সৃষ্টির ভেতর দিয়ে যে জগৎ নির্মাণ করা হয়েছে, সৃজনশীলতার নিরিখে সময়ের পথ পাড়ি দিয়ে আজও অবিস্মরণীয় হয়ে আছে তার কীর্তি। কীর্তিমান মানুষ বৈকি। বিশ্বসংসারকে দেখেছেন ভিন্নতার অবয়বে। এঁকেছেন কার্টুনের পর কার্টুন। তিনি বব কেইন। বিশ্বনন্দিত কার্টুনিস্ট। যিনি আজও তার অবিস্মরণীয় সৃষ্টি ‘ব্যাটম্যান’-এর জন্য সববয়সির কাছে জনপ্রিয় হয়ে আছেন। অসংখ্য কমিকস কার্টুন এবং এনিমেশন ফিল্মের (কার্টুন) জন্য বিখ্যাত বব কেইন ছিলেন চিরতরুণ, সতেজ যুবা যেন। বয়স তার সৃষ্টিকর্মে ব্যাঘাত ঘটায়নি।
জীবনের শেষদিনেও এঁকেছেন কার্টুন। বব কেইন বিশ্বাস করতেন কার্টুনের মধ্যে অনেক কিছু ফুটে বেরোয়। শুধু কার্টুনিস্টদের মনের কথাই নয়, যুগের প্রভাব, সম্প্রদায়গত মনস্তত্ত্ব, পারিপার্শ্বিকতার অসংগতিও ফুটে ওঠে। কার্টুন যদিও শিল্পসাহিত্যের মতো চিরকালীন সত্যের বাহক নয়। কিন্তু দীর্ঘকালের হতেই পারে। কার্টুনের আবার রকমফের আছে। একটিমাত্র বিষয় নিয়ে যেমন একটি কার্টুন তৈরি হয়, সংবাদপত্রে যা প্রায়শই ছাপা হয় ব্যঙ্গ-বিদ্রূপে আবার টানা গল্প দিয়ে কার্টুন আঁকা হয়।
কাগজের পাতায় কার্টুন এক নির্বাক দর্শকের এমন কাছের মানুষ হয়ে ওঠার উদাহরণ আর কোথাও মেলে না। কার্টুনে আসে হাজার মুখের মিছিল। মুখম্লানে কার্টুনের মুখ। ক্যারিকেচার করা মুখ, অথচ তাদের মাধ্যমে যেন ফুটে ওঠে প্রকৃত সত্তার আভাস। লুকিয়ে রাখা চেহারা, যা আমাদের মনে থাকে সন্দেহের রূপে, দেখলে হাসি পায়, কিন্তু ভয় করে না যে, ব্যাপারটা বোধ হয় হাসির নয়। আবার কখনও মনে হয় ঠিক বিপরীত। অর্থাৎ যাকে ভাবা হয়েছিল এরকম ওরকম সেরকম। সে আসলে হয়তো শুধুই একটা মজার মানুষ। কিংবা একটা হাস্যকর জীবন।
কিংবা সে সত্যি সত্যিই একটা চলন্ত কার্টুন। ঠিক মানুষ নয় আসলে। প্রত্যেক মানুষের আকৃতির পিছনে লুকানো থাকে এক অমানবিক চেহারা। কার্টুনিস্ট সেটাকে খুঁজে বের করেন। এক্ষেত্রে একটি বিশেষ দৃষ্টি থাকতে হয়। কার্টুন থেকে ক্রমশ কমিকসের আবির্ভাব। কল্প কাহিনি, গোয়েন্দা কাহিনি আর সায়েন্স ফিকশন ও এই কমিকসের বিষয়বস্তু। এর সম্প্রদায়ের সংখ্যাও বিশ্বজুড়ে কম নয়। কার্টুনিস্ট বব কেইন জন্মেছিলেন ১০৬ বছর আগে ১৯১৫ সালের ২৪ অক্টোবর নিউইয়র্ক শহরের প্রসিদ্ধ কান পরিবারে।
পরে পারিবারিক পদবি পরিবর্তন করে বব কেইন নাম ধারণ করেন। ছবি আঁকার আগ্রহ শৈশবেই জাগে। পেনসিল, রংতুলি নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় কাটাতেন। কুকুর, বিড়াল, টিকটিকি, ইঁদুর সবই আঁকতেন। পারিবারিকভাবেও এ কাজে উৎসাহ পেয়েছেন। এক সময় পোট্রেট আঁকাও শুরু করেন। আর ঠিক এ সময় তার আকাঙ্ক্ষার স্রোতে জোয়ার বইয়ে দেন লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি। বদলে যায় তার চিত্রকর্ম সৃষ্টির পথ। লা ভিঞ্চির কাজ তাকে প্রবলভাবেই বুঝি নাড়া দিয়েছিল।
এক সাক্ষাৎকারে পরবর্তীকালে বব কেইন বলেছেনও, “বারো কি তেরো বছর বয়সে অটোমোবাইল ইঞ্জিনের ডিজাইন-সম্পর্কিত একটি গ্রন্থ কীভাবে যেন হাতে আসে। এর পর পরই দ্য ভিঞ্চির একটি গ্রন্থ আসে হাতে। যাতে আঁকা ছিল একটি ফ্লাই মেশিনের ডিজাইন। মেশিনের পাখা ছিল অনেকটা আমার সৃষ্টি ব্যাটম্যানের মতো। তখন থেকেই মূলত ব্যাটম্যানের মতো একটা কিছু সৃষ্টি প্রেরণা আমার ভেতর কাজ করতে থাকে।”
১৯৩০ সালে বয়স যখন পনেরো, কার্টুন-কমিকস আঁকার কাজ শুরু করেন বব কেইন। কার্টুন তখনও সারাবিশ্বে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি। কার্টুনের পদচারণা তখন সংবাদপত্র তথা প্রকাশনা জগতেই সীমাবদ্ধ ছিল। কার্টুনের ইতিহাস অনেক প্রাচীন। দুই হাজার বছরেরও আগে রোমে খোদাই শিল্পীরা কাঠ বা পাথর খোদাই করে ছোট ছোট ছবি আঁকত। কাঠখণ্ডের এসব চিত্র বেচা-কেনাও হতো।
আধুনিক কার্টুন-কমিকসের প্রতিষ্ঠাতা সুইজারল্যান্ডের রুডলফ টপার নিজের আঁকা কার্টুনচিত্র দিয়ে শতপৃষ্ঠার ‘দি অ্যাডভেঞ্চার অব অবাদিয়াহ ওল্ডবাক’ নামে অ্যালবাম প্রকাশ করেন। ১৮৮২ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে সংশোধিত আকারে প্রথম কমিকস বই হিসেবে ছাপা হয়। অবশ্য পেশাদার কমিকস আঁকিয়ে হিসেবে সে সময় খুব নাম ডাক হয় জার্মানীর উইলিয়াম বাস্কের। ১৮৯৩ সালে নিউইয়র্ক টাইমস ও মর্নিং জার্নাল পত্রিকা দুটিতে কমিকস ছাপা শুরু হয়। ক্রমশ তা পাঠকপ্রিয়তা লাভ করে। সংবাদপত্রের কারণে কমিকসের বিকাশ ঘটে দ্রুত গতিতেই।
একটি জনপ্রিয় ডিটেকটিভ কমিকস, যাকে ডিসি কমিকসও বলা হতো, তা আঁকার মধ্যে দিয়ে বব কেইন পেশাগতভাবে কার্টুন জগতে প্রবেশ করেন। কার্টুন ঢঙের চিত্রকর্মের পাশাপাশি অল্প কথার হাস্যরসাত্মক ডায়লগ দিয়ে গোয়েন্দা গল্প টেনে নিয়ে যাবার আইডিয়া বিশ্বে তখন একেবারেই আনকোরা। সংবাদপত্রের প্রচারণার সুবাদে বব কেইনের কমিকস গ্রন্থ বিক্রির হার বেড়ে গেল। এরই প্রেরণায় বব আরও বেশক’টি কমিকস বই প্রকাশ করেন। তার সৃষ্ট চরিত্রগুলো ছেলেবুড়োদের মুখে মুখে ফিরত। সে সময় গণমাধ্যমের ব্যাপক বিস্তার না ঘটায় বব কেইনের চেহারা পাঠকের কাছে ছিল অপরিচিত।
