বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

প্রধানমন্ত্রীর দর্শনবিরোধী এসব বিড়ম্বনা

  • নাসির আহমেদ   
  • ২১ নভেম্বর, ২০২১ ১৯:২৫

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনকালে এই বোধ বড় পীড়িত করে। কেন স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের মতো জাতীয় বিষয়গুলোতেও সবাই ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারল না। রাজনৈতিক আদর্শের চেয়ে স্বার্থপরতাকেই বেশি করে কেন আগলে ধরেছে এত মানুষ? এর প্রভাব সমাজের সব কিছুতে দৃশ্যমান।

অনেক আনন্দ-বেদনা ও স্মৃতিময় গৌরবের ডিসেম্বর কড়া নাড়ছে। জাতির পিতার জন্মশতবর্ষ, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার ৫০ বছরপূর্তি উপলক্ষে বাংলাদেশ উদ্বেলিত। দেশ আজ ব্যাপকভাবে বদলে যাওয়া এক অনন্য উচ্চতায়। অর্থনৈতিকভাবে অভাবনীয় অগ্রগতি হয়েছে। যোগাযোগক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু সবক্ষেত্রে অগ্রসর হওয়া যায়নি। একদিকে যেমন এত ইতিবাচক ব্যাপার রয়েছে, অপরদিকে আবার রাজনৈতিক সংস্কৃতিরও অধঃপতন ঘটেছে।

বঙ্গবন্ধুর আদর্শের বাংলাদেশ বর্তমানে সেই আদর্শের জায়গায় কতটুকু আছে তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনকালে এই বোধ বড় পীড়িত করে। কেন স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের মতো জাতীয় বিষয়গুলোতেও সবাই ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারল না। রাজনৈতিক আদর্শের চেয়ে স্বার্থপরতাকেই বেশি করে কেন আগলে ধরেছে এত মানুষ? এর প্রভাব সমাজের সব কিছুতে দৃশ্যমান।

এতকিছুর পরও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার গত একযুগে দারিদ্র্য কমিয়ে দেশকে উন্নয়নের পথে ধাবিত করতে অনেকখানি সক্ষম হয়েছেন। তার ভাবনা হলো- মুক্তিযোদ্ধারা সম্মানিত হোক, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বাংলাদেশ এগিয়ে যাক, মানুষের দারিদ্র্য হ্রাস পাক ও প্রতিটি মানুষ অন্তত দুবেলা-দুমুঠো খেয়ে মাথাগোঁজার ঠাঁই যেন পায়।

দুঃখের বিষয়, প্রধানমন্ত্রীর জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা যারা বাস্তবায়ন করবে, তারা সবাই হয়ত তার মতো ভাবে না। ভাবলে জনদুর্ভোগ বাড়ে এমন কোনো পথে কেউ পা বাড়াত না। একাধিক ব্যবসায়ী নেতাকে তার মন্ত্রিসভায় ঠাঁই দিয়েও দেশের বাজার অর্থনীতিকে জনগণের অনুকূলে রাখা যায়নি।

নিত্যপণ্যের মূল্য অস্বাভাবিকহারে বেড়ে যাওয়ায় ক্ষুব্ধ হচ্ছে স্বল্প আয়ের মানুষ। ফলে এত উন্নয়নের পরও সরকারের সুনামের পরিবর্তে দুর্নাম হচ্ছে। দুর্ভোগে পতিত সাধারণ মানুষ।

তিনদিনের ব্যবধানে যদি এক কেজি শিমের দাম কেজি প্রতি ৩০ টাকা বেড়ে যায়- তাহলে ক্রেতারা প্রতিকারে যতই অক্ষম হোক না কেন, তাদের ক্ষোভের তাপটা পড়ে সরকারের উপরেই। শুধু সবজি নয়, চাল-ডাল, পিঁয়াজ, তেল-চিনি আটাসহ প্রতিটি নিত্যপণ্যের দাম গত তিন মাসে বেড়েছে। আর তাতে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো অবস্থা সৃষ্টি করেছে নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে জ্বালানি তেলের আকস্মিক মূল্যবৃদ্ধি।

বিশেষ করে নভেম্বর মাসে নিত্যপণ্যের মূল্য আরও স্ফীত হওয়ার পাশাপাশি দেশজুড়ে গণপরিবহনের ভাড়া বৃদ্ধিজনিত কারণে যে ভয়াবহ চিত্র দেখা গেছে- এর প্রভাব সর্বগ্রাসী পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। যা কোনো জনবান্ধব সরকারের জন্য অনুকূল নয়।

জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে গণপরিবহন মালিক-শ্রমিকরা ভাড়া বৃদ্ধির দাবিতে বাস বন্ধ করে দিয়ে চরম জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করেছে। বাস মালিক-শ্রমিকদের দেখাদেখি লঞ্চ মালিকরাও বন্ধ করে দেয় লঞ্চ। এসবের মাধ্যমে সরকার ও জনসাধারণকে একেবারে জিম্মি করে ফেলে গণপরিবহন-সংশ্লিষ্টরা। আদায় করে ছাড়ল বাড়তি ভাড়া।

তাতে কি জনদুর্ভোগ কমাতে পেরেছে সংশ্লিষ্টরা? পেট্রোলের মূল্যবৃদ্ধির সুযোগ ডিজেল-চালিত গাড়ি নিতে পারে না। আবার ডিজেলের মূল্য বাড়লে পেট্রোল-চালিত গাড়ি বাড়তি ভাড়া দাবি করতে পারে না। কিন্তু সব সম্ভবের এই দেশে তাও দেখা গেছে। বেড়েছে গ্যাস-চালিত পরিবহনেরও ভাড়া!

গত তিন সপ্তাহ ধরে রাস্তায় পরিবহনশ্রমিক ও যাত্রীদের বাকবিতণ্ডায় অত্যন্ত অস্বস্তিকর সময় গেল। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয় না। সরকার যে হারে ভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছিল এরচেয়ে বেশি আদায়ের প্রবণতায় অগত্যা আর কী করা! রাস্তায় মোবাইল কোর্ট নামানো হলো।

যেসব বাসে যাত্রীদের কাছ থেকে অবৈধভাবে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হচ্ছিল তাদের জরিমানা করা শুরু হলো। অমনি রাস্তা থেকে কিছু পরিবহনের মালিক-শ্রমিক বাস প্রত্যাহার করে নিল। আবারও জনসাধারণের দুর্ভোগ।

৭১ টিভিসহ বেশকিছু টিভি চ্যানেল লাইভ সম্প্রচার করে দেশবাসী ও সরকারকে পরিবহন সেক্টরের নৈরাজ্যের চিত্র দেখিয়েছিল। স্টুডিওতে বসে তারা লাইভ সাক্ষাৎকার প্রচার করছিল, যেখানে বাস মালিক, যোগাযোগ মন্ত্রণালয়, বিআরটিএসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিনিধিরা অংশ নেয়।

বাস মালিকদের প্রতিনিধি বললেন, আমরা তো বাস বন্ধ করিনি, করতেও বলিনি! কীভাবে এটা হলো দেখতে হবে। দুই-একজন আবার বলল- ‘যাত্রীরা মারধর করছে বাস শ্রমিকদের, মোবাইল কোর্ট অন্যায়ভাবে জরিমানা ও জুলুম করছে’ ইত্যাদি।

এতে কোনো সমাধান বা সদুত্তর পাওয়া যায়নি। বহুদিন ধরে পরিবহন সেক্টরের এই নৈরাজ্য চলছে। যেন নীরবে মেনে নেয়াই নিয়তি! প্রতিটি সরকারের আমলে পরিবহন সেক্টরের এই নৈরাজ্য দেখা গেছে। দুর্ঘটনা, মালিক ও নেতাদের শ্রমিকশোষণ আর চাঁদাবাজির কথা না বললেই নয়।

শেষপর্যন্ত সব ভোগান্তি সব যাত্রী সাধারণের। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এ ধরনের নৈরাজ্য চলতে পারে না। তা সত্ত্বেও এরকম অবাঞ্ছিত বাস্তবতার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে দেশের পরিবহন সেক্টর ও নিত্যপণ্যের বাজার।

সবক্ষেত্রেই জনসাধারণ জিম্মি। নিত্যপণ্যের বাজারে অবৈধ মুনাফাখোররা শুধু সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। প্রতিটি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যেরই আলাদা সিন্ডিকেট আছে। দেশে এত আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী সংস্থা, তারপরও এদের চিহ্নিত করতে পারে না? নাকি চায় না?

গত সেপ্টেম্বর-অক্টোবর-জুড়ে নিত্যপণ্যের বাজারে ছিল সিন্ডিকেট-চক্রের তৎপরতা। পরিস্থিতি বেসামাল হয়ে পড়লে কোনো কোনো বাজারে ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালিয়ে জরিমানা আদায় করেছে সত্য, কিন্তু সারা দেশের অগণিত বাজারে অভিযান পৌঁছায়নি। ফলে জনগণের দুর্ভোগ যেখানে ছিল সেখানেই রয়ে গেছে।

বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার পর সংগত কারণেই পণ্য পরিবহনব্যয় বেড়েছে। কিন্তু দাম যে হারে বেড়েছে এতে পরিবহন বাঁচাতে প্রতিকেজি পণ্যের জন্য এক টাকার বেশি পড়ার কথা না। সেখানে কেজি প্রতি ৫ থেকে ১০ টাকা বাড়িয়েছে বাজারের ব্যবসায়ীরা। এই বাড়তি মূল্যের চাপ সামলাতে না সামলাতে আবার হঠাৎ তিন-চারদিনের অঘোষিত পরিবহন-ধর্মঘটে আরও এক দফা বাড়ল সরবরাহে ঘাটতির অজুহাতে। এভাবেই জনসাধারণ বাজার আর পরিবহনের কাছে জিম্মি।

যাহোক, আন্তর্জাতিক বাজারে পেট্রোলিয়াম পণ্যের মূল্য বৃদ্ধির কারণে গত ৪ নভেম্বর বৃহস্পতিবার থেকে দেশে জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে লিটারে ১৫ টাকা। অর্থাৎ প্রতি লিটার ৬৫ থেকে বেড়ে ৮০ টাকা হয়েছে।

এই বাড়ানোর যুক্তি হিসেবে বলা হয়েছিল ভারতে জ্বালানি তেলের দাম কম বলে পাচার হয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ থেকে। অথচ বিস্ময়কর সত্য ওই একই দিনে ভারতের বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছিল।

বিশ্ববাজারে তেলের দাম কোথায় কত? কত টাকা বাড়তি বলে বাংলাদেশে এক লাফে ১৫ টাকা বেড়ে গেল? চিত্রটা একটু দেখে আসা যাক। গ্লোবাল পেট্রোল প্রাইস ডটকম নামের একটি ওয়েবসাইটের বরাত দিয়ে নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদনের দিকে তাকালে দেখা যায়, বিশ্বের সবচেয়ে কম দামে ডিজেল বিক্রি হয় ভেনিজুয়েলায়।

দক্ষিণ আমেরিকার এই দেশটিতে বাংলাদেশি মুদ্রায় যেখানে লিটারের দাম এক টাকারও কম। এর পরই রয়েছে ইরান। বাংলাদেশি মুদ্রায় সেখানে এক লিটার ডিজেলের দাম মাত্র এক টাকা। সৌদি আরবে তো পানির চেয়েও কম দামে জ্বালানি বিক্রি করা হয়। বিশ্ববাজারের দামের কথা তারা বিবেচনা করেনি। করেছে দেশ ও জনসাধারণের স্বার্থকে। উচ্চ ভর্তুকি দিয়েও জনগণকে সুবিধা দিচ্ছে। কারণ জ্বালানির সঙ্গে অনেক কিছুর মূল্য সম্পৃক্ত।

ভাবতেও বিস্ময় জাগে! যেখানে দেশের প্রধানমন্ত্রী জনগণের সুবিধা ও দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য এত ক্ষেত্রে ভর্তুকি দিয়ে যাচ্ছে; সেখানে জ্বালানি খাতে সর্বোচ্চ ভর্তুকি দিলেও দেশের জন্য কল্যাণ। সেই ক্ষেত্রটির ঘাটতি কমানোর নামে এমন ভয়াবহ আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত কোনো দেশপ্রেমিক সরকার বা সরকারের কোনো অংশ প্রতিষ্ঠান নিতে পারে! বিশ্বাসই করা যায় না।অথচ এ খাতে ঘাটতির বিষয়টির বাস্তবতা অন্যরকম। জ্বালানির মূল্য না বাড়িয়ে এই ক্ষেত্রে দুর্নীতি ও অনাহুত ব্যয় কমানো গেলে তাতেই জ্বালানি সেক্টর গতিময় হতে পারত।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা টেলিভিশন-সংবাদপত্রে তথ্যপ্রমাণ দিয়ে দেখিয়েছেন যে, গত কবছর ধরে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য কম থাকায় বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন বিপিসি উচ্চহারে তেল বিক্রি করে একটানা ছয় বছরে ৬৩ হাজার কোটি টাকার বেশি আয় করেছে। অথচ মাত্র পাঁচ মাস ধরে বিশ্ববাজারে মূল্যবৃদ্ধির অজুহাতে এক লাফে ২৩% মূল্যবৃদ্ধিকে জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা আত্মঘাতী বলে মন্তব্য করেছেন।

এ প্রসঙ্গে বলা প্রয়োজন- বাংলাদেশে এখন অতি দরিদ্র বা দারিদ্র্যপীড়িত নয়। মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার অনেক শর্ত ইতোমধ্যেই পূরণ করে ফেলেছে। রাষ্ট্র এখন দরিদ্র মানুষের কল্যাণে অনেক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। সেক্ষেত্রে যদি জ্বালানি খাতে ৫ থেকে ৬ হাজার কোটি টাকা বার্ষিক ঘাটতি দেয়া লাগে; তাতে দেশ বা সরকার অচল হয়ে যাবে না।

মনে রাখতে হবে, অন্য খাতে আয় বাড়ানোর পদক্ষেপ নিয়েও জ্বালানি খাতকে নিয়মিত ভর্তুকি দিয়ে যাওয়া লাভজনক। কারণ তাতে এতগুলো সেক্টর ক্ষতিগ্রস্ত হতো না, এত জনদুর্ভোগ সৃষ্টি হতো না। এই সহজ হিসাব বোঝার জন্য অর্থনীতিবিদ হওয়ার প্রয়োজন হয় না।

মানুষের যাতায়াত, পণ্য-পরিবহন, কৃষি-উৎপাদন, বাজারে নিত্যপণ্যের সরবরাহের ও বাড়তি ব্যয়ে পণ্যমূল্য বৃদ্ধিসহ সব ক্ষেত্রেই অস্বাভাবিক নেতিবাচক প্রভাব পড়ে শুধু জ্বালানির মতো একটি খাতের মূল্যবৃদ্ধির কারণে। ফলে বাজারে মূল্যস্ফীতিও ঘটবে উচ্চহারে। কমবে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা এবং দারিদ্র্যের হার বাড়বে দ্রুত গতিতে। যা বর্তমান সরকারের আমলে কাম্য হতে পারে না।

লেখক: কবি ও সিনিয়র সাংবাদিক। সাবেক পরিচালক (বার্তা) বাংলাদেশ টেলিভিশন।

এ বিভাগের আরো খবর