বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

ফিউচার অব এডুকেশন বা ‘শিক্ষার ভবিষ্যৎ’

  • সাইদুল ইসলাম মিঠু   
  • ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ ২১:২৮

‘শিক্ষা’ এই শব্দটির মাঝে রয়েছে একটি জাতির ভিত্তি গড়ার শক্তি। যুগে যুগে শিক্ষা বদলেছে, বদলেছে তার পদ্ধতি, কিন্তু শিক্ষা অর্জনের মৌলিক উদ্দেশ্য কখনও বদলায়নি মানুষকে মানুষ করে গড়ে তোলা। মানুষ জন্মগতভাবে কৌতূহলী, আর সেই কৌতূহলের পথ ধরে সে খুঁজে পায় জ্ঞান। শিক্ষা হল সেই আলো, যা মানুষকে অন্ধকার থেকে মুক্ত করে জ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত করে তোলে। যুগে যুগে শিক্ষা ব্যবস্থায় এসেছে নানা পরিবর্তন। গুহাচিত্রে শেখা থেকে শুরু করে প্রাচীন গুরুকুল, পাঠশালা, আধুনিক বিদ্যালয় ও আজকের ভার্চুয়াল শ্রেণিকক্ষ সবকিছুই সময়ের দাবিতে গড়ে উঠেছে। কিন্তু আজ আমরা এমন এক যুগে প্রবেশ করছি, যেখানে প্রযুক্তি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI), অটোমেশন, এবং গ্লোবাল কানেকটিভিটির প্রভাবে শিক্ষা একটি নতুন রূপ নিচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে এই পরিবর্তন আমাদের কোথায় নিয়ে যাবে? ২১শ শতাব্দীতে এসে আমরা এক পরিবর্তনের মোড়ে দাঁড়িয়ে আছি, যেখানে প্রযুক্তি, তথ্য, ও নতুন চিন্তাধারার প্রভাবে বদলে যাচ্ছে শিক্ষা ব্যবস্থার রূপরেখা। তাই এখনই সময়, আমরা ভাবি: আগামী দিনে শিক্ষার চেহারা কেমন হবে?

আগামী দিনের শিক্ষা হবে প্রযুক্তিনির্ভর, দক্ষতা-ভিত্তিক এবং আরও বেশি ব্যক্তিকেন্দ্রিক। আমাদের চিন্তা করার ধরন, শেখার প্রক্রিয়া, এমনকি শেখার জায়গাটাও বদলে যাচ্ছে। আধুনিক শিক্ষা আর শুধু বই আর খাতা দিয়ে সীমাবদ্ধ নয় এখন শিক্ষার হাতিয়ার হলো ল্যাপটপ, মোবাইল, ইন্টারনেট এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। আগের দিনে শিক্ষক ছিলেন মূল জ্ঞানদাতা, আর ছাত্র ছিল শ্রোতা; কিন্তু ভবিষ্যতের শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক হবেন একজন গাইড, আর শিক্ষার্থী হয়ে উঠবে নিজের শেখার প্রধান চালক।

  • অনলাইন শিক্ষা: কোভিড-১৯ মহামারী আমাদের শিখিয়ে দিয়েছে শুধু শ্রেণিকক্ষ নয়, স্মার্টফোন বা ল্যাপটপ থেকেও শিক্ষা গ্রহণ সম্ভব। Coursera, Khan Academy, BYJUS, Google Classroom এর মতো প্ল্যাটফর্মগুলো আমাদের দেখিয়েছে বিশ্বমানের শিক্ষা এখন সবার জন্য উন্মুক্ত।
  • এআই এবং মেশিন লার্নিং: কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) শিক্ষার্থীদের শেখার ধরন বুঝে তাদের জন্য কাস্টমাইজড পাঠ তৈরি করতে পারবে। ChatGPT-এর মতো এআই টুলস ইতোমধ্যেই ছাত্রদের প্রশ্নের উত্তর, প্রবন্ধ লেখা, কোড শেখানোসহ অনেক বিষয়ে সাহায্য করছে।
  • ভার্চুয়াল রিয়েলিটি (VR) ও অগমেন্টেড রিয়েলিটি (AR): এই প্রযুক্তির মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা বাস্তব অভিজ্ঞতা নিতে পারবে। যেমন ইতিহাসের ক্লাসে তারা ১৯৪৭ সালের ভারত বিভাগের ঘটনা ‘দেখতে’ পাবে, কিংবা জীববিজ্ঞানের ক্লাসে মানবদেহের ভিতরের অঙ্গগুলোর ভার্চুয়াল ভ্রমণ করতে পারবে।

