনকি সেই দেশ তখন নিজস্ব অর্থায়নে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড সম্পন্ন করতে পারে। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুসহ অনেক মেগা প্রকল্প হাতে নেয়া এবং তা সম্পন্ন করার কাজ দ্রুত গতিতে এগিয়ে নেয়া সেই সাক্ষ্যই দেয়। দেশের ব্যাংক আমানত হার এত ব্যাপক বৃদ্ধি পাওয়ার ক্ষেত্রে দেশের বেসরকারি ব্যাংকের ব্যাপক প্রসার ভালো ভূমিকা রেখেছে।
দেশের ব্যাংক আমানতের এমন সন্তোষজনক বৃদ্ধির কারণে উন্নত দেশের মতো ব্যাংক আমানতের উপর প্রদত্ত সুদের হার ক্রমাগত হ্রাস পেতে শুরু করেছে। এই প্রবণতা দেশে মূলধন জোগান সহজলভ্য এবং সাশ্রয়ী করে তুলবে নিশ্চয়ই। কিন্তু সেইসঙ্গে আমানতকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এবং মানুষের মধ্যে সঞ্চয়স্পৃহা হ্রাস পেতে পারে। তাই দেশের মানুষের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার স্বার্থে বিকল্প কিছু ব্যবস্থা যেমন সব মানুষের জন্য পেনশন বা সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু করা প্রয়োজন। তা না-হলে মানুষ সঞ্চয়বিমুখ হয়ে ভোগবাদী জাতিতে পরিণত হতে পারে এবং সেক্ষেত্রে অবসর জীবনে বা বৃদ্ধ বয়েসে এসে মারাত্মক সমস্যায় পড়তে পারে।
গণমানুষের ব্যাংকহিসাব দরকার
বিগত পঞ্চাশ বছরে দেশে ব্যাংক খাতের ব্যাপক প্রসার ঘটেছে এবং ব্যাংক আমানত ও জিডিপি অনুপাত সন্তোষজনক হারে বৃদ্ধি পেলেও দেশের গণমানুষকে এখনও পুরোপুরি ব্যাংকের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা সম্ভব হয়নি। দেশের অধিকাংশ মানুষ এখনও ব্যাংকে হিসাব খুলে লেনদেন করে না। সামান্য সংখ্যক মানুষের মধ্যেই এখনও ব্যাংকিং সেবা আটকে আছে।
২০০৪ সালে প্রতি হাজার সাবালক মানুষের মধ্যে মাত্র ২৪৮ জন ব্যাংকহিসাব খুলে লেনদেন করে এবং সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ৬৩৫-এ দাঁড়ায় ২০১৫ সালে এবং ৭১৫ জনে দাঁড়ায় ২০১৭ সালে। দেশে ব্যাংকিং কার্যক্রমের এত ব্যাপক প্রসারের পরও এত নগণ্য সংখ্যক মানুষের ব্যাংকে হিসাব থাকা ভালো লক্ষণ নয়। যেখানে উন্নত বিশ্বে শতভাগ মানুষ ব্যাংকে হিসাব খুলে থাকে। এমনকি আধুনিক জীবনে ব্যাংকে হিসাব না খুলে এক মুহূর্তও চলা সম্ভব নয়। আমাদের দেশে এই নগণ্য সংখ্যক মানুষের ব্যাংকে হিসাব থাকার পিছনে অনেক কারণের মধ্যে ব্যাংকিংসেবার চেয়ে নন-ব্যাংকিং সেবার অধিকমাত্রায় জনপ্রিয় হয়ে ওঠা।
যেমন বিকাশ, নগদ বা এজেন্ট ব্যাংকিং এবং এমনকি ব্যাংকহিসাব না থেকেও মোবাইল ব্যাংকিং সেবা জনপ্রিয় হয়ে ওঠার কারণে মানুষ এখন আর ব্যাংকে হিসাব খোলার প্রয়োজনীয়তা বোধ করে না। মানুষ তাদের নিত্যদিনের লেনদেন এসব নন-ব্যাংকিং সেবার মাধ্যমে সম্পন্ন করতে পারে বিধায় তারা আর ব্যাংকে হিসাব খুলতে চায় না। এই একই কারণে বিগত গভর্নরের সময় মাত্র দশ টাকা দিয়ে ব্যাংকে কৃষকদের হিসাব খোলার সুযোগ করে দেয়ার পরও দেশের অধিকাংশ মানুষকে ব্যাংকের লেনদেনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা সম্ভব হয়নি। এই ব্যবস্থা নিশ্চয়ই দেশের অর্থনীতির জন্য দীর্ঘ মেয়াদে ভালো ফল বয়ে আনবে না। এ ব্যাপারে এখনই কিছু পদক্ষেপ নেয়ার সময় এসেছে।
নিয়ম বা বাধ্যতামূলক করে দিতে হবে যেকোনো রকম আর্থিক লেনদেন তা সে বিকাশ বা নগদ হোক কিংবা মোবাইল ব্যাংকিংই হোক তা পেতে হলে গ্রাহকের কোনো না কোনো ব্যাংকে হিসাব থাকতে হবে। মোটকথা, দেশের প্রত্যেক নাগরিক যাদেরই কোনোরকম আর্থিক কর্মকাণ্ড থাকবে তাদের সবকে কোনো না কোনো ব্যাংকে হিসাব থাকতে হবে। এই ব্যবস্থা যত দ্রুত চালু করা যায় ততই দেশের অর্থনীতির এবং ব্যাংকিং খাতের জান্য মঙ্গল।
ব্যক্তি খাতে ব্যাংক ঋণের প্রসার
আমাদের দেশের ব্যাংকিং কার্যক্রম মূলত সঞ্চয় সংগ্রহ এবং ঋণদানের মধ্যেই বেশি সীমাবদ্ধ। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে দেশের ব্যাংকিং খাত যেভাবে এগিয়েছে তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বেসরকারি খাতে ব্যাংক ঋণের প্রসারও সেভাবেই ঘটেছে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল এবং বিশ্বব্যাংকের তথ্যভাণ্ডার (ডাটা সোর্স) এফএস, এএসটি, পিআরভিটি, জিডি, জেডএস থেকে জানা যায় যে, ১৯৭৫ সালে ব্যক্তিখাতে ঋণ এবং জিডিপির অনুপাত ছিল ১.৯২%। এই অনুপাত পরবর্তী বছরে প্রায় ৩.৮৫% বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৫.৭৭%। এই সময়ে দেশে ব্যবসা-বাণিজ্যের তেমন প্রসার ঘটেনি। ব্যাংকের সংখ্যাও সেভাবে বৃদ্ধি পায়নি। বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নির্মমভাবে নিহত হবার পর দেশ এক ভয়ংকর সংকটকাল অতিক্রম করছিল।
এহেন পরিস্থিতিতে দেশের ব্যাংকঋণের প্রসার কোনোভাবেই অর্থনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না। এর পিছনে একটি মাত্র কারণ ছিল যে, সেই সময়ের ক্ষমতাসীন সামরিক সরকার খুব দ্রুত বিপথগামী রাজনীতিবিদদের দলে ভিড়ানোর জন্য একটি সস্তা স্লোগান চালু করেছিলেন যে, ‘অর্থ কোনো সমস্যা নয়’। আর এই অর্থ সহজ করার জন্য ব্যাংকঋণ অবারিত করে দেয়া হয়।
বিশেষ করে শিল্পব্যাংক এবং শিল্পঋণ সংস্থা থেকে দেশে শিল্প স্থাপনের নাম করে দেদার ব্যাংকঋণ দেয়া হয় যা মূলত ব্যক্তিখাতে ব্যাংকঋণ এবং জিডিপির অনুপাত বাড়িয়ে দেয়। আর এখান থেকেই শুরু হয় রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যাংকঋণ দানের সংস্কৃতি যার ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং এর বর্ধিত উত্তরাধিকার দায়ও বর্তমান সরকারকেই নিতে হচ্ছে। গত শতাব্দীর আশির দশকে দেশে বেসরকারি ব্যাংকিং খাতের দ্রুত প্রসার ঘটার সঙ্গে দেশে ব্যাংক ঋণের পরিমাণও বেড়েছে অনেকগুণ। ১৯৮০-এর দশকে ব্যাংকঋণ এবং জিডিপি অনুপাত বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ১৩.২২%। এই বৃদ্ধির হার ১৯৯১-৯৫ বিএনপি শাসনামলে প্রায় একই রাখে।
১৯৭৫ সালের পর বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ প্রথমবারের মতো ১৯৯৬ সালে রাষ্ট্রক্ষমতায় এসে এই ব্যাংক ঋণের লাগাম অনেকটাই টেনে ধরতে সক্ষম হয়েছিল এবং আওয়ামী লীগের সেই পাঁচ বছরের শাসনামলে ব্যাংকঋণ এবং জিডিপি অনুপাত বৃদ্ধি পেয়েছিল মাত্র ৩.৩০% অর্থাৎ এই হার ১৯৯৫ সালের ২০.৮৮% থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২০০১ সালে এসে দাঁড়িয়েছিল ২৪.১৮%।
বিগত দেড় যুগ ধরে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকায় ব্যাপক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড হাতে নেয়া হয়। দেশের ব্যাবসা-বাণিজ্য, আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে এবং শিল্পায়নে গতি আসার কারণে দেশে ব্যাংকঋণের ব্যাপক প্রসার ঘটে ফলে ব্যাংকঋণ এবং জিডিপি অনুপাত বৃদ্ধি পেয়ে ২০১৭ সালে এসে দাঁড়ায় ৪৭.৮৮% যা দেশের ব্যাংক খাতের দ্রুত অগ্রগতিরই সাক্ষ্য বহন করে। ২০২০ সালে এই অনুপাত অবশ্য কিছুটা হ্রাস পেয়ে ৪৫.২৫% তে নেমে আসে। এর মূল কারণ করোনা ভাইরাসে বিপর্যস্ত বিশ্ব অর্থনীতির কারণে দেশের অর্থনীতিও ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং ব্যাবসা-বাণিজ্যের সব ক্ষেত্রে এক ধরনেরর স্থবিরতা নেমে আসে এবং এর প্রভাবে ব্যাংকঋণও সংকুচিত হয় যায়।
ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ
আমাদের দেশের স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে ব্যাংকিং খাতের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে খেলাপি ঋণের পরিমাণও বৃদ্ধি পেয়েছে আশঙ্কাজনকভাবে। তবে স্বাধীনতার শুরুর দিকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ তেমন ছিল না। ব্যাংক ঋণের এই খারাপ প্র্যাকটিস শুরু হয় মূলত স্বৈরাচারী শাসনামল থেকে যা পরবর্তী সময়ে ক্রমবর্ধমান বৃদ্ধি পেয়ে এক ভয়ংকর ব্যধিতে পরিণত হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ১৯৯১ সালে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৪৬.৫৪ হাজার কোটি টাকা যা মোট প্রদত্ত ঋণের ২৫%। এই খেলাপি ঋণের পরিমাণ পরবর্তী দশ বছর ক্রমেই বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং ২০০১ সালে বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ২৩৫.৯৯ হাজার কোটি টাকা যা মোট ঋণের ৩১.৫০%। ২০০১ সালের পর থেকে এই খেলাপি ঋণের পরিমাণ ক্রমান্বয়ে কমতে থাকে এবং ২০১১ সালে এসে দাঁড়ায় ২৪৩.৮০ হাজার কোটি টাকা অর্থাৎ ৬,৫৯%। এই হার যদিও কিঞ্চিত বৃদ্ধি পেয়ে ২০২১ সালে এসে দাঁড়ায় ৮.৬১% কিন্তু মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২০১১ সালের ২৪৩.৮০ হাজার কোটি টাকা থেকে হ্রাস পেয়ে ৯৮.১৬ হাজার কোটি টাকায় উপনীত হয়।
ওই সূত্রে আরও জানা যায়, ১৯৯০ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত যে অস্বাভাবিক খেলাপি ঋণের পরিমাণ দেখা দেয় এর পিছনে কিছু বাস্তব কারণ এবং কিছু কাগুজে গড়মিল আছে। ১৯৮০-এর দশকের শুরু থেকে বেসরকারি ব্যাংক প্রতিষ্ঠার পর নির্বিচারে ঋণ বিতরণ করা হয়েছে যার বড় একটি অংশ পরবর্তীকালে খেলাপি ঋণে রূপান্তরিত হয়।
তাছাড়া সামরিক শাসনামলে বিশেষ করে জিয়াউর রহমানের সময় ‘অর্থ কোনো সমস্যা নয়’ (মানি ইজ নো প্রবলেম) স্লোগানের অধীনে যেসব রাজনৈতিক ঋণ বিতরণ করা হয়েছিল তার অধিকাংশই এই নব্বইয়ের দশকে এসে খেলাপি ঋণে পরিণত হয়। তাছাড়া গত শতাব্দীর আশির দশকের মাঝামাঝি দেশের ফিন্যান্সিয়াল সেক্টর রিফর্ম প্রোগ্রাম হাতে নেয়া হয়। আর এই রিফর্ম প্রোগ্রামের অধীনে সিএল বা ক্লাসিফিকেশন অব লোন অর্থাৎ ঋণের শ্রেণিবিন্যাস চালু করা হয়। এই সিএল রিপোর্ট যখন ১৯৯০-এর দশকের প্রথম দিকে যখন তৈরি করা তখন তা সঠিকভাবে নিরূপণ করা হয়নি।
বলা চলে নব্বইয়ের দশকের পুরোটাই এক ধরনের পরীক্ষামূলক পদ্ধতিতেই এই রিপোর্ট তৈরি করা হয়। ফলে এই সময়ে সিএল রিপোর্টে যে পরিমাণ খেলাপি ঋণ প্রদর্শন করা করা হয়েছে তা প্রকৃত খেলাপি ঋণের চিত্র তুলে ধরেনি। বিগত দেড় যুগে দেশে বিচ্ছিন্ন কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটলেও সার্বিক খেলাপি ঋণের পরিমাণ হ্রাস পেয়ছে এবং মোট ঋণের দশ শতাংশের নিচেই বিরাজ করছে। যদি একটি মানসম্পন্ন ব্যাংকিং ব্যবস্থার জন্য এই খেলাপি ঋণের হার পাঁচ শতাংশের নিচে থাকা বাঞ্ছনীয় কিন্তু উন্নয়নশীল দেশে সঠিক খেলাপি ঋণ ব্যবস্থাপনার অভাবে সেটি সম্ভব হয় না। তবে এই হার দশ শতাংশের নিচে রাখতে পারলেও তা সন্তোষজনক হিসাবেই বিবেচনা করা হয়। অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যেও এই খেলাপি ঋণের হার দশ শতাংশের নিচে রাখার পেছনে বাংলাদেশ ব্যাংকের যথেষ্টই অবদান আছে।
তারা ঋণ পুনঃতফশিল এবং বৃহৎ ঋণ রি-স্ক্রাকচার করার অস্ত্র ভালোভাবেই ব্যবহার করতে সফল হয়েছে। তবে আধুনিক ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনার অধীনে সিএলের মাধ্যমে খেলাপি ঋণ নির্ণয় কতটা বস্তবস্মমত তা নিয়ে যথেষ্টই সন্দেহের অবকাশ আছে। আর এ কারণেই দেশে প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ অনেক বেশি হলেও অবাক হবার কিছু থাকবে না। বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংকের ভেবে দেখা উচিত।
আত্মতুষ্টির সুযোগ নেই
স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে আমাদের ব্যাংকিং খাতে যে অগ্রগতি সাধিত হয়েছে তা এক কথায় অভাবনীয়। কিন্তু এতে আত্মতুষ্টির কোনো সুযোগ নেই। কেননা দেশের অভ্যন্তরে এর অগ্রগতি সাধিত হলেও আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী যথেষ্টেই পিছিয়ে আছে। অথচ সুনির্দিষ্ট কিছু পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে আমাদের দেশের ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনে খুব সহজেই এই খাতকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব।
দেশের ব্যাংকিং খাতকে বলা হয় অর্থনীতিতে অর্থ সঞ্চালনের ধমনি। দেশের অর্থনীতি খুব দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছে কারণ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের সরকার ক্রমাগত স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি, দীর্ঘমেয়াদি এবং শতবর্ষব্যাপী ডেল্টা পরিকল্পনা হাতে নিয়ছে। এসব প্রকল্প সফলভাবে বাস্তবায়ন করতে দেশে অবশ্যই আধুনিক ও টেকসই ব্যাংকিং ব্যাবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
অনেক আলোচনা ও সমালোচনা সত্ত্বেও এটি একটি বাস্তব সত্য যে, দেশে রয়েছে বৃহত্তম ব্যাংকিং খাত যেখানে প্রায় অর্ধশতাধিক বাণিজ্যিক ব্যাংক এবং প্রায় শতাধিক নন ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান চালু আছে। কিন্তু ব্যাংক পরিচালনায় সুশৃঙ্খল নিয়ম ও পদ্ধতি অনুসরণের ক্ষেত্রে যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। আর এই নিয়মনীতি অনুসরণে যথেষ্ট শৈথিল্যের কারণেই আমাদের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর গ্রহণযোগ্যতা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে অনেক নিচে নেমে গেছে।
বৈদেশিক লেনদেন পরিশোধে আমাদের ব্যাংকগুলোর যথেষ্ট সুনাম রয়েছে। দুএকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা বাদ দিলে আমাদের দেশের ব্যাংক ঋণপত্র খুলে বা ব্যাংক গ্যারান্টি ইস্যু করে তার বিপরীতে অর্থ পরিশোধ করেনি এমন নজির বিরল। এতৎসত্ত্বেও আমাদের ব্যাংকগুলোর ইস্যুকৃত ঋণপত্র বা গ্যারান্টি উন্নত বিশ্বে গৃহীত হতে চায় না। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধিসহ দেশের রেটিং উন্নত হলেও দেশের ব্যাংকগুলোর রেটিং নিম্নগামী। ফলে অধিকাংশ ব্যাংক কাউনটার পার্টি লিমিট তো দূরের কথা, করসপনডেনট সম্পর্কও অনেক ক্ষেত্রে টিকিয়ে রাখতে পারছে না।
অথচ বর্তমানে দেশের ব্যাংকিং ব্যাবস্থাকে আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং এর সঙ্গে সম্পৃক্ত করার উদ্যোগ নেয়া একান্ত জরুরি। কাজটা যে খুব কঠিন তা নয়, কেননা এজন্য যেসব অর্থনৈতিক পূর্বশর্তের প্রয়োজন, তার অধিকাংশই বর্তমানে অনুকূলে আছে। যেখানে ব্যাসেল তিন পর্যন্ত বাস্তবায়িত হতে চলছে, সেখানে দেশের ব্যাংকিং খাতকে কেন আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের কাছাকাছি নেয়া যাবে না? অবশ্যই যাবে, প্রয়োজন শুধু কিছু যুগোপযোগী ও কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ।
খেলাপি ঋণে সমাধান প্রয়োজন
আমাদের দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ একটি বড় সমস্যা এবং এই খেলাপি ঋণের পরিমাণ ক্রমাগত উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়ে চলছে। খেলাপি ঋণনির্ণয় করা হয় সিএল (ঋণ শ্রেণিবিন্যাস) পদ্ধতি অনুসরণ করে। এই সিএল প্রচলিত হয়েছিল গত শতকের আশির দশকে এবং তাও কিছু বিদেশি বিশেষজ্ঞের সুপারিশের ভিত্তিতে। এই সিএল এবং এর প্যারামিটারগুলো যেভাবে নির্ধারণ করা হয়েছিল তা অনেক ভালো ঋণকেও যেমন খেলাপি ঋণে রূপান্তর করে, আবার অনেক খারাপ ঋণকেও ভালো ঋণের কাতারে ফেলে দেয়। আমাদের দেশের অনেক বিশেষজ্ঞ ব্যাংকার একটা কথা প্রায়শই বলে থাকেন যে, ব্যাংকগুলো ঋণের টাকা ফেরত চাইলে ঋণ গ্রহীতারা তা ফেরত দিতে পারবে না।
বিশ্বের কোনো দেশের ঋণ গ্রহীতাই ঋণের অর্থ ঋণ প্রদানকারী আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে চাহিবামাত্র ফেরত দিতে পারবে না। আমেরিকা-কানাডায় যে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের ক্রেডিট কার্ড ঋণ, বন্ধকী (মর্টগেজ) ঋণ বা ব্যবসায়িক ঋণ রয়েছে তা যদি এখানকার আর্থিক প্রতিষ্ঠান তাদের গ্রাহকদের ফেরত দিতে বলে, তাহলে শুধু সেই ঋণগ্রহীতা নয়, পুরো দেশ দেউলিয়া হয়ে যাবার উপক্রম হবে। আর সে কারণেই তারা কখনও প্রদত্ত ঋণের টাকা ফেরত চাওয়ার কথা ভাবে না বা তার ভিত্তিতে খেলাপি ঋণও নির্ধারণ করে না।
উল্লেখ্য, কোনো মেয়াদি (টার্ম) ঋণের ক্ষেত্রে মেয়াদপূর্তিতে অন্য আরেকটি নতুন মেয়াদি ঋণ নিয়ে আগের ঋণ পরিশোধ করে দেয়, যাকে এই দেশের ব্যাংকিং পরিভাষায় নতুন ডিল ক্লোজ করে পুরাতন ডিল টারমিনেট করা বলা হয়ে থাকে। কোনো প্রকল্প শেষ হয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে বিষয়টা অবশ্য ভিন্ন। তবে এসব দেশের ব্যাংকগুলো একটি বিষয় নিশ্চিত করে থাকে যে, ঋণের উপর ধার্যকৃত সুদসহ প্রতিমাসের ন্যূনতম প্রদেয় অর্থ সত্যিকারভাবেই ব্যাংকে পরিশোধ করতে হবে, আর এর উপর ভিত্তি করেই ভালো বা মন্দ ঋণ নিরূপণ করা হয়ে থাকে। একবার খেলাপি ঋণ চিহ্নিত হওয়ামাত্র পুরো ঋণের পরিমাণ প্রভিশন করে ফেলা হয়। এই প্রচলন আমাদের দেশের ব্যাংকিং ব্যাবস্থায় একেবারেই অনুপস্থিত।
করপোরেট গভরনেন্সের প্রয়োগ প্রয়োজন
ব্যাংক পরিচালনার ক্ষেত্রে করপোরেট গভরনেন্স মোটেই সন্তোষজনক নয়। ব্যাংকের পরিচালনাপর্ষদে পেশাদার লোকের অন্তর্ভুক্তি নেই বললেই চলে। পরিচালনা পর্ষদনীতি প্রণয়নের চেয়ে ঋণ অনুমোদনসহ নানাবিধ দৈনন্দিন কাজেই বেশি তৎপর থাকে যা করপোরেট গভরনেন্সে পরিপন্থি। বর্তমানে অনলাইন ব্যাংকিংয়ের যুগে পুরো ব্যাংকিং ব্যবস্থা প্রযুক্তিনির্ভর বা অটোমেশনের আওতায় নিয়ে আসা, রিয়াল টাইম রিকনসিলিয়েশনের প্রবর্তনসহ অনেক পদক্ষেপ গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি।
আমাদের সৌভাগ্য এই যে, এমন একজন প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে দেশ পরিচালিত হচ্ছে যিনি বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনা আমাদের দেশেই শুধু নয়, সমগ্র বিশ্বেই একজন সবচেয়ে দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ও যোগ্যতম রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে পরিচিত। তার যেকোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং তা বাস্তবায়নের ক্ষমতা সমগ্র বিশ্বেই দারুণভাবে প্রশংসিত হয়েছে।
মূলত, প্রধানমন্ত্রীর বলিষ্ঠ নেতৃত্ব, সাহসী সিদ্ধান্ত এবং সঠিক দিকনির্দেশনার কারণেই দেশের অভূতপূর্ব উন্নতি সাধিত হয়েছে এবং দেশ খুব সহসাই মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার দ্বারপ্রান্তে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনকালই হবে দেশের অর্থনীতির স্বর্ণযুগ। তাই তার বলিষ্ঠ নেতৃত্বের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে দেশের ব্যাংকিং খাতকেও আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে উপনীত করার কোনো বিকল্প নেই এবং তা খুব অনায়াসেই সম্ভব বলে আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। আর তেমনটা করতে পারলেই আমাদের স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে দেশের ব্যাংকিং খাতে যে অভূতপূর্ব উন্নতি সাধিত হয়েছে তা ষোলোকলা পূর্ণ হবে।
লেখক: ব্যাংকার, কলাম লেখক। টরনটো, কানাডা-প্রবাসী