পশ্চিমবঙ্গের এক বন্ধু ১৪ অক্টোবর রাতে মেসেঞ্জারে একটি লাইভ অনুষ্ঠান ফরোয়ার্ড করেছিলেন, যেখানে এক ভারতীয় নাগরিক বাংলাদেশের কুমিল্লায় পূজামণ্ডপে হামলা প্রসঙ্গে ধারাভাষ্য দিয়ে এই অবাঞ্চিত ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করছিলেন। হামলার ভিডিও চিত্রটি তিনি পুরোপুরি দেখাননি, আংশিক দেখিয়ে বার বার বলছিলেন, এ দৃশ্য আমরা দেখাতে চাই না, বিরূপ প্রতিক্রিয়া হবে, যা আমরা কখনও চাই না। ভদ্রলোক বাংলাদেশের একটি অঞ্চল বিশেষের মৌলবাদীদের দ্বারা সংঘটিত এই হামলাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখেননি। মনে হয়েছে যেন বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের একটি রাষ্ট্র। যদিও প্রকৃত বাস্তবতা তা নয়।
বাংলাদেশ বহুকাল ধরে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ হিসেবে সারা দুনিয়ায় প্রশংসিত। এ ধরনের হামলা দেশের হাজার হাজার পূজামণ্ডপের মধ্যে একটি মাত্র বিচ্ছিন্ন ঘটনা। কিন্তু তারপরও আমাদের জন্য এ অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা, এক চরম লজ্জার। দেশের একটি গ্রামের অখ্যাত এক পূজামণ্ডপে এই ঘটনা যারা ঘটিয়েছে, তারা উগ্র সাম্প্রদায়িক এবং এর পেছনে মৌলবাদী রাজনীতি সক্রিয়। সরকারের তরফ থেকে সর্বাত্মক নিরাপত্তা বলয় সৃষ্টির পরেও দেশের পাড়াগাঁর একটি পূজামণ্ডপে এই ঘটনা সমস্ত গৌরবকে ম্লান করে দিয়েছে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাজধানীর তথা দেশের সর্ববৃহৎ মসজিদ বায়তুল মোকাররমে পরদিন শুক্রবার জুমার নামাজ শেষে যে উগ্র প্রতিবাদ মিছিল বেরিয়েছিল, তাও কারো কাঙ্ক্ষিত ছিল না।
ষড়যন্ত্রমূলকভাবে দেশে যারা রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে পূজামণ্ডপে প্রতিমার পায়ের কাছে পবিত্র কোরআন শরিফ রেখে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করতে চেয়েছিল, ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক নষ্ট করার অপচেষ্টা করেছে। সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে নিশ্চয়ই তাদের স্বরূপ উন্মোচিত হবে। কিন্তু তার আগে আমরা লজ্জিত হলাম আমাদের অসাম্প্রদায়িক আদর্শের ওপর কিছু ধর্মান্ধ লোকের এই বর্বর আচরণের কারণে। আমাদের রাষ্ট্রীয় গৌরব ভূলুণ্ঠিত হয়েছে।
এই বর্বরোচিত ঘটনার পর সারা দেশে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। টেলিভিশনের টকশোগুলোতে প্রধান আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠেছে ওই বিচ্ছিন্ন ঘটনাই। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রধানসহ সবাই দোষীদের চিহ্নিত করে উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করার ব্যাপারে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন।
স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, যারা এই অপকর্ম করেছে তাদের এমন শাস্তি দেয়া হবে- যেন ভবিষ্যতে আর কোনোদিন কেউ এ ধরনের দুঃসাহস দেখাতে না পারে। দেশের শান্তিপ্রিয় নাগরিক হিসেবে আমরাও চাই এ ধরনের বর্বরতা চিরতরে বন্ধ হোক।
এই ঘটনার আগে পর্যন্ত আমরা সারা দেশের হাজার হাজার পূজামণ্ডপের যে শান্তি শৃঙ্খলাপূর্ণ পরিবেশ দেখেছি, তাতে সংগত কারণেই সবাই আশা করেছিল, নিরাপত্তার জন্য এবার কোথাও কোনো হুমকি নেই। কিন্তু কুমিল্লা জেলার একটি গ্রামে এই ঘটনা সেই সুন্দর আয়োজন এবং প্রস্তুতিকে শেষ পর্যন্ত প্রশ্নবিদ্ধ করলই।
হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজার উৎসবে মুখর ছিল নেপাল, ভারত, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশসহ গোটা উপমহাদেশ। টেলিভিশন, সংবাদপত্রসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমেও বাংলাদেশে ব্যাপক প্রচার পেয়েছিল প্রতিমা তৈরি থেকে মহানবমী পর্যন্ত সমস্ত আয়োজন। বিজয়া দশমীর সমাপনী অনুষ্ঠানের একদিন আগে এই ঘটনা হিন্দু সম্প্রদায়কে যেমন, তেমনই বাংলাদেশের কিছু ধর্মান্ধ লোক ছাড়া বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকেই ব্যথিত করেছে। আমরা আশা করছি এ নিয়ে ভারত ও বাংলাদেশের কোথাও কারো মনে কোনো ধরনের ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হবে না।
জনসংখ্যার হিসাবে বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের নাগরিকরা কম হলেও সমাজ, রাষ্ট্র ও প্রশাসনে তাদের গুরুত্ব ও অবদান মোটেও কম নয়। গ্রাম-প্রশাসন থেকে উপজেলা, জেলা পার হয়ে প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু সচিবালয় পর্যন্ত সব গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গনে অনেকেই মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত আছেন এবং দেশের সার্বিক উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখে চলেছেন।
আমরা আশা করতে চাই, কুমিল্লার পূজামণ্ডপে হামলায় জড়িত অপরাধীদের খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির মাধ্যমেই দেশের ললাটে লেপ্টে দেয়া এই কলঙ্কের কালি মোচন সম্ভব।
কুমিল্লায় পূজামণ্ডপের ঘটনার ফলোআপ যখন বিভিন্ন গণমাধ্যমে, তখন একই সঙ্গে দেখছি বাড়তি ব্যয়ে বেসামাল মানুষের দুর্ভোগের চিত্র তুলে ধরছে দেশের পত্রপত্রিকা আর টেলিভিশনসহ অনলাইন পোর্টালগুলো। চাল-ডাল, পেঁয়াজ-তেল, চিনিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম গত একমাসে যেভাবে হু হু করে বেড়েছে, তা এককথায় অপ্রত্যাশিত। বাজার নিয়ন্ত্রক অসাধু ব্যবসায়ীদেরই এক একটি সিন্ডিকেট মানুষকে জিম্মি করে প্রতিবছরই এভাবে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে নিত্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়। এবারও তার ব্যতিক্রম নয়।
২৫ টাকার পেঁয়াজ যখন ৮৫ টাকা কেজি হয়, তখন বুঝতে অসুবিধা থাকে না, কীভাবে ১৫ দিনের ব্যবধানে এমন উল্লম্ফন ঘটতে পারে দামের ক্ষেত্রে। চাল বলুন আর পিঁয়াজ বলুন, কোন পণ্যের ঘাটতি নেই দেশে। ধানচালের উৎপাদন যে এত বিপুল পরিমাণ, তারপরও চালের দাম কমে না, বরং বেড়েই চলেছে। কেন বাড়ছে তার কারণ সরকারও জানে এবং সাধারণ মানুষও অনুমান করতে পারে। চালের মজুত তো বেশি থাকার কথা সরকারের গুদামে, কিন্তু সরকারের গুদামের চেয়ে বেশি থাকে চালকল মালিকদের গোডাউনে। পেঁয়াজ-চিনি, তেল-আলুসহ প্রতিটি পণ্যের ক্ষেত্রেই অসাধু মুনাফাখোর ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কারসাজিতে আছে বহু বছর ধরে।
এই সিন্ডিকেট ভাঙতে সরকারকে যথাযথ পদক্ষেপ নিয়েছে। সরকারের মন্ত্রণালয়ের যে বাজার নিয়ন্ত্রণ করবে, তারা কি তাদের যথাসময়ের যথা কাজটি করেন? যে সময় অসাধু ব্যবসায়ী চক্র নিত্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে চলে, তখন কি সরকারের ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ টিসিবি বাজারে পর্যাপ্ত পরিমাণে এই পণ্যটি ছাড়ে? যদি ছাড়তে পারত তাহলে অসাধু ব্যবসায়ীচক্র সাধারণ মানুষকে এইভাবে জিম্মি করতে পারত না।
ভেবে পাই না কোন যুক্তিতে প্রতিবছর আগস্ট-সেপ্টেম্বর আসা মাত্র মানে বর্ষা মৌসুম এলেই পেঁয়াজের দামে মানুষের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে যায়? এ প্রশ্নের সদুত্তর কারো কাছ থেকেই পাওয়া যায় না।
গত ১১ অক্টোবর রাতে একাত্তর টিভির টকশোত ফারজানা রুপা পেঁয়াজের বাণিজ্য-সংশ্লিষ্ট সকলকে উপস্থিত করেছিলেন তার অনুষ্ঠানে। পেঁয়াজের বড় ব্যবসায়ী, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বাজার তদারক করেন- এমন একজন অতিরিক্ত সচিবসহ দুজন সাংবাদিক অনুষ্ঠানে প্রায় এক ঘণ্টাব্যাপী আলোচনা করলেন, কিন্তু কিছুতেই সমাধানে পৌঁছানো গেল না!
পেঁয়াজের ব্যবসায়ীকে বার বার একই প্রশ্ন করা হয়েছিল, ভারতে বৃষ্টি হলে কিংবা রপ্তানি বন্ধ হলে বাংলাদেশের বাজারে দাম বাড়ে, কথা ঠিক, কিন্তু সেই বাড়ার জন্য ভারত থেকে আমদানির যে সময় লাগে, কমপক্ষে সেই ১০দিন তো পুরো বাজারে মূল্য স্থিতিশীল থাকার কথা। পুরোনো পেঁয়াজ কেন বাড়তি দামে তাহলে বিক্রি হবে? এর কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি পেঁয়াজ ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধি ওই নেতা। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ও কেন বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখার কাজটি পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে করতে পারেন না? তারও সদুত্তর পাওয়া যায়নি।
অযৌক্তিক মূল্যবৃদ্ধির ক্ষেত্রে বিশেষ করে তেল আর চিনির কথাটাই বলি। দেশের বাজারে ক্রমাগত তেল আর চিনির দাম বৃদ্ধির ব্যাপারে ওই সব পণ্যের মিল মালিকরা বলছেন বিশ্ববাজারের মূল্য বৃদ্ধির সঙ্গে সমন্বয় করতে গিয়েই এই অবস্থা। কিন্তু আসল ব্যাপার বিশ্ব বাজারের নামে নিজেদের বাড়তি লাভের পরিস্থিতি তৈরি করা।
২০দিন আগের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ভোগ্য পণ্যের মূল্যের এতটা ঊর্ধ্বগতি অযৌক্তিক। গত সেপ্টেম্বরেই দাম বাড়ানো হয়েছে তেল এবং চিনির। আবারও মিল মালিকরা প্রস্তাব করেছেন বিশ্ববাজারে দামের ঊর্ধ্বগতির অজুহাতে কেজিপ্রতি দাম চার থেকে ছয় টাকা বাড়াতে। আন্তর্জাতিক বাজারের তথ্য বিশ্লেষণ করলে নতুন করে দাম বাড়ানোর প্রয়োজন দেখা যায় না। কারণ, টানা বৃদ্ধির পরে এখন বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমতে শুরু করেছে। বর্তমানে অপরিশোধিত সয়াবিনের দাম প্রতি টন ১৩১৪ ডলার। একমাস আগে ছিল ১০৪৫ ডলার। প্রতিটনে কমেছে ৩১ ডলার বা ২ দশমিক ৩০ শতাংশ। কিন্তু আমাদের দেশে তাহলে সয়াবিনের দাম বাড়বে কেন? এই প্রশ্নের সদুত্তর মিলছে না! গত মাসে দেশে ভোজ্যতেলের দাম প্রায় ৬ শতাংশ বেড়েছে!
টিসিবির পরিসংখ্যান অনুযায়ী গত একবছরে দেশে ভোজ্যতেলের দাম বেড়েছে ৫২ শতাংশ আর চিনির দাম বেড়েছে ২৪ শতাংশ। অর্থাৎ বিশ্ববাজারে তেল আর চিনির দাম যে পরিমাণ বেড়েছে তার তুলনায় বাংলাদেশের বাজারে বেড়েছে অনেক বেশি। তারপরও তিনদিন আগে তেল-চিনি পিঁয়াজের শুল্ক কোনো কোনো ক্ষেত্রে তুলে দিয়েছে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে কমিয়ে দিয়েছে সরকার।
বিশ্ববাজারের সঙ্গে দাম সমন্বয় করতে গিয়ে ট্যারিফ কমিশন দফায় দফায় অযৌক্তিক দাবিও মেনে নিয়েছে ব্যবসায়ীদের। আইনে রয়েছে বলে সরকারকে বার বার দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেয়া হয়, যা লোকদেখানো, বলছেন বাজার বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা।
এই যে চাল-ডাল, তেল-চিনি, আটা-পেঁয়াজের দাম বেড়ে চলেছে, তাতে মনে হয় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের যেন কিছুই করার নেই! দেশের ১০টি জেলার মানুষ এখন বন্যাকবলিত। চরম দুর্ভোগে আছে তারা। মূল্যস্ফীতি তাদের মড়ার উপর খাড়ার ঘা হয়ে দেখা দিয়েছে। সরকার লাগামহীন মূল্যস্ফীতির সুযোগ না দিয়ে সময়মতো পর্যাপ্ত আমদানি করলে এবং তা সংস্থা টিসিবির মাধ্যমে বাজারে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দিলে এতটা লুটপাটের সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে না।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার এত উন্নয়ন করে কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে চলেছেন, অর্থনৈতিকভাবে দেশকে দৃষ্টান্তমূলক সাফল্যের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়েছেন, বিশ্ববাসীর কাছে উন্নয়নশীল রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন, অথচ সেই অর্জন নষ্ট করে দেবার মতো সীমিত আয়ের মানুষের চরম দুর্ভোগের কারণ এমন অযৌক্তিক মূল্যস্ফীতিও কি মেনে নেয়া যায়? সীমিত আয়ের বিপুলসংখ্যক নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষ বাজারের আগুনে পুড়ছেন এখন। যেকোনো মূল্যেই হোক এ আগুন নিভাতেই হবে।
লেখক: কবি ও সিনিয়র সাংবাদিক, উপদেষ্টা সম্পাদক দৈনিক দেশের কণ্ঠ।