প্রতিটি শিক্ষার্থী আলাদা, তাদের শেখার ধরনও ভিন্ন। ভবিষ্যতের শিক্ষা ব্যবস্থা একেকজনের সক্ষমতা ও আগ্রহ অনুযায়ী আলাদা পাঠ পরিকল্পনা তৈরি করবে। কেউ যদি চিত্রকলায় ভালো হয়, তবে সে হয়তো তার পাঠের বড় একটা অংশ সেই শিল্পভিত্তিক দক্ষতায় ব্যয় করবে।

আগে যেখানে পুরো শ্রেণিকক্ষে একটাই পাঠ্যক্রম পড়ানো হতো, এখনকার ও আগামী দিনের শিক্ষা আরও ব্যক্তিকেন্দ্রিক হবে। প্রতিটি শিক্ষার্থীর শেখার ধরন, গতি ও আগ্রহ অনুযায়ী তাদের জন্য আলাদা কনটেন্ট ও মেথড থাকবে।

  • যে শিক্ষার্থী দ্রুত শিখতে পারে, সে তার গতিতে এগোতে পারবে।
  • যে একটু ধীরে শেখে, তার জন্য পুনরাবৃত্তিমূলক কনটেন্ট থাকবে।
  • আগ্রহভিত্তিক বিষয় বেছে নেওয়ার সুযোগ থাকবে আরও বেশি।

এভাবে শেখা হবে স্বাধীন, উদ্দীপনামূলক ও দারুণ কার্যকর। আগামী ২০ বছরে এমন অনেক পেশা চলে যাবে, যা আজ রয়েছে। আবার এমন অনেক পেশার জন্ম হবে, যার কথা আমরা এখনো জানি না। তাই শিক্ষার লক্ষ্য হতে হবে শুধু তথ্য মুখস্থ করানো নয়, বরং বাস্তব জীবনে টিকে থাকার উপযোগী দক্ষতা অর্জনের সুযোগ করে দেওয়া।

  • প্রযুক্তিগত দক্ষতা: কোডিং, সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, ক্লাউড কম্পিউটিং, AI, ডেটা অ্যানালিটিক্স।
  • মানবিক দক্ষতা: সমস্যা সমাধান, বিশ্লেষণী চিন্তাভাবনা, সৃজনশীলতা, নেতৃত্ব, যোগাযোগ ও সহানুভূতি।
  • আর্থিক সচেতনতা ও উদ্যোক্তা মনোভাব: ভবিষ্যতের শিক্ষা শিক্ষার্থীদের উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার অনুপ্রেরণা দেবে, শুধু চাকরির জন্য প্রস্তুত নয়।

বর্তমানের পরীক্ষা-কেন্দ্রিক শিক্ষা পদ্ধতি শিক্ষার্থীদের মাঝে চাপ ও প্রতিযোগিতা বাড়িয়ে দেয়। ভবিষ্যতের শিক্ষা হবে ধারাবাহিক মূল্যায়ননির্ভর, যেখানে শিক্ষার্থীর মৌলিক চিন্তাভাবনা, সমস্যা সমাধান, সৃজনশীলতা, দলগত কাজের ক্ষমতা প্রাধান্য পাবে।

  • প্রকল্পভিত্তিক মূল্যায়ন (Project-based Assessment)
  • ই-পরীক্ষা ও অটোমেটেড মার্কিং
  • 360 ডিগ্রি ফিডব্যাক সিস্টেম – যেখানে শিক্ষক, সহপাঠী এবং নিজের মূল্যায়ন মিলিয়ে দক্ষতা যাচাই হবে।
  • একটা সময় শিক্ষক ছিলেন তথ্য সরবরাহকারী। এখন তথ্য সবার হাতে। গুগল সার্চ করলেই জ্ঞান পাওয়া যায়। তাই আগামী দিনের শিক্ষক হবেন অনুপ্রেরণাদায়ী গাইড, যিনি শিক্ষার্থীর মানসিক, নৈতিক এবং সামাজিক বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবেন।
  • শিক্ষক হবেন মানসিক সহায়তাকারী।
  • শিক্ষার্থীর মাঝে অনুসন্ধানী মন তৈরি করবেন।
  • শেখার পরিবেশকে মানবিক ও উৎসাহব্যঞ্জক করবেন।

শুধু দক্ষতা নয়, ভবিষ্যতের সমাজে প্রয়োজন হবে নৈতিক ও মানবিক গুণাবলি। প্রযুক্তির উন্নয়ন যতই হোক, যদি মানুষ মানবতা ভুলে যায়, তবে তা বিপর্যয় ডেকে আনবে। তাই শিক্ষা হবে এমন, যেখানে শেখানো হবে—

  • সহানুভূতি ও সহনশীলতা
  • পরিবেশ সচেতনতা
  • সামাজিক দায়বদ্ধতা
  • দায়িত্ব ও নেতৃত্ববোধ

বাংলাদেশেও শিক্ষার এই পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগছে। নতুন কারিকুলামে দক্ষতা ও মূল্যবোধকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। ডিজিটাল শিক্ষা প্ল্যাটফর্ম, স্মার্ট স্কুল উদ্যোগ, শিক্ষক প্রশিক্ষণ এবং কারিগরি শিক্ষার প্রসার সবকিছু মিলে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এগিয়ে যাচ্ছে।

তবে, এখানেও কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে:

  • প্রযুক্তিগত অপ্রতুলতা
  • গ্রাম-শহরের বিভাজন
  • ইন্টারনেট সুবিধার সীমাবদ্ধতা

এসব মোকাবিলা করে আমরা যদি প্রযুক্তি ও মানবিকতাকে একত্রিত করে শিক্ষার পথকে রচনা করতে পারি, তবে আমাদের ভবিষ্যৎ সত্যিই হবে আশাজাগানিয়া। শিক্ষার ভবিষ্যৎ আমাদের হাতেই। এটি হবে প্রযুক্তিসমৃদ্ধ, মানবিক মূল্যবোধনির্ভর, দক্ষতা ও স্বাধীনচেতা মননের উৎস। পরিবর্তনের এই ঢেউ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার সুযোগ নেই। বরং আমাদের উচিত শিক্ষার এই পরিবর্তনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেওয়া, শিক্ষার্থীদের জন্য এমন একটি পথ তৈরি করা, যেখানে তারা কেবল ভালো পরীক্ষার্থী নয় ভালো মানুষ, দক্ষ পেশাজীবী ও সচেতন নাগরিক হয়ে উঠতে পারে।

শেষ কথায়

বিখ্যাত দার্শনিক জন ডিউই বলেছেন

‘If we teach today’s students as we taught yesterday’s, we rob them of tomorrow.’

তাই আজকের শিক্ষা হতে হবে আগামীর জন্য। শিক্ষা যেন হয়ে ওঠে জীবনের জন্য শিক্ষা শুধু পাস করার জন্য নয়।

লেখক: প্রযুক্তিবিদ ও কলামিস্ট

এ বিভাগের আরো খবর