আজ ঐতিহাসিক ১০ নভেম্বর। শহীদ নূর হোসেন ও আমিনুল হুদা টিটো দিবস। ১৯৮৭-এর এই দিনে সেসময়ের সামরিক শাসক লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের স্বৈরশাসন হটাতে জীবন বিলিয়ে দেন নূর হোসেন ও সৈয়দ আমিনুল হুদা টিটো। এর পর থেকে দিনটি ‘গণতন্ত্র মুক্তি দিবস’ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার মধ্যে দিয়ে যে সামরিক স্বৈরশাসনের দিকে দেশ যাত্রা শুরু করে, সেখান থেকে দেশকে গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরিয়ে আনতে ১৯৮৭-এর ১০ নভেম্বর তাৎপর্যপূর্ণ একটি দিন।
১৯৮২ সালে সেনা অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে স্বৈরশাসক এরশাদ। পরবর্তীকালে নিজস্ব রাজনৈতিক দল গড়ে তোলে। ১৯৮৬ সালে অনুষ্ঠিত তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠন করে এরশাদের জাতীয় পার্টি। বিরোধী দলগুলো এই নির্বাচনে জালিয়াতির অভিযোগ আনে। এর পরিপ্রেক্ষিতে এরশাদের স্বৈরশাসন হটাতে তখনকার আন্দোলনরত সব দলের একমাত্র দাবি ছিল নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা।
১৯৮৭-এর ১০ নভেম্বর মূলত আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ৮ দল, বিএনপি নেতৃত্বাধীন ৭ দল ও বামপন্থি ৫-দলীয় জোট একত্র হয়ে এরশাদের পতনের লক্ষ্যে সচিবালয় ঘেরাও করে ঢাকা অবরোধ কর্মসূচির ঘোষণা করে।
ব্যক্তিগতভাবে আমি তখন স্কুলের ছাত্র। আমার বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা মীর দেলওয়ার হোসেন প্রত্যক্ষ বাম রাজনীতি ও শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনের যে স্মৃতি আমার মানসপটে ভেসে ওঠে তা হলো- আন্দোলন করতে গিয়ে বাবার জেলজীবন, বাবাকে জেলে দেখতে যাওয়া, বাবার জামিনের জন্য আদালতে দাঁড়ানো ও আমাদের বাসায় এরশাদের পেটোয়া গুন্ডা বাহিনীর আক্রমণের মতো নানাবিধ স্মৃতি।
সেসঙ্গে মনে পড়ে, ১৯৮৭-এর ১০ নভেম্বর খুব ভোরে বাবা আমাদের বাসা থেকে জয়দেবপুর রেলস্টেশন পর্যন্ত পায়ে হেঁটে এবং সেখান থেকে ট্রেনে চেপে ঢাকা যান সচিবালয়-ঘেরাও কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করতে। গভীর রাতে বাবা বাসায় ফেরেন। ছেঁড়া স্যান্ডেল আর তার অতিপ্রিয় ঘড়ি হারিয়ে ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে কোনোমতে প্রাণ হাতে নিয়ে বিধ্বস্ত অবস্থায়। আমার বাবা তবুও সেসময় জীবিত অবস্থায় ফিরে আসতে পেরেছিলেন।
কিন্তু পেশায় অটোরিকশা চালক, ঢাকা জেলা আওয়ামী মটর চালক লীগের বনগ্রাম (পুরান ঢাকার সূত্রাপুর থানার অন্তর্গত) শাখার প্রচার সম্পাদক নূর হোসেন (১৯৬১- ১০ নভেম্বর ১৯৮৭) সেদিন আন্দোলনের কর্মসূচি থেকে জীবিত অবস্থায় ফিরতে পারেননি। আগের দিন ৯ নভেম্বর তিনি ইকরাম নামে এক সাইনবোর্ড লেখকের কাছে গিয়ে নিজের শরীরকে পোস্টারে পরিণত করেন।
প্রথমে না করলেও পরে নাছোড়বান্দা নূর হোসেনের পীড়াপীড়িতে ইকরাম তার শরীরে স্লোগান লিখে দেন। মুহূর্তেই তৈরি হয়ে যায় অন্য এক নূর হোসেন। ৯ তারিখ রাতে এই পোস্টার লেখা থেকে পরদিন ১০ নভেম্বর সকাল পর্যন্ত সে স্লোগান ধ্বনিত হতে থাকে নূর হোসেনের শরীরের প্রতিটি কোষে।
পায়ে কেডস। পরনে জিন্সপ্যান্ট। গায়ের শার্ট কোমরে বাঁধা। খালি গায়ে বুকে-পিঠে লেখা ‘স্বৈরাচার নীপাত যাক’ এবং ‘গনতন্ত্র মুক্তি পাক’ স্লোগান। গোটা শরীরটাই যেন একটা ত্রিমাত্রিক পোস্টার। স্বৈরাচারবিরোধী যে মিছিলটিতে নূর হোসেন অংশগ্রহণ নেন সেটি ঢাকা জিপিওর সামনে জিরো পয়েন্টের কাছাকাছি এলে স্বৈরশাসকের মদদপুষ্ট পুলিশবাহিনীর গুলিতে নূর হোসেনসহ মোট তিনজন আন্দোলনকারী নিহত হন।
নূর হোসেন পুলিশের গুলিতে লুটিয়ে পড়েন। মরণ যন্ত্রণায় যখন ছটফট করছিলেন, তখন রিকশায় করে হাসপাতালের দিকে নিয়ে যাওয়ার পথে তাকে বহনকারী রিকশাটিকে পুলিশ চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলে। গুলিবিদ্ধ নূর হোসেনকে টেনে-হিঁচড়ে রিকশা থেকে নামিয়ে পুলিশের গাড়িতে তুলে নেয় তারা। তিনি যখন মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিলেন, তখন একজন নিষ্ঠুর পুলিশ সদস্য পায়ের বুট দিয়ে তার বুক চেপে ধরে। স্বৈরাচারের পুলিশেরা এতটাই অমানবিক ও নিষ্ঠুর ছিল।
১৯৮৭ সালে যখন ‘দ্য নিউ নেশন’ পত্রিকায় নূর হোসেনের পোস্টার-শরীরের ছবি ছাপা হয়, তখন চিত্রগ্রাহক পাভেল রহমানকে এরশাদের গোয়েন্দা বাহিনীর তাড়া খেয়ে, দিনের পর দিন পালিয়ে বেড়াতে হয়েছিল। এরশাদের প্রশাসন প্রচার করার চেষ্টা করেছিল যে ছবিটি বানোয়াট। ১৯৮৭-এর ১০ নভেম্বরের পর টানা ৩ বছর পালিয়ে থাকতে হয় নূর হোসেনের শরীরের পোস্টার লেখক ইকরামকেও।
নূর হোসেনকে যখন জুরাইন কবস্থানে দাফন করা হয় তখন কেরোসিন দিয়ে তার শরীর থেকে স্লোগান তুলে ফেলার চেষ্টা করে সরকারি বাহিনী। কিন্তু তারা তা মুছে ফেলতে পারেনি। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্লোগানকে বুকে ধারণ করেই নূর হোসেনের শেষ যাত্রা। আর তাই তার সংগ্রামী স্মৃতি অজর ও অক্ষয়।
এসময় বহু আন্দোলনকারী আহত হয়। নিহত অপর দুই ব্যক্তি হলেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভ্য ক্ষেতমজুর সমিতির নেতা সৈয়দ আমিনুল হুদা টিটো এবং যুবলীগ নেতা নুরুল হূদা বাবুল।
কবি শামসুর রাহমান সেসময় তার কবিতায় লিখেছেন-
“ঝাঁক ঝাঁক বন্দুকের সীসা, নূর হোসেনের বুক নয়, বাংলাদেশের হৃদয় ফুটো করে দেয়।”
এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিক্রিয়াস্বরূপ বিরোধী দলগুলো ১১ ও ১২ নভেম্বর সারা দেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ঘোষণা করে। বাংলাদেশের গণতন্ত্রকামী মানুষ ফেটে পড়ে বিক্ষোভে। ফলে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন আরও ত্বরান্বিত হয়।
বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সাংস্কৃতিক সংগঠন নানা ধরনের কর্মসূচি পালনের মাধ্যমে শহীদ নূর হোসেন দিবসকে স্মরণীয় করে রাখে। দিনটিকে প্রথমে ‘ঐতিহাসিক ১০ নভেম্বর’ হিসেবে পালন করা হলেও, পরবর্তী সময়ে ‘নূর হোসেন দিবস’ হিসেবে পালন করা শুরু হয়।
ঢাকার জিরো পয়েন্ট, যেখানে তিনি পুলিশের গুলিতে নিহত হন; তার নামানুসারে সেই জিরো পয়েন্টের নামকরণ করা হয়েছে নূর হোসেন চত্বর। নূর হোসেনের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ফুলার রোডের মোড়ে নূর হোসেন ভাস্কর্য তৈরি করা হয়। তার নামে স্মারক ডাকটিকেটও প্রকাশ করা হয়েছে।
অপরদিকে কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরের ক্ষেতমজুর নেতা আমিনুল হুদা টিটো সাইকেল চালিয়ে ঢাকায় আসেন। টিটো হত্যার পর স্বৈরাচার এরশাদের পেটোয়া পুলিশ বাহিনী তার লাশটিও গুম করে ফেলে।
নূর হোসেন, টিটো ও বাবুলের আত্মদান স্বৈরাচারবিরোধী গণ-আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ করে। এই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৯০-এর ৬ ডিসেম্বর জেনারেল এরশাদ পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। পতন ঘটে স্বৈরাচারী সরকারের। গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার পথে আবারও যাত্রা শুরু করে বাংলাদেশ।
৯০ পরবর্তী সময়ে আবারও গণতন্ত্রের পথে হোঁচট খায় বাংলাদেশ। আন্দোলন করতে হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে। ২০০১-এ আওয়ামী লীগ নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তর করলেও পরবর্তী সময়ে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে আবারও অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন গড়ে তুলতে হয়।
২০০৪-এর ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলায় ২৪ জন নিহত এবং সেসময়ের বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনাসহ প্রায় ৩০০ নেতাকর্মী আহত হওয়া; ২০০৫ সালে ১৭ আগস্ট দেশব্যাপী একযোগে ৬৩ জেলায় প্রায় ৫ শ স্পটে বোমাহামলা, কানসাটে কৃষক-শ্রমিক হত্যা ও ছাত্র-জনতার হত্যা এবং ২০০৭-এ ছাত্র বিক্ষোভসহ গড়ে ওঠা বিভিন্ন শ্রেণিপেশার গণ-আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আবারও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে জয়যুক্ত করতে হয়। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রতিটি লড়াইয়ে ১৯৮৭-এর ১০ নভেম্বর নূর হোসেন হত্যার কিছু সময় আগে তোলা, তার গায়ে লেখাযুক্ত আন্দোলনরত অবস্থার ছবিটি বাংলাদেশে গণ-আন্দোলনের এক গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়।
দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার এত চড়াই-উতরাই পেরিয়ে নূর হোসেন হত্যার ৩৪ তম বার্ষিকীতে আশা থাকবে বিভিন্ন সময়ে গণতান্ত্রিক লড়াই-সংগ্রামে নূর হোসেনসহ শহীদ প্রতিটি পরিবারের মঙ্গলার্থে রাষ্ট্রের পক্ষ হতে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করার।
লেখক: প্রবন্ধকার ও সাবেক ছাত্রনেতা।