ঢাকার দুই মেয়র প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও ছুটে বেড়াচ্ছেন। কোথাও আবর্জনা নিয়ে একজনকে কথা বলতে দেখা যাচ্ছে, অন্যজনকে হয়তো দখল করা খালের জমি উদ্ধারে তৎপরতা চালাতে দেখা যাচ্ছে। আবার পরদিনই হয়তো দেখা যাচ্ছে নটরডেম কলেজের শিক্ষার্থীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে ছাত্রদের বিক্ষোভ প্রশমিত করতে, আন্ডারপাস করার প্রতিশ্রুতি দিতে।
ঢাকার মেয়ররা কখন ঘুমান, কখন অফিসে বসেন, কখন ছোটাছুটি করেন, কখন নতুন কোনো সমস্যার সমাধানে ছুটে যান তা তারাই ভালো বলতে পারবেন। তবে গণমাধ্যমে তাদের সারাক্ষণই এখানে-সেখানে ছুটে বেড়াতে দেখা যাচ্ছে। ঢাকা শহরের দুই সিটি করপোরেশনের দুই মেয়রই দেখেশুনে মনে হচ্ছে ‘দৌড়ের ওপর’ আছেন। প্রায় দুই কোটি মানুষের বসবাসের এই মহানগরীতে দুটি সিটি করপোরেশন করা হয়েছে, আগে ছিল একটি। মেয়র ছিলেন একজন কিন্তু কোনো ডেপুটি মেয়র ছিল না। এখনও নেই।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকা শহরের নানা সমস্যার কথা বিবেচনা করে হয়তো দুটি সিটি করপোরেশনে ঢাকা মহানগরীকে বিভক্ত করে দেন। তখন এর বিরোধিতা করা হয়েছে সব মহল থেকে। তারপরও তিনি অনড় ছিলেন তার সিদ্ধান্তে। এখন মনে হয় ঢাকাকে দুটি কেন চারটি সিটি করপোরেশনে বিভক্ত করলেও বোধহয় এর নাগরিকদের জীবনে স্তূপীকৃত সমস্যার সমাধান সহজে হবার নয়। অবশ্য ২-৪ জন মেয়রই সব সমস্যার সমাধান করতে পারবেন, এমনটি ভাবলেও হবে না। সমস্যা সৃষ্টির জন্য নগরবাসীও দায় এড়াতে পারবে না। আবার জনসেবার নামে যারা নির্বাচিত প্রতিনিধি হন, তারাও যে সমানভাবে দক্ষ ও আন্তরিক সেটি নিয়েও নানা প্রশ্ন আছে।
তাছাড়া রাজধানী ঢাকা শহরে সরকারের নানা উন্নয়ন কর্মকাণ্ড প্রতিনিয়ত চলছেই। সেসব উন্নয়ন কর্মকাণ্ড সমন্বিতভাবে হচ্ছে না বলে দীর্ঘদিন থেকে অভিযোগ করা হচ্ছে। ওয়াসা রাস্তা কাটছে তো, ডেসকো রাস্তা ভরছে। আবার স্যুয়ারেজ নিয়ে সিটি করপোরেশন হাত দিচ্ছে তো নতুন মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ রেল স্থাপনের উদ্যোগ নিতে আসছে। এভাবে নানা প্রতিষ্ঠানের নানা কাজ। বিষয়টি এমন- কোনটা থামাই, কোনটা রাখি, কোনটা বাদ দেই? সবই দরকার। তাই রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি, ভরাভরি অবিরত চলছেই, ধুলাবালি উড়ছে, রাস্তা বন্ধ হচ্ছে, পথচারীদের চলাচল স্বাভাবিক থাকছে না। বৃষ্টি এলে সর্বত্রই কাদামাটি ও পানি থই থই করছে। মুহূর্তের বৃষ্টিতে সব কিছুই জলাবদ্ধতায় ডুবে যাচ্ছে। বর্ষাকালে ঢাকা শহরের অনেক অঞ্চলই ডুবে থাকে। গণপরিবহন স্বাভাবিক গতিতে চলছে না। জনদুর্ভোগ লেগেই আছে। এর জন্য দায় গিয়ে পড়ে কেষ্ট বেটা নগরপিতা তথা মেয়রের ওপর।
নগরপিতা তখন পিতা নয়, নানাজনের নানা গালিতে কুপোকাত হয়ে পড়েন। ঢাকা শহরের নগরপিতাদের এমন চিত্রায়িত হওয়ার করুণ অবস্থা দেখে অনেক সময় মায়া লাগলেও মুখ খুলে ভাব প্রকাশ করা যাবে না! এখন অনেকেই সাবেক মেয়র আনিসুল হকের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। কিন্তু তিনি যখন জীবিত ছিলেন, একইভাবে ঢাকার উত্তর সিটি করপোরেশনের সমস্যার সমাধানে ছোটাছুটি করছিলেন, তখন রাস্তায় কিংবা পরিবহনে বসে তাকেও প্রচুর গালি উপহার দিতে নগরবাসী কার্পণ্য করেনি। এখনাকার দুই মেয়রও সেই ‘পুরস্কার’ লাভে প্রতিদিন বঞ্চিত হচ্ছেন না, এটি আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি। তবুও তাদের কাজ তাদের করতেই হবে। নগরবাসী গালমন্দ করলে খুব বেশি গায়ে মাখানো যাবে না। কেননা নগরবাসীও তো স্বস্তিতে নেই।
ছোট এই মহানগরীতে এত মানুষ, এত সমস্যা। ঘর থেকে বের হলেই কোনো না কোনো ভোগান্তিতে পড়তে হয়। ঘরে ফিরেও শান্তি খুব বেশি নেই। মশার পাল দিনের বেলাতেও মানুষ দেখে ছুটে আসে কামড়াতে। সন্ধ্যা হলে মশার উৎপাত ঠেকাতে কয়েলের ধোঁয়া জ্বালিয়েও সফল হওয়া যাচ্ছে না। হাতে ব্যাট নিয়ে তাই সবাই মশা মারতে ব্যস্ত থাকছে। এই মুহূর্তে কিউলেক্স মশা ঢাকাবাসীর রাতের ঘুম কেড়ে নিতে শুরু করেছে। ঢাকা সিটি করপোরেশন মশানিধনের ওষুধ ছিটাচ্ছে কি ছিটাচ্ছে না তাও বোঝা যাচ্ছে না। কিছুতেই মশার উপদ্রব কমানো যাচ্ছে না।
ঢাকার বর্জ্য নিয়ে মানুষ অনেক বছর থেকে সমস্যায় জর্জরিত। বাসাবাড়ি থেকে প্রতিদিন বর্জ্য বাইরে ফেলা হচ্ছে। অনেক সময় যারা ফেলছেন তারা পথচারীদের যাতায়াতের রাস্তার কথা বিবেচনা করেন না। রাস্তার ওপর বাসাবাড়ির এসব বর্জ্য পদার্থ যে যার মতো করে ছুড়ে ফেলে রেখে চলে যায়। এতে মশামাছি এবং নানা ধরনের ব্যাকটেরিয়ার জন্ম হয়ে থাকে। সে কথা জানার পরও অনেকেই বর্জ্য ফেলতে দ্বিধা করেন না।
সিটি করপোরেশনের ময়লা সংগ্রহকারীরা সময়মতো না এলে রাস্তায় দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। কোথাও দুর্গন্ধ এতই বেশি ছড়িয়ে পড়ে যে, এলাকায় হাঁটা কিংবা বসবাস বেশ কষ্টের হয়ে দাঁড়ায়। অভিজাত এলাকাগুলো কিছুটা নিয়ম-শৃঙ্খলায় থাকলেও পুরাতন ঢাকা কিংবা আশপাশের অনেক এলাকায় বাসাবাড়ির বর্জ্য পদার্থ নিয়ে ছোট ছোট ময়লা আবর্জনার ভাগাড় কদিন অবস্থান করতে দেখা যায়। সিটি করপোরেশন একদিকে নিচ্ছে তো অন্যদিকে ভাগাড় তৈরি হচ্ছে।
একটি সুখবর নগরবাসীর সঙ্গে ভাগাভাগি করা যায়, আগামী দেড় বছর পর ঢাকার এসব আবাসিক ময়লা-আবর্জনা জাতির মূল্যবান সম্পদে পরিণত হতে যাচ্ছে। প্রতিদিন তিন হাজার টন বর্জ্য থেকে ৪২.৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হতে যাচ্ছে। গত ১ ডিসেম্বর ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের আওতাধীন আমিনবাজার এলাকায় চায়না মেশিনারি ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন (সিএমইসি) ৪২ দশমিক ৫ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে।
স্থানীয় সরকার ও পল্লি উন্নয়নমন্ত্রী মোঃ তাজুল ইসলাম , বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম, স্থানীয় সরকার বিভাগের সিনিয়র সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ এবং বাংলাদেশে নিযুক্ত চায়নার রাষ্ট্রদূত লি জিমিং চুক্তি স্বাক্ষরকালে উপস্থিত ছিলেন। ইনসিনারেশন পদ্ধতি বা বর্জ্য পুড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের এই প্রযুক্তির মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন বিভিন্ন দেশে আগে থেকেই হয়ে আসছে।