প্রকাশনা জগতে বব কেইনের অবস্থান তখন শীর্ষে। কার্টুন নিয়ে ব্যাপক চিন্তাভাবনা, গবেষণা শুরু করেন। চলচ্চিত্রের কার্টুনের প্রয়াস ঘটানোর চিন্তা তার অনেক দিনেরই। সীমাবদ্ধ প্রাযুক্তিক কলাকৌশলের কারণে বিষয়টা তখন বেশ কঠিন এবং ব্যয়বহুল ছিল। কারণ প্রতিটি চরিত্রের বা সাবজেক্টের প্রতিটি ‘মুভমেন্ট’ এঁকে এঁকে তা ফ্রেমবদ্ধ করে চলচ্চিত্রে রূপান্তর ঘটিয়ে কার্টুন ছবি নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিলেন বব কেইন।
প্রতিটি চরিত্রের অসংখ্য মুভমেন্ট আঁকার কাজ শুরু করেন। এভাবে দীর্ঘদিন সময় ব্যয় করে, অনেকটা সন্দিহান থেকেই বব কেইন ১৯০৯ সালে ‘ব্যাটম্যান’-এর কাজ শেষ করেন। কাল্পনিক চরিত্র ব্যাটম্যানের লেখক ছিলেন বিল কিঙ্গার। গোয়েন্দা ব্যাটম্যানের নতুন জন্ম হলো বব কেইনের হাতে। আর তখনি কমিকস হয়ে ওঠে সত্যিকারের কমিকস।
বব কেইন সিরিজের পর সিরিজ তৈরি করতে থাকেন ব্যাটম্যান-এর। শৈশবে নিজের চোখের সামনে ডাকাতদের হাতে বাবা-মায়ের খুন হতে দেখেছে ব্যাট। বড় হয়েছে এক এতিমখানায়। তারপর লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকে একের পর এক প্রতিশোধ নিতে থাকে দুর্বৃত্তদের উপর। এরকম টান টান উত্তেজনায় ভরপুর ছিল ‘ব্যাটম্যান’-এর প্রতিটি সিরিজ। ফলে শিশু-কিশোরদের কাছে ব্যাটম্যান হয়ে ওঠে রহস্য রোমাঞ্চের এক স্বপ্নের নায়ক।
এই সফলতার ফলও পুরোপুরিভাবে আসতে থাকে বব কেইনের ভাগ্যে। ক্রমে কার্টুন তথা এনিমেশন ফিল্মজগতে এক ‘প্রবাদ পুরুষ’ ইমেজ প্রতিষ্ঠিত হয় তার। ব্যাটম্যানের হাত ধরেই ১৯৪০ সালে মুভি সিরিয়াল, ১৯৬০ সালে টিভি সিরিয়াল এবং ১৯৮০ সাল থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত বড় বড় বাজেটের ফিল্ম সিরিজ সম্পন্ন করার কৃতিত্ব দেখান বব কেইন। ১৯৯০ সালে নির্মাণ করেন এনিমেশন সিরিজ ‘ডার্ক নাইট’।
‘ব্যাটম্যান’-এর আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তার পর নব্বই দশকে এসে বব কেইনের আরও বেশ কিছু আধুনিক সংস্করণ নিয়ে আসে সমকালের শিশু-কিশোরদের সামনে। ১৯৯২ সালে ব্যাটম্যান রিটার্ন, ১৯৯৬ সালে ব্যাটম্যান ফরএভার, ১৯৯৭ সালে ব্যাটম্যান অ্যান্ড রবিন ইত্যাদি।
“খেলনা, কার্টুন, স্টিকার, টিভি, মুভি কোথায় নেই বব কেইন? সর্বত্রই ব্যাটম্যানের ছড়াছড়ি। আর এই ব্যাটম্যানের পাশাপাশি যুগ যুগ যিনি টিকে থাকবেন তিনিই বব কেইন”- মন্তব্য করেছিলেন বব কেইনের বিভিন্ন ডিসি কমিকস প্রকাশক এবং কমিকস-বিষয়ক ঐতিহাসিক মার্ক এভানি। যার দৃষ্টিতে বব কেইন একজন ‘কাজ পাগলা মানুষ’। বিশ্বজুড়ে কমিকস বইকে প্রকাশনার বিষয় হিসেবে নিয়ে আসা এবং এর বাণিজ্যিক বিস্তারে কৃতিত্বের দাবিদারও বব কেইন।
তখন পর্যন্ত বিশ্বের যেকোনো দেশে কমিকস-বিষয়ক বই সমান জনপ্রিয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, প্রযুক্তির অসুস্থতা, ড্রাগ, দারিদ্র্য ইত্যাদি বিষয়ে তিনি বিপুল বিদ্রূপাত্মক কার্টুন এঁকেছেন। নিজের সৃষ্টি ‘ব্যাটম্যান’ চরিত্রকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বব কেইন বলেছিলেন- বিশ্বের তাবৎ অন্যায়ের বিরুদ্ধে ব্যাটম্যানের নিয়ন্তর যুদ্ধ। অত্যাচারিতের পাশে দাঁড়ানোই তার একমাত্র কাজ।” বব কেইনের জীবনের লক্ষ্যই ছিল নিরন্তর কাজ করে যাওয়া। সে কাজ সৃষ্টিশীলও সৃজনশীল কাজ। জীবনে চরম প্রতিষ্ঠা চলে আসার পরও এবং প্রচুর বিত্ত-বৈভবের অধিকারী হয়েও বব কেইন সার্বক্ষণিক মগ্ন থাকতেন কাজে।
স্ত্রী ছিলেন অভিনেত্রী। সানডার্স কেইন তাকে নিয়মিত উৎসাহ জোগাতেন। এছাড়া নিজের কন্যা, নাতি এবং এক বোন ছায়ার মতো পাশে পাশে থাকতেন। ৮৩ বছর বয়সে ১৯৯৮ সালের তিন নভেম্বর লস এঞ্জেলসে নিজের বাড়িতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুর অল্প ক’দিন আগেও প্রচুর ফ্যানমেইল ‘রিসিভ’ করেছেন। মৃত্যুর পর তার বাড়িটি ফুলে ফুলে ভরে ওঠে। সবই ছিল শিশু-কিশোরদের ভক্তি ও শ্রদ্ধার্ঘ্য। মৃত্যুর পর তার বাড়িটি কার্টুন-কমিকস জাদুঘর করে তোলা হয়েছে।
বব কেইন দীর্ঘদিন ধরে শিশু-কিশোরদের মাতিয়ে রেখেছেন। এই বাংলাদেশে ব্যাটম্যান এখনও জনপ্রিয়। তবে এই সৃষ্টির স্রষ্টা আড়ালেই থেকে গেছেন। তবে তার কর্ম আরও অনেক যুগ ধরে শিশু-কিশোরদের কাছে আদরণীয় হয়ে থাকবে।
লেখক: কবি, একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক ও মহাপরিচালক, প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি)