এক সময় একটি কোম্পানির বেবি শ্যাম্পুর বিজ্ঞাপন দেখানো একটা শিশু ওই বেবি শ্যাম্পু দিয়ে আনন্দের সঙ্গে গোসল করার পর বলছে, চোখে লাগলে চোখ জ্বলে না, কান্নাও পায় না! … বেবি শ্যম্পু! আমরা এখন সেই বিজ্ঞাপনে দেখানো বেবি শ্যাম্পুর জগতে বাস করছি। এখন আমাদের কোনো কিছুতেই ‘চোখও জ্বলে না, কান্নাও পায় না!’
নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের কথাই ধরা যাক। প্রতিটি জিনিসের দাম অনেক বেশি বেড়েছে এবং বেড়েই চলেছে। চাল-ডাল, আটা-তেল, ডিম-মাছ, মাংসের দাম অনেক দিন ধরেই আকাশছোঁয়া। গত এক মাসে চিনি-ময়দা, মুরগির মাংস-মাছ, রান্নার তেল এবং মশলাসহ প্রায় সব নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বেড়েছে। সবজি ও তরকারির দামেও কোনো লাগাম নেই। বাজারে পঞ্চাশ টাকা কেজিতে কোনো সবজি পাওয়া যায় না।
শীতকালীন সবজি বাজারে আসতে শুরু করলেও দাম কমার কোনো লক্ষণ নেই। সাধারণ মানুষ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্যবৃদ্ধিতে নাকাল হলেও সরকারের কর্তাব্যক্তিদের এ নিয়ে কোনো বিকার নেই। তারা জিনিসপত্রের দাম যে অনেক বেশি౼এ সাধারণ সত্যটাই স্বীকার করেন না। ‘জিনিসপত্রের দাম আর কত কমাব’ ‘সব ঠিকঠাক মতো চলছে’ বলেই তারা মনে করেন।
সম্প্রতি সরকারিভাবে ডিজেল-কোরোসিনসহ জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোয় নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম আরেক দফা বেড়েছে। এই বেড়ে যাওয়া দাম সহসা কমবে বলেও মনে হয় না। জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির ফলে পরিবহন ও উৎপাদন খরচ বেড়েছে। কাজেই জিনিসপত্রের দাম কমার আশু সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।
আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির দোহাই দিয়ে সাধারণত ব্যবসায়ী ও আমদানিকারকরা জিনিসপত্রের দাম বাড়ান। আন্তর্জাতিক বাজারে কোন পণ্যের কতটুকু দাম বেড়েছে, বাংলাদেশের আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীরা যে দামে জিনিসপত্র বিক্রি করছেন, সেটা আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে কতটুকু সংগতিপূর্ণ౼ এ বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা হচ্ছে না। সরকার মাঝে-মধ্যে ব্যবসায়ীদের ধমক-ধামক দেন। ব্যস, এ পর্যন্তই।
এর বাইরে সরকারকে কোনো কিছু করতে দেখা যায় না। ফলে মূল্যবৃদ্ধির পাগলা ঘোড়া বল্গাহীনভাবে ছুটে চলে। সীমিত আয়ের মানুষের জন্য এটি চরম দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইতোমধ্যেই তারা কোভিড-১৯ মহামারির কারণে তৈরি হওয়া অর্থনৈতিক মন্দার সঙ্গে সংগ্রাম করছেন।
সরকারের উচিত অবিলম্বে এই বিষয়ে নজর দেয়া এবং যেসব ব্যবসায়ী সরকারনির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি অর্থ আদায় করে ভোক্তাদের শোষণের চেষ্টা করছেন তাদের শাস্তির ব্যবস্থা করা। পাশাপাশি, মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্য ক্রমাগত কমে যাওয়া রোধ করা উচিত।
এতে করে বিভিন্ন পণ্যের আমদানি খরচ বেড়ে যাচ্ছে। প্রধান নিত্যপ্রয়োনীয় পণ্যের জন্য বিদেশের বাজারের ওপর নির্ভরশীল থাকায় বাংলাদেশ সব সময় আমদানি-প্ররোচিত মূল্যস্ফীতির ঝুঁকিতে থাকে। ফলে এই দুষ্টচক্র থেকে বেরিয়ে আসার জন্য বাংলাদেশের একমাত্র উপায় হচ্ছে কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের জন্য নিজস্ব সরবরাহ শৃঙ্খল তৈরি করা। কিন্তু সরকারকে এ ব্যাপারে কোনো কার্যকর উদ্যোগ নিতে দেখা যাচ্ছে না।
এটা মানতেই হবে যে, বর্তমানে যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করছেন তারা অত্যন্ত বুদ্ধিমান। তারা নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বাড়ানোর নতুন এক ‘পদ্ধতি’ আবিষ্কার করেছেন। নতুন এই পদ্ধতি অনুযায়ী, ধরে ধরে সুনির্দিষ্ট পণ্যের দাম বাড়ানোর দরকার হচ্ছে না। কৌশলে মাত্র একটা জিনিসের দাম বাড়িয়ে দেন, ব্যস, কেল্লাফতে। তাতে শুধু নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য-সেবা নয়, সব ধরনের জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যায়! কত সুন্দর কায়দা, চিন্তা করে দেখুন। এ অনেকটা কান ধরে টান মারার মতো। কান টানুন, মাথা-চোখ, নাক-মুখ, কপাল এমনিতেই কাছে আসবে!
এই ‘কৌশলগত পণ্য’টির নাম কী? এটা হলো জ্বালানি তেল। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ান, বিদ্যুতের দাম বেড়ে যাবে। পরিবহন ভাড়া বেড়ে যাবে। অন্যসব জিনিসের দামও বেড়ে যাবে। মজার ব্যাপার হলো জ্বালানি তেলেরে দাম বাড়ানোর ব্যাপারটা বাজেটের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। এটা করে মন্ত্রণালয় ও তথাকথিত রেগুলেটরি এজেন্সি। ফলে নির্বাচিত হোক আর অ-নির্বাচিত হোক౼ জাতীয় সংসদের সঙ্গে এই দাম বাড়ানোর কোনো সম্পর্ক নেই। এর জন্য জাতীয় সংসদের কাছ থেকে কোনো অনুমতি নেয়ারও প্রয়োজন হয় না। জাতীয় সংসদে আলোচনাও হয় না।
আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ার যুক্তি দেখিয়ে আমাদের দেশে ডিজেল-কোরোসিনের দাম লিটারপ্রতি এক ধাপে ১৫ টাকা বাড়ানো হয়েছে।
উল্লেখ্য, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটে গত অক্টোবরে। এর আগের সাত বছর তেলের দাম ছিল অনেক কম। তখন বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) কম দামে তেল কিনে দেশের ভোক্তাদের কাছে বেশি দামে বিক্রি করে মুনাফা করেছে ৪৩ হাজার কোটি টাকার বেশি।
এই সাত বছরে সরকার মাত্র একবার দাম কমায়, তা–ও অতি সামান্য, মাত্র ৩ টাকা প্রতি লিটারে। কিন্তু দাম বাড়তে শুরু করার এক মাসের মধ্যেই বিপিসির দেয়া প্রস্তাব মেনে ডিজেল ও কেরোসিন তেলের দাম বাড়িয়ে দেয় লিটারে ১৫ টাকা। অর্থাৎ এক লাফে বাড়ে ২৩ শতাংশ। এর প্রতিক্রিয়ায় পরিবহন খাতের ভাড়া সরকার বাড়িয়ে দিয়েছে ২৭ শতাংশ।
জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো মানেই জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়া। করোনায় নাকাল দেশবাসীর কাছে এ মূল্যবৃদ্ধি এক বড় আঘাত। মানুষ যখন একটু একটু করে গত ১৮ মাসের অর্থনৈতিক ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে, তখন এ মূল্যবৃদ্ধি বজ্রাঘাতে শামিল। তেলের দাম বাড়ানোর ব্যাপারে অর্থনীতিবিদদেরও সমর্থন ছিল না। তারা গত কয়েক বছরে যে বিপুল পরিমাণ মুনাফা হয়েছে, সেই টাকা থেকে ভর্তুকি দেয়ার প্রস্তাব করেছিলেন। কিন্তু সরকার সাধারণ মানুষের কথা চিন্তা না করে ভেবেছে কেবল বিপিসির কথা, পরিবহন খাতের প্রভাবশালী মালিকদের কথা।
জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো নিয়ে যেহেতু সারা বিশ্বই চিন্তিত, সেহেতু সবাই একটি পথ খুঁজছিল। এ সপ্তাহে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের উদ্যোগে আকস্মিক আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমেছে। এখন সরকার কী করবে? এখন কি সরকার জ্বালানি তেলের দাম কমিয়ে আগের অবস্থায় ফিরে যাবে? নাকি অপেক্ষা করবে? প্রশ্ন হচ্ছে, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কতটা কমলে সরকার বাংলাদেশেও দাম কমানোর সিদ্ধান্ত নেবে? নাকি লাভই করতে থাকবে?
সরকার ছলে-বলে-কৌশলে আমাদের আয়ের ওপর ‘গোপন-হামলা’ চালাচ্ছে। আমাদের পরিশ্রমের টাকা নানা কায়দায় হাতিয়ে নিচ্ছে। প্রত্যক্ষ করের পরিবর্তে পরোক্ষ করের বোঝা তো আছেই, এর সঙ্গে যোগ হয়েছে তেল এবং সিলিন্ডার গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি। বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির ঘোষণা অচিরেই আসবে বলেও আশঙ্কা রয়েছে। কথা হলো, আমরা কি সেই বিজ্ঞাপনের শিশুটির মতো ‘চোখে লাগলে চোখ জ্বলে না, কান্নাও পায় না’ মার্কা অনুভূতি নিয়ে বসে থাকব? নাকি একটু নড়েচড়ে বসব, প্রতিবাদ-ট্রতিবাদ করব?
লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা, প্রাবন্ধিক।