এখন ঢাকার উত্তর সিটি করপোরেশন উল্লিখিত মন্ত্রণালয়গুলোর সহযোগিতা নিয়ে প্ল্যান্টটিকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সহযোগিতা প্রদান করবে। এর ফলে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরশনের আবাসিক বর্জ্য পদার্থ দ্রুত অপসারণের তাগিদ থেকে সিটি করপোরেশন আবর্জনা সরিয়ে নেবে। এর মাধ্যমে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের অধিবাসীদের জীবনে বর্জ্য পদার্থের দুর্গন্ধ, মশা, মাছি ও রোগ-জীবাণু ছড়ানো থেকে মুক্তি পাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। মন্ত্রী অবশ্য আশ্বাস দিয়েছেন যে, দক্ষিণ সিটি করপোরেশনসহ দেশের সবকটি সিটি করপোরেশনেও এ ধরনের প্ল্যান্ট তৈরির মাধ্যমে আবর্জনামুক্ত হওয়া, বিদ্যুৎ উৎপাদনে কাজে লাগার পরিকল্পনায় রয়েছে। শিগগিরই সেগুলো বাস্তবায়ন করার কাজে সরকার হাত দেবে। তবে এর জন্য সময়ের যথেষ্ট দরকার হয়, প্রচুর বিনিয়োগও করতে হয়। কিন্তু এর উপকার অনেক বেশি।
একদিকে বিদ্যুৎ পাওয়া যায়, অন্যদিকে ময়লা-আবর্জনার অস্বস্তি ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ বদলে দেয়া যায়। ডিজিটাল বাংলাদেশে এটি ঘটবে এমনটি এখন আর দূরের নয়, বরং অনেক কাছেরই স্বপ্ন। ঢাকা সিটি করপোরেশনে নাগরিক সুযোগ-সুবিধার কথা অনেক আগে থেকে উচ্চারিত হলেও নানা জনের নানা স্বার্থে অনেক কিছুই বাস্তবায়িত হয়নি। অপরিকল্পিত নগরায়ণ, রাস্তাঘাট, বাড়িঘর নির্মাণ কিছুতেই যেন নিয়ম মেনে চলছে না। আবাসিক এলাকায় বড় ইমারত তৈরি হচ্ছে তাতে প্রতিবেশীদের ঘুম হারাম হয়ে যাচ্ছে। ভাবা হচ্ছে না শিশু, বৃদ্ধ ও রোগীদের কথা।
রাতদিন নির্মাণযন্ত্রের আওয়াজ মানুষের স্বস্তি কেড়ে নিচ্ছে। ধুলাবালিতে বাতাস বিষাক্ত হয়ে উঠছে। এমনিতেই ঢাকার বায়ু দূষিত হয়ে পড়েছে। ঢাকা কিছুতেই যেন মানুষের নিরাপদ স্বাস্থ্যের বসবাসের জায়গা থাকতে পারছে না। ঢাকায় আবাসিক অনাবাসিক এলাকায় নানা কেমিক্যালের গুদাম যেখানে-সেখানে বেড়ে উঠেছে। সেগুলোতে প্রায় দুর্ঘটনা ঘটছে, বড় দুর্ঘটনায় অনেক প্রাণেরও সংহার ঘটেছে। তারপরও নবনির্মিত ভবনগুলো আবাসিক কোড মেনে নির্মিত হচ্ছে না। ঢাকা শহরে ভূমিদখল, চাঁদাবাজি, মানুষের জায়গা দখল নিয়ে নানা অভিযোগ আছে।
আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী যথাযথভাবে ভূমিকা পালন করছে না। প্রভাবশালী নানা মহল নানা জায়গায় হস্তক্ষেপ করছে। সিটি করপোরেশনে হোল্ডিং ট্যাক্সসহ নানা ধরনের কর যেভাবে আদায় হচ্ছে, সেভাবে নাগরিক সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করা যাচ্ছে না। মানসম্মত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভাব লেগেই আছে। বেসরকারি হাসপাতাল এখন আবাসিক এলাকার ভেতরে প্রবেশ করেছে। এটি কতটা বিজ্ঞানসম্মত সেটি ভেবে দেখার বিষয়। অদূর ভবিষ্যতে পরিকল্পিত উপশহর বলে খ্যাত পূর্বাচলে আবাসিক, অনাবাসিক ভবন তৈরি হতে যাচ্ছে সেগুলো যেন উন্নত ভবন কোড মেনে নির্মিত হয়।
সেখানে যেন কমিউনিটি স্কুল-কলেজ, লাইব্রেরি-খেলার মাঠ, পার্ক, স্বাস্থ্য চিকিৎসার সুযোগ-সুবিধা, বিনোদনের ব্যবস্থা যথাযথভাবে থাকে সেই ব্যবস্থা রাজউক ও উত্তর সিটি করপোরেশন সমন্বিতভাবে সম্পন্ন করে, সেটি সময়ের দাবি। ঢাকাকে সবধরনের অপরাধমুক্ত নগরী হিসেবে গড়ে তোলার দায়িত্ব সিটি করপোরেশনকেও নিতে হবে। তাহলেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে চিন্তা থেকে মহানগর ঢাকায় দুটি সিটি করপোরেশন প্রতিষ্ঠা করেছেন সেটি সুফল দেবে।
ঢাকার দুই মেয়র সক্রিয় আছেন এটি স্বস্তির বিষয়। তবে পর্বতসম সমস্যার নিচে তারা চাপা পড়ে হারিয়ে যাবেন সেটি কারোরই কাম্য নয়। দুই সিটি করপোরেশনই ধীরে ধীরে সফল হবে, নাগরিক জীবনেও ধীরে ধীরে স্বস্তি ফিরে আসবে এটিই সবার প্রত্যাশা।
লেখক: গবেষক-অধ্যাপক।