হেমন্ত কেবল শুরু হয়েছে। রাত নামলেই ছাতিমের সুবাস ছড়িয়ে পড়ে আশপাশে। এখানে ওখানে। এমনকি একটু বাতাস পেয়ে ঘরের ভিতরও ঢুকে পড়ে কখনও কখনও। রাত যত বাড়তে থাকে, ছাতিমের তীব্র সুবাস ততই ছড়ায়। ছাতিমের সুবাস ছড়ানো তেমনি এক হেমন্তের ভোর রাতে জন্ম হলো ওর। সময় তখন ভোর সাড়ে তিনটা। আর তারিখটা ছিল ১৯৬৪ সালের ১৮ অক্টোবর। ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে বড় বোন শেখ হাসিনার ঘরটা ছিল ওর জন্মঘর। জন্মের পর বড় বোন হাসুপা এসে নিজের ওড়না দিয়ে ওর ভেজা মাথা পরিষ্কার করে দিয়েছিলেন। ৩২ নম্বর বাড়িতে আনন্দের বন্যা বয়ে গিয়েছিল। ওর নাম?
ওর বাবা শেখ মুজিবুর রহমান। বাঙালির স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা। বিখ্যাত ব্রিটিশ দার্শনিক, লেখক ও গণিতবিদ বার্ট্রান্ড রাসেলের ভীষণ ভক্ত। বাবা ও মা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব তাদের সবচেয়ে ছোট সন্তানের নাম রাখলেন শেখ রাসেল। তবে স্কুলের খাতায় ওর নাম ছিল রিসাল উদ্দিন। (সূত্র: রাসেল আমাদের ভালোবাসা- শেখ রেহানা)
বাবাকে ভীষণ ভালোবাসত রাসেল। কিন্তু বাবাকে যে বেশিক্ষণ কাছে পেত না। বাবার কত্ত কাজ! বেশিরভাগ সময়ই বাবা থাকতেন জেলে। তবে রাসেলের ভীষণ প্রিয় ছিল হাসুপা। মানে শেখ হাসিনা। হাসুপার চুলের বেণি ধরে খেলত। হাসুপার হাত ধরেই হাঁটা শিখেছিল।
রাসেলের চার বছর বয়সে বাবা শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির মুক্তির সনদ ছয় দফা ঘোষণা করেছিলেন। তাতেই আতঙ্কিত হয়ে উঠেছিল পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। তারা জেলে পুরেছিল বাবাকে। ওর মুখের হাসিও মুছে গিয়েছিল। সারা বাড়ি ঘুরে ঘুরে কেবল বাবাকে খুঁজত ও। মাঝে মাঝে জেলে গিয়ে বাবার সঙ্গে দেখা করে আসত।
এর মাঝে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা হলো বাবার বিরুদ্ধে। বাবার সঙ্গে এবার দেখা করাও বন্ধ। অবশেষে গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে মুক্তি পেলেন বাবা। মুক্তির পর বাবাকে আর চোখের আড়াল হতেই দিতে চাইত না ও। খেলার ফাঁকে ফাঁকে কিছুক্ষণ পর পরই বাবাকে দেখে আসত।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়লাভ করল আওয়ামী লীগ। বাড়িতে মানুষের ভিড়, আত্মীয়-স্বজনদের ঘন ঘন আনাগোনা। বাড়িতে খেলাধুলা করা তো পরের কথা, লেখাপড়া করারও সুযোগ নেই। এমনকি ঘরের ভিতর নিরিবিলি ঘুমানোও যেত না।
একদিন বাবা শেখ মুজিবুর রহমান বাড়ি থেকে বের হলেন না। ঘরে বসে মিটিং করলেন নেতাদের সঙ্গে। অনেক রাতে দোতলায় উঠে এলেন। আত্মীয়-স্বজনরাও চলে গেছেন। সব সময় উপর তলাটা নিরিবিলি রাখার চেষ্টা করতেন মা। যাতে বাবা নিরিবিলিতে ভাত খেতে পারেন, ঘুমাতে পারেন। সেদিন অনেকদিন পর বাবাকে কাছে পেল রাসেল। বাবার পাশে বসে রাসেল আবদার জানাল, ‘মা আমি ভাত খাবো।’
মা বললেন, ‘তুমি তো খেয়েছ বাবা।’
রাসেল জেদ ধরল, ‘আমি আব্বার সঙ্গে খাবো।’
তারপর ওকে কোলে তুলে নিলেন বাবা। বললেন, ‘হ্যাঁ, অবশ্যই তুমি আমার সঙ্গে খাবে।’
তারপর বাবার কোলে বসে বাবার হাতে ভাত খেল রাসেল। ওর মনটাও জুড়াল।
খাওয়ার পর বিছানায় শুয়ে সবার সঙ্গে গল্প জুড়ে দিলেন শেখ মুজিব। সবার লেখাপড়ার খবর নিলেন। হঠাৎ রাসেল প্রশ্ন করল, ‘আব্বা, আমরা নাকি রাওয়ালপিন্ডি চলে যাবো? তুমি নাকি প্রেসিডেন্ট হবে। নিচে সবাই বলে।’
রাসেলের মুখে এমন কথা শুনে হো হো করে হেসে উঠলেন শেখ মুজিব। বাকিরাও না হেসে থাকতে পারলেন না।
সবাইকে হাসতে দেখে বোকার মতো সবার মুখের দিকে তাকাল রাসেল। ভুল কিছু কি বলে ফেলেছে ও? নইলে সবাই ওর কথা শুনে অমন করে হাসছে কেন? তারপর সেটা আড়াল করার জন্য চট করে বলল, ‘আমি কিন্তু এই বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাবো না। মা তুমিও কিন্তু যাবে না।’
কথাটা শুনে ওকে বুকে টেনে নিলেন বাবা। ওর মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বললেন, ‘ঠিক বলেছ রাসেল। এই বাড়ি কেন- এই দেশ ছেড়ে আমরা কোথাও যাব না। এই বাংলার মাটি তো আমাদের জন্মভূমি- মাতৃভূমি। পৃথিবীর যেখানেই থাকি না কেন, আমার এই বাড়ি, আমার এই দেশে আমি ফিরে আসবই। আমি মরে গেলেও আমার লাশটা ঠিক আসবে। এখানেই আমার শান্তি এখানেই আমার সুখ। সেই যে গানটা আছে- সকল দেশের রানী সে যে আমার জন্মভূমি।...’
এরপর এলো মুক্তিযুদ্ধ। বাবাকে তো ওরা বন্দি করে নিয়ে গেল পশ্চিম পাকিস্তানে। আর পরিবারের বাকিদের বন্দি করে রাখল একটা একতলা বাসায়। বড়দের সঙ্গে ছোট্ট রাসেলেরও বন্দিজীবন শুরু হয়েছিল। ঠিকমতো খাবার নেই, খেলনা নেই। বই নেই।
কী যে কষ্টের ছিল সে দিনগুলো! কিন্তু ওর কাছে সেগুলো কোনো কষ্টই ছিল না। তখনও ওর আসল কষ্ট ছিল বাবার জন্য। ওর চোখের কোণে সব সময় পানি আটকে থাকত। কেউ জানতে চাইলে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করত। বলত, ‘চোখে ময়লা’। ততদিনে মনের কষ্ট লুকোনো শিখে গিয়েছিল রাসেল।
১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১। বাংলাদেশ স্বাধীন হলো। কিন্তু রাসেলদের মুক্তি হলো ১৭ ডিসেম্বর সকালে। কিছুদিনের মধ্যে রণাঙ্গণ থেকে বাড়িতে ফিরে এলেন বড়ভাই শেখ কামাল ও শেখ জামাল। ভাইদের পেয়ে রাসেল খুব আনন্দিত। তবে ওর চোখদুটো বলছিল অন্য কথা। চোখ দুটো তখনও ব্যথায় ভরা। বাবা যে এখনও আসেননি! কোথায় বাবা?
বাবা এলেন আরও কিছুদিন পর- ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি। বড়দের সঙ্গে ছোট্ট রাসেলও বাবাকে আনতে এয়ারপোর্ট গিয়েছিল। তারপর বাবাকে নিয়ে যখন বাসায় ফিরল, তখন ওর আনন্দ দেখে কে? একটু সময়ের জন্যও বাবাকে কাছছাড়া করতে চাইত না। যেন বাবাকেই পাহারা দিয়ে রাখত ছোট্ট রাসেল। যাতে আর কেউ ওর কাছ থেকে বাবাকে ছিনিয়ে নিতে না পারে। ছায়ার মতো বাবাকে অনুসরণ করত। দেশ-বিদেশে- সবখানে।
১৯৭৫ সালের ৩০ জুলাই। সেদিন খুব মন খারাপ হয়েছিল রাসেলের। হাসুপা আর আপু (শেখ রেহানা) চলে গেছেন জার্মানিতে। সঙ্গে নিয়ে গেছেন ওর খেলার সঙ্গী হাসুপার ছেলে জয়কে। হাসুপার সঙ্গে রাসেলও যেতে চেয়েছিল। কিন্তু মা ওকে যেতে দেননি। কী করে দেবেন! ওর যে তখন জন্ডিস হয়েছিল। তারপর এলো ভয়ংকর এক কালো রাত।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। ঘাতকদের নির্মম বুলেটে ততক্ষণে প্রাণ হারিয়েছেন ওর বাবা, মা-দুই ভাই, দুই ভাবি আর চাচা। এই ঘাতকদের কাছেই সেদিন করুণ মিনতি করেছিল ছোট্ট রাসেল-আমি মায়ের কাছে যাব।
নিষ্পাপ রাসেলের করুণ মিনতিতে সেদিন ঘাতকদের হৃদয় এতুটুক আর্দ্র হয়নি। কারণ ওরা সেদিন কোনো শিশুর মিনতি শুনতে আসেনি। তবে রাসেলকে সেদিন ঘাতকরা মায়ের কাছেই পাঠিয়েছিল। কিন্তু বড় নির্মমভাবে!
রাসেলের সেদিনের মিনতি, করুণ আর্তনাদ ছুঁয়েছিল কবিহৃদয়ও। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছেন-
‘রাসেল, অবোধ শিশু, তোর জন্যে
আমিও কেঁদেছি
খোকা, তোর মরহুম পিতার নামে যারা
একদিন তুলেছিল আকাশ ফাটানো জয়ধ্বনি
তারাই দুদিন বাদে থুথু দেয়, আগুন ছড়ায়
বয়স্করা এমনি উন্মাদ!
তুই তো গল্পের বই, খেলনা নিয়ে
সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন বয়সেতে ছিলি
তবু পৃথিবী আজ এমন পিশাচী হলো
শিশু রক্তপানে গ্লানি নেই?
সর্বনাশী, আমার ধিক্কার নে!
যত নামহীন শিশু যেখানেই ঝরে যায়
আমি ক্ষমা চাই, আমি সভ্যতার নামে ক্ষমা চাই।’
আজ তোমার জন্মদিনে কবির সঙ্গে আমরাও উচ্চারণ করি- সভ্যতার নামে ক্ষমা চাই রাসেল। তুমি কি আমাদের ক্ষমা করবে?
সহায়ক
রাসেল আমাদের ভালোবাসা- শেখ রেহানা
আমাদের ছোট রাসেল সোনা- শেখ হাসিনা
‘শিশু রক্ত’ -সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।
লেখক: শিশুসাহিত্যিক, কলাম লেখক।