স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে এসেছে গণপরিবহনে বিশেষত বাসে তাদের হাফ ভাড়া কার্যকরের জন্য। দীর্ঘদিনের অসন্তোষ এখন স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভে পরিণত হয়েছে। সাধারণ মানুষের জীবনেও নাভিশ্বাস, কারণ দ্রব্যমূল্য ক্রমাগত বাড়ছে। সাধারণ মানুষ ব্যবহার করে এমন কোনো জিনিস নেই যা চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে না। মূল্যবৃদ্ধির তালিকায় চাল-চিনি, আটা-তেলসহ খাদ্যপণ্য তো আছেই- রান্নার গ্যাস-বিদ্যুৎ, পানি সব কিছুর দাম বাড়াতে তেমন কোনো অজুহাত এখন প্রয়োজন হয় না।
ব্যবসায়ীদের আবদার এবং সরকারের অনুমোদন একটা যুগলবন্দির মতো পরিবেশ তৈরি করেছে। পরস্পর পরস্পরকে সহায়তা করে সরকার ও ব্যবসায়ীদের এই যৌথ সংগীতের মূর্ছনায় সাধারণ মানুষের মূর্ছা যাওয়ার উপক্রম। এর সঙ্গে আছে ক্ষমতাসীন দলের উচ্চপর্যায়ের নেতা-মন্ত্রীদের উপদেশ ও অপমানসূচক কথা। বিদেশিরা চাল-গম কম খায়, আমরা ভাত বেশি খাই তাই খাদ্যঘাটতি।
অতএব ভাত কম খাওয়ার পরামর্শ দেয়ার সহজ পথ বেছে নিয়েছেন তারা। কিন্তু ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট করে বাজার নিয়ন্ত্রণ এবং অন্যায় মুনাফার ব্যাপারে নীরবতা ভীষণ অর্থ বহন করে। এর পর আবার বলা হয়েছে জ্বালানি তেলের দাম কম থাকলে সব তেল ভারতে পাচার হয়ে যাবে কিন্তু সীমান্ত রক্ষায় দায়িত্ব যাদের তাদের সতর্ক না করে শাস্তি দিলেন সাধারণ মানুষকে। কৃষকরা কম দামে তেল পেলে তা কৃষি উৎপাদনে সহায়ক হতো কি না সে বিষয় কি আলোচনার অপেক্ষা রাখে?
কৃষি মন্ত্রণালয় বলেছে ডিজেলের দাম বৃদ্ধির ফলে বোরো মৌসুমে কৃষিতে ৭৫০ কোটি টাকার বেশি বাড়তি খরচ করতে হবে ধানচাষিকে। দেশের ১৬ লাখ সেচ পাম্পের ৭০ শতাংশের বেশি চলে ডিজেল দিয়ে। এতে প্রতি বিঘায় সেচ খরচ বাড়বে ৩০০ টাকার বেশি। আমন ধান কাটা শেষ। বোরো মৌসুম শুরু হবে। এই বোরো মৌসুমে দেশের ধানের ৬০ শতাংশের বেশি উৎপাদন হয়। ফলে সরকার তেলের দাম বাড়ানোর প্রভাব কৃষকের খেতে আর জনগণের পাতে সরাসরি পড়বে।
ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির ফলে বাড়িয়ে দেয়া হলো পরিবহনের ভাড়া। সরকার তেলের দাম বাড়াল ২৩ শতাংশ। পরিবহনের ব্যয়ের ক্ষেত্রে জ্বালানি তেল একমাত্র উপাদান নয়। বাস বা ট্রাকের দাম, পরিচালনা খরচ, ড্রাইভার হেলপারের বেতন, ব্যাংক ঋণ পরিশোধ, অবচয়, অদৃশ্য খরচ (বিআরটিএর ঘুষ, পুলিশ খরচ, চাঁদা ইত্যাদি), কত সিট খালি থাকে ইত্যাদিসহ ১৬ ধরনের বিষয় যুক্ত করে ভাড়া নির্ধারণ করা হয়ে থাকে বলে জানা যায়। সাধারণত মোট খরচের ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ হয়ে থাকে জ্বালানি তেলবাবদ।
এক হিসাবে দেখানো হয়েছে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির কারণে বাসের ভাড়া ৬ থেকে ৭ শতাংশ বাড়তে পারে। কিন্তু ভাড়া বাড়ানো হয়েছে ২৭ শতাংশ। ঢাকা, চট্টগ্রাম শহরে প্রতি কিলোমিটারে ৪৫ পয়সা বাড়িয়ে কিলোমিটার প্রতি ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে ২ টাকা ৫ পয়সা। কিন্তু ভাড়া তো আগেও বেশি নেয়া হতো এখন তা আরও বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে।
যেমন প্রেস ক্লাব থেকে সায়েন্স ল্যাবরেটরি পর্যন্ত দূরত্ব ৪ কিলোমিটারের বেশি নয়। বর্ধিত ভাড়া অনুযায়ী এই ভাড়া হওয়ার কথা ৮ টাকা ২০ পয়সা। কিন্তু আগে নেয়া হতো ১০ টাকা এখন তা নেয়া হচ্ছে ১৫ টাকা। সাধারণ মানুষ বাসে প্রতিদিন ঝগড়া করছেন বাড়তি ভাড়া নিয়ে। বাসের কন্ডাকটর বলছেন মালিক প্রতি ট্রিপে তার জমা বাড়িয়েছেন ১৫০০ টাকা। বেশি ভাড়া আদায় না করলে তারা এটা দেবেন কোথা থেকে? ঝগড়া কখনও রূপ নিচ্ছে মারামারিতে। যাত্রী আর পরিবহন শ্রমিক মারামারি করছেন, মুনাফা যাচ্ছে পরিবহন মালিকের পকেটে।
শিক্ষার্থীরা তুলনামুলকভাবে সংগঠিত। কলেজের সামনে থেকে বাসে ওঠে, কলেজের সামনে নেমে যায়। ফলে তারা শক্তি দেখাতে পারে। বাসের ভাড়া বৃদ্ধির কারণে প্রতিদিন একজন ছাত্রের খরচ বেড়ে গিয়েছে ৩০/৪০ টাকা। একদিকে খরচের চাপ অপরদিকে অযৌক্তিক তেলের দাম ও পরিবহন ভাড়া বৃদ্ধি তাদেরকে প্রতিবাদী করে তুলেছে।
তারা চাইছে পরিবহনে অর্ধেক ভাড়ায় যাতায়াত করার অধিকার। এটি শিক্ষার্থীদের দীর্ঘদিনের দাবি। ’৬৯ সালের ১১ দফাতেও পরিবহনে কনসেশনের দাবি ছিল। ৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময় এই দাবিতে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করেছে, কিছু ক্ষেত্রে হাফ ভাড়া চালু হয়।
আর এখন তো শিক্ষার্থীরা খবর পাচ্ছে যে, ভারত-নেপাল, শ্রীলঙ্কা-পাকিস্তানসহ অনেক দেশেই শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ পাস, টিকেট, কনসেশনের ব্যবস্থা আছে। ফ্লাইওভার, মেট্রোরেলের উন্নয়ন দেখছে যে ছাত্র, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির হিসাব পত্রিকায় পড়ছে, দুরন্ত গতিতে দেশ এগিয়ে যাওয়ার ঘোষণা শুনছে নেতাদের কাছ থেকে তাহলে শিক্ষার্থীদের, যাদের ওপর নির্ভর করবে দেশের অগ্রযাত্রা তাদের জন্য রাষ্ট্র ভর্তুকি দেবে না কেন? এই ভর্তুকির টাকা তো আসবে জনগণের কাছ থেকে।
জনগণের টাকা তাদের সন্তানদের জন্য ব্যয় করা হবে না কেন? কেন তাদের সন্তানরা পরিবহন মালিকদের মুনাফার শিকারে পরিণত হবে? শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আইডি কার্ডের সঙ্গে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এই দায়িত্ব নেয়া হবে না কেন, যাতে পরিবহন মালিকরা তাদের কাছে হাফ ভাড়া নেন। একজন ছাত্র গড়ে কতবার বাসে ওঠে, তার কাছে হাফ ভাড়া নিলে কত টাকা কম আয় হবে, এর কত অংশ সরকার দেবে, কত অংশ মালিক বহন করবে এ নিয়ে একটা সমীক্ষা করে সিদ্ধান্ত নেয়া কি খুব কঠিন বিষয়?
ছাত্র এবং পরিবহন শ্রমিক মুখোমুখি বিরোধে জড়ালে যে আর্থিক ক্ষতি ও সামাজিক অশান্তি সৃষ্টি হয় তার তুলনায় কি হাফ ভাড়া অনেক কম নয়? সরকারি-বেসরকারি স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে পরিবহন কার্ড পেতে পারে, রাষ্ট্র শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ পরিবহন বরাদ্দ দিতে পারে কি না, ৭১ হাজার ৯৫৩ কোটি টাকার শিক্ষা বাজেটে আর কত টাকা বরাদ্দ বাড়ালে পরিবহনে সাবসিডি দেয়া যায় তা নিয়ে আলোচনা করা এখন জরুরি।
প্রতিদিন সংঘাত হচ্ছে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের, কখনও কখনও আক্রান্ত হচ্ছে পরিবহন শ্রমিকরা। ভাড়া বৃদ্ধির সঙ্গে পরিবহন শ্রমিকরা যুক্ত না থাকলেও ভাড়া আদায়ের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে শ্রমিকরা যুক্ত বলে ছাত্র এবং যাত্রীদের ক্ষোভের প্রধান টার্গেট হয়ে পড়ে পরিবহন শ্রমিকরা। ফলে প্রতিদিন কিছু না কিছু অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটছে। শিক্ষার্থীরা যেমন হাফ ভাড়ায় যাতায়াত করতে চায়, তেমনি ঝগড়া ও সংঘাত থেকে পরিবহন শ্রমিকরাও পরিত্রাণ চায়। এই প্রসঙ্গে কিছু বিষয় বিবেচনা করা যেতে পারে-
১. সরকার সম্প্রতি সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিআরটিসি পরিচালিত বাসে শিক্ষার্থীদের জন্য হাফ ভাড়া নেয়া হবে। এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে কীভাবে তা জানা থাকলে আমাদের জন্য ভালো হতো। তা না হলে বিআরটিসির বাসে হাফ ভাড়া অন্য বাসগুলোতে কেন নয়- বলে উত্তেজনা আরও বাড়বে।
২. হাফ ভাড়া শিক্ষার্থীরা দেবে বাকি টাকা পূরণ করা হবে কীভাবে এবং কোন তহবিল থেকে?
৩. সারা দেশে স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া আসার ক্ষেত্রে বাস ব্যবহার করে কতজন শিক্ষার্থী? হাফ ভাড়া নিলে ভর্তুকি কত টাকা দিতে হবে?
৪. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের জন্য ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা কীভাবে কনসেশন প্রদান করে তা জানা দরকার।
৫. শিক্ষার্থীদের জন্য পরিবহন কার্ড চালু করা দরকার যা প্রতিষ্ঠান প্রদান করবে। তাহলে যাত্রী কোন প্রতিষ্ঠানের ছাত্র তা নিশ্চিত সম্ভব হবে।
৬. এ বছর শিক্ষাবাজেট ৭১ হাজার ৯৫৩ কোটি টাকা। এর সঙ্গে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মিলে মোট বাজেট দাঁড়িয়েছে ৯৪ হাজার ৮৭৭ কোটি টাকা। প্রতিবছর শিক্ষাবাজেট থেকে বেশ কিছু টাকা ফেরত যায়। ফেরত যাওয়া এই টাকাটা পরিবহন ভর্তুকি হিসেবে দেয়া যেতে পারে।
৭. যে সমস্ত পরিবহন শিক্ষার্থীদের জন্য হাফ ভাড়া কার্যকর করবে, তাদের জন্য বিশেষ প্রণোদনার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
৮. দেশের ছাত্রসমাজের প্রতি রাষ্ট্রের দায়িত্ব আছে। তাদের শিক্ষা সহায়ক কর্মসূচির অংশ হিসেবে পরিবহনে সাবসিডি দেয়া এবং একটি যুক্তিসংগত নিয়ম-বিধি প্রণয়ন করা হলে তা ছাত্র এবং পরিবহন শ্রমিক উভয়ের জন্য মঙ্গলজনক।
৯. দেশের বড় শহরগুলোর মধ্যে ঢাকা এবং চট্টগ্রামে নগর পরিবহন আছে আবার এই দুই শহরেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং ছাত্রসংখ্যা বেশি। বাকি সারা দেশে সাধারণত স্বল্প দূরত্বে শিক্ষার্থীরা বাসে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাওয়া-আসা করে। এই বিষয়টি বিবেচনায় রেখে পরিবহন সহায়তার জন্য বাজেটে থোক বরাদ্দ করা যেতে পারে।
১০. বিভিন্ন সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে পরিবহন ফি নেয়া হয়। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বেতন ও ফি বেশি। উভয়ক্ষেত্রেই যারা গণপরিবহনে যাতায়াত করে তাদের কাছ থেকে নেয়া পরিবহন ফি এবং সরকারপ্রদত্ত বরাদ্দ দিয়ে একটি কেন্দ্রীয় তহবিল গঠন করা যেতে পারে।
১১. সরকার, পরিবহন মালিক, শ্রমিক ও ছাত্র প্রতিনিধি সমন্বয়ে মনিটরিং সেল গঠন করা যেতে পারে। তাহলে যেকোনো উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সহজেই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে।
লেখক: রাজনীতিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক।