দেশে মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তী পালিত হচ্ছে, চলছে মুজিব জন্মশতবার্ষিকী। যারা ভাষা আন্দোলন, অন্যান্য গণতান্ত্রিক সংগ্রাম ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ করেছে এবং আজও বেঁচে আছে তাদের জন্য এই সুবর্ণজয়ন্তী বিশেষ তাৎপর্যের। যারা মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশ না নিলেও- এর প্রতি সমর্থন দিয়েছে, পৃথিবীর নানা দেশে অবস্থান করা সত্ত্বেও উদারভাবে সহযোগিতা করেছে; তারাও নিজ সাধ্য ও সামর্থ্য অনুযায়ী গর্ব এবং উদ্দীপনার সঙ্গে বছরটি উদযাপন করছে। দেশের জন্য এটি একটি স্মরণীয় বিষয়। তাই এর অংশ হতে পারা নিঃসন্দেহে বিশেষ আনন্দের।
করোনা অবশ্য এখনও পিছু ছাড়েনি। দেড় বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এর প্রকোপ বেড়েই চলেছে। অনেক জায়গায় করোনা ভাইরাস আবার নতুন ধরনের লক্ষণসহ ভীতিকর পরিবেশ গড়ে তুলছে। তবে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে করোনার প্রকোপ ক্রমশ কমে আসায় ও ব্যাপক হারে ভ্যাকসিন দেয়ায় কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলা যাচ্ছে। তবু নিরুদ্বেগ হওয়ার সময় এখনও আসেনি। পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য উন্নতি হতে আরও সময় লাগতে পারে।
দেশে করোনা কমছে তাই নয়, ভ্যাকসিন নিতে মানুষ ব্যাপক হারে এগিয়ে আসছে বলে আশাবাদের সৃষ্টি হয়েছে। তবে ইউরোপ, মধ্য ও দূরপ্রাচ্যের দেশগুলোয় বিমান চলাচল কিছু সময়ের জন্য স্থগিত রাখার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে ভাবা দরকার। তবে এই মুহূর্তে করোনাভাইরাস ইউরোপের দেশগুলোর মতো বিপজ্জনক কিছু নয়। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন উদ্বেগজনক ঘটনা মানুষের মনে নানা সংশয়-সন্দেহ ও আশঙ্কার ছাপ রেখে গেছে।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম আল-জাজিরায় প্রকাশিত ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টার্স মেন’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রচারিত হওয়ার ফলে দেশ-বিদেশে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছিল বেশ কয়েক মাস আগে। দেশের কোনো গণমাধ্যমে ওই প্রতিবেদন প্রকাশ না পাওয়া এবং এর বিরুদ্ধে পরিচালিত একতরফা প্রতিবাদ ও সমালোচনার ফলে অনেক গুজব সৃষ্টির সুযোগ হয় তখন।
নানা জায়গায় আংশিকভাবে যেগুলো প্রকাশিত হয়েছে, তা থেকে বোঝা যায় আল-জাজিরা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও সেনাবাহিনীপ্রধানের ভাবমূর্তি নষ্ট করার এজেন্ডা নিয়েছিল। ভালো হতো যদি সব গণমাধ্যমে অবিকল পূর্ণ প্রতিবেদনটি প্রকাশ পেত এবং সংক্ষুব্ধ সবার জন্য প্রতিবেদনটির বিভিন্ন অভিযোগ খণ্ডনের সুযোগ তৈরি হতো।
যাহোক, বাংলাদেশে নিত্যদিন ঘটে যাওয়া বিভিন্ন বিচ্ছিন্ন ঘটনাও উদ্বেগ সৃষ্টি করে চলেছে মানুষের মনে। সরকারি দলে ন্যূনতম সাংগঠনিক শৃঙ্খলা না থাকা, প্রতিদিন দেশের কোথাও না কোথাও দলটির নানা গ্রুপের মধ্যে ঘটা সংঘাত ও নানা অপ্রীতিকর ঘটনা দলের উচ্চমহলের পক্ষে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না। সেটা বিস্ময়কর এবং মারাত্মকভাবে হতাশাজনক।
এই ঘটনাগুলো দেশের মানুষকে একদিকে যেমন রাজনীতিবিমুখ করে তুলছে, পাশাপাশি যুব ও তরুণসমাজের মধ্যে সন্ত্রাসী প্রবণতা বাড়ছে। একই দলের বিভিন্ন গ্রুপ পরস্পরের সঙ্গে বিবাদে জড়াচ্ছে। হত্যাকাণ্ড ঘটছে। আর এসবের খবর সংগ্রহ ও ছবি তোলার মতো পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সাধারণ মানুষের মতোই নিরীহ সাংবাদিকরাও হামলার শিকার হচ্ছেন। এসব কোনো ভালো ইঙ্গিত নয়।
চারদিকে সরকারি দলের নেতা-কর্মীদের নামে ব্যাপক দুর্নীতি, বিদেশে টাকা পাচার ও নির্বাচনগুলোতে জনপ্রিয় প্রার্থীকে মনোনয়ন দেয়ার নামে ধনিক-বণিকদের মনোনয়ন দিয়ে দলের মধ্যে যেমন কলহ সৃষ্টি করা হচ্ছে, তেমনই আবার রাজনীতি থেকে রাজনীতিকদের হটিয়ে দিয়ে ব্যবসায়ীদের কৃত্রিম রাজনীতিক সাজানো হচ্ছে।
এই চিত্র সংসদ, সিটি করপোরেশন, জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা এবং ইউনিয়ন পরিষদ- সব জায়গায় চোখে পড়ার মতো এসব কাণ্ড বেড়েই চলেছে। মনোনয়ন দেয়া প্রার্থীদের তালিকা ঘাঁটলে সবকিছু স্পষ্ট হয়ে যাবে। আর এই অরাজনীতিক অর্থগৃধ্নু বিত্তশালীরা মনোনয়ন পেলে নির্বাচনব্যবস্থাকেও পণ্য মনে করে। ফলে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে অপরিহার্য নির্বাচনব্যবস্থা দূষিত হয়।
বিভিন্ন সময় এ জাতীয় অরাজনীতিকরা নানা অপকর্মে লিপ্ত থেকে দলীয় নেতৃত্ব ও সরকারকে প্রকৃত তথ্য জানার সুযোগ বন্ধ করে দিয়ে ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণের দিকে ঠেলে দেয়। পরিণতিতে রাষ্ট্র-সরকার, দল-জনগণ সবাই অপরিসীম ক্ষতির শিকার হয়।
টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি ও দখলবাজির মাধ্যমে এসব অরাজনীতিক নিজেদের তহবিল অবৈধভাবে স্ফীত করে। জনগণের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক থাকে না। ফলে দল ও সরকার হয়ে পড়ে চূড়ান্তভাবে জনবিচ্ছিন্ন। ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, এই কোকিলেরা দল বা সরকারের বিপদের মুহূর্তে ঠিকই সটকে পড়ে।
আল-জাজিরার প্রতিবেদনের মূল লক্ষ্য ছিল, বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকে আঘাত করা। এই ঘটনার প্রতিবাদে দেশের মাত্র অল্প কিছু জায়গায় সরকারি দলের অঙ্গসংগঠনগুলো মানববন্ধনের আয়োজন করলেও, সাধারণ মানুষ কোথাও তাতে সম্পৃক্ত হয়নি। এতে উপলব্ধি করা যায়, স্তাবকেরা তাদের দল ও সরকারকে কতটা জনবিচ্ছিন্ন ইতোমধ্যে করে ফেলেছে।
বাংলাদেশে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটছে তা প্রশ্নাতীত। কিন্তু সে উন্নয়নের ছোঁয়া যে বেশির ভাগ মানুষের ঘরে না পৌঁছে কিছু সুবিধাভোগীর সমৃদ্ধি ঘটছে, সেটা দিবালোকের মতো সত্য। এর পরিণতিতেও বাড়ছে ক্ষোভ।
যুবসমাজকে এখন আর ওভাবে অন্যায়ের প্রতিবাদে অতীতের মতো রুখে দাঁড়াতে দেখা যায় না। তারাও ক্ষমতাসীন দলের হয়ে ভাগ-বাঁটোয়ারায় প্রলুব্ধ হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে তাদের কোনো জবাবদিহির মুখোমুখি হতে হয় না, শাস্তি তো দূরের কথা। তাই যুবসমাজের বড় অংশ রাজনীতি ও আন্দোলনে নিস্পৃহ।
এসব ব্যাপারই নানা অঘটন ঘটানোর জন্য অত্যন্ত অনুকূল ভূমিকা পালন করছে। তাই সময় থাকতে এই অব্যবস্থাগুলো দূর করা এবং সতর্ক হওয়ার বিকল্প নেই। সর্বাগ্রে দেশ ও মানুষের স্বার্থে অরাজনীতিক স্তাবকদের হাত থেকে রাষ্ট্রকে মুক্ত করা জরুরি। রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় শত্রু জামায়াত ও হেফাজতও ওত পেতে আছে। সুযোগ পেলেই ছোবল মারবে।
লেখক: রাজনীতিক, একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক।