সাংবাদিকতার অবদান যে কত বড় স্বীকৃতি পেতে পারে, তার প্রমাণ এ বছরের নোবেল শান্তি পুরস্কার। ফিলিপাইনের সাংবাদিক মারিয়া রেসা এবং রুশ সাংবাদিক দিমিত্রি মুরাতভকে ‘মতপ্রকাশের জন্য দুঃসাহসিক লড়াইয়ের স্বীকৃতিস্বরূপ’ এ পুরস্কারে ভূষিত করেছে নোবেল শান্তি কমিটি।
একজন ফিলিপাইনের অনলাইন নিউজপোর্টালে ক্ষমতার অপব্যবহার, সংঘাত সৃষ্টি ও কর্তৃত্ববাদের স্বরূপ উন্মোচনের ক্ষেত্রে দুঃসাহস দেখিয়েছেন, অন্যজন রাশিয়ার প্রতিকূল রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যেও কয়েক দশক ধরে বাকস্বাধীনতার লড়াই চালিয়ে আসছিলেন। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা শুধু সংবাদপত্রের নয়, সমগ্র মানবজাতিরই মৌলিক অধিকার। কর্তৃত্ববাদী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ইতিহাসও প্রায় সভ্যতার সমান বয়সী। তবে সেই লড়াই এবং অধিকার সত্যনিষ্ঠ ও ন্যায়ের ভিত্তির ওপর স্থাপিত হতে হয়। তাহলেই তা স্বীকৃতি পায়। সে জন্য চাই ব্যক্তি মানুষটির সততা এবং যথার্থই পেশাদারত্ব।
না, এ লেখার বিষয় নোবেল শান্তি পুরস্কার নয়; শুধু সাংবাদিকতার শক্তি এবং ঐতিহ্যের সঙ্গে আধুনিকতার সংমিশ্রণে বাংলাদেশের সাংবাদিকতার একটি কালপর্বকে অবলোকন।
গেল সপ্তাহে নিউজবাংলাসহ একাধিক গণমাধ্যমে একটি সচিত্র সংবাদ পড়ে মুগ্ধ হয়েছি। সে সংবাদটি হলো একদা বাংলাদেশের সাংবাদিকতা জগতের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানতুল্য দৈনিক অধুনালুপ্ত ‘দৈনিক বাংলা’র পুনঃপ্রকাশ এবং সম্পাদক হিসেবে বাংলাদেশের সম্পাদনা জগতের জীবন্ত কিংবদন্তি তোয়াব খানকে নিয়োগ। পুষ্পাঞ্জলি দিয়ে তাকে বরণ করে নিচ্ছেন প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধারসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
এ কালের পাঠক কিংবা তরুণ প্রজন্মের অনেকেই হয়তো জানেন না ৫৭ বছর আগে এই দৈনিক বাংলারই বার্তা সম্পাদক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন ‘সংবাদ’ থেকে আসা এক তরুণ সাংবাদিক, তার নাম তোয়াব খান। সংবাদও এ দেশের সাংবাদিকতার এক ঐতিহাসিক প্রগতিশীল প্রতিষ্ঠান।
মুক্তিযুদ্ধ থেকে ফেরার পর ১৯৭২ সালের শুরুতেই বার্তা সম্পাদক তোয়াব খানের ওপরই দৈনিক বাংলার সম্পাদকের গুরুদায়িত্ব বর্তায়। অপরিসীম নিষ্ঠায় তিনি তার মেধা আর প্রতিভা দিয়ে দৈনিক বাংলাকে স্বাধীন দেশের উপযোগী একটি আধুনিকতম পত্রিকা হিসেবে পুনর্জন্ম দিয়েছিলেন। একটি প্রগতিশীল আধুনিক দৈনিক হিসেবে দৈনিক বাংলা বিপুল জনপ্রিয়তাও অর্জন করে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালে তাকে দৈনিক বাংলা থেকে নিয়ে গিয়েছিলেন তার প্রেস সচিব করে। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর দৈনিক বাংলায় ফিরতে পারেননি তিনি। তাকে পিআইডি, পিআইবিসহ তথ্য মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন উইংয়ে দায়িত্ব পালন করতে হয়। পুনরায় সম্পাদক হিসেবে তিনি ফিরে এসেছিলেন ১৯৯১ সালে। কিন্তু তখন দৈনিক বাংলা এক ডুবন্ত জাহাজ। সেই ডুবন্ত জাহাজটি তিনি তার নিষ্ঠা আর মেধা-প্রতিভা দিয়ে টেনে তুলেছিলেন। মাত্র এক বছরের মধ্যেই আবার জনপ্রিয় হয়ে উঠছিল দৈনিকটি, আর সেই সময়েই তাকে চাকরিচ্যুত করে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকার।
দৈনিক বাংলার সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাংলাদেশের সাংবাদিকতার ইতিহাস। ১৯৬৪ সালের ৬ নভেম্বর আজকের এই দৈনিক বাংলা প্রকাশ করেছিল প্রেস ট্রাস্ট অব পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ। এর তৎকালীন নাম ছিল দৈনিক পাকিস্তান। মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পরদিন এই পত্রিকার নামকরণ হয় প্রথমে ‘দৈনিক বাংলাদেশ’, পরে ‘দৈনিক বাংলা’। সরকারি পত্রিকা হয়েও বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল এই পত্রিকাটি পাকিস্তান আমলে। চমৎকার মেকআপ, গেটআপ, নিউজের উন্নত মানের টেক্সট, আকর্ষণীয় ফিচার এবং দৃষ্টিকাড়া লাইনো টাইপের ঝকঝকে মুদ্রণ মন কেড়েছিল সবার।
দেশের প্রগতিশীল সাহিত্যিক-সাংবাদিক লেখকরা যুক্ত হয়েছিলেন এই পত্রিকার সঙ্গে। আহসান হাবীব, শামসুর রাহমান, মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ, ফজল শাহাবুদ্দীনের মতো কবিদের পাশাপাশি এই কাগজে যোগ দিয়েছিলেন তোয়াব খান, ফওজুল করিম (তারা), নির্মল সেন, মাফরুহা চৌধুরী, আহমেদ হুমায়ুন প্রমুখ স্বনামখ্যাত সাংবাদিক। রিপোর্টিং টিমে যোগ দেন আলী আশরাফ, মাশির হোসেন, ফজলুল করিম, হেদায়েত হোসেন মোরশেদ, মনজুর আহমদ, শওকত হোসেন, আহমেদ নূরে আলম, জহিরুল হকের মতো সেই সময়ের মেধাবী সাংবাদিকরা। আলোকচিত্রী হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন গোলাম মাওলার মতো ঝানু আলোকচিত্রী, কালাম মাহমুদের মতো প্রখ্যাত শিল্পী। পরবর্তীকালে যুক্ত হয়েছিলেন অলোকেশ ঘোষ, সৈয়দ লুৎফুল হক প্রমুখ শিল্পী। দৈনিক পাকিস্তানের ‘শেষ পাতা’র ফিচারসহ পুরো পত্রিকাটির নতুন অনেক কিছুরই পরিকল্পক ও নেপথ্য কারিগর ছিলেন তোয়াব খান।
নিউজ আর ফিচার পাতাগুলোর মেকআপ ছিল আন্তর্জাতিক মানের। ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান থেকে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত সরকারি ট্রাস্টের কাগজ হয়েও দৈনিক পাকিস্তান ছিল বাংলার মানুষের অধিকারের পক্ষে! সেই প্রগতিশীল সাহসী সাংবাদিকতার ধারাবাহিকতা তথা গৌরবের ঐতিহ্য ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত অক্ষুণ্ন ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যই বলতে হবে, গৌরবময় সেই দৈনিক বাংলা ’৭৫-পরবর্তীকালে সাম্প্রদায়িকতার পক্ষেই দাঁড়িয়েছিল, খালেদা জিয়ার ভুয়া জন্মদিন ১৫ আগস্ট পত্রিকায় প্রথম ছাপা হয়। বঙ্গবন্ধু তার পরিবার এবং বঙ্গবন্ধু সরকারের আমল নিয়ে এমন সব বিরূপ অপপ্রচারে পত্রিকাটি অংশ নেয়, যা সত্যিই দুঃখজনক।
একই সঙ্গে জনপ্রিয় সাপ্তাহিক তথা এই পত্রিকার অঙ্গপ্রতিষ্ঠান সাপ্তাহিক বিচিত্রায় সেই দুঃখজনক ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। দৈনিক বাংলায় হাতে গোনা দু-একজন সাংবাদিকই সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন, তাদেরই একজন ছিলেন বিচিত্রার সম্পাদক। দুর্ভাগ্য, আওয়ামী লীগের তীব্র বিরোধিতা করতে গিয়ে তারা পরোক্ষে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধের শক্তিরই সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিলেন! গৌরবের ঐতিহ্যের অধিকারী একটি পত্রিকার এমন অধঃপতন কল্পনারও অতীত ছিল!
যে কারণে আওয়ামী লীগ ২১ বছর পরে ক্ষমতায় ফিরে এসে পত্রিকাটি বন্ধ করে দেয়। ১৯৯২ সালে তোয়াব খান চাকরিচ্যুত হয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধের অপশক্তির পক্ষে অবস্থান না নেয়ার কারণেই। একজন পেশাদার সম্পাদক পেশাদারি আচরণই করতে চেয়েছিলেন।
যা হোক, দীর্ঘ ২৩ বছর পর বেসরকারি মালিকানায় দৈনিক বাংলা প্রকাশিত হতে যাচ্ছে এবং এর সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণে সম্মত হয়েছেন বর্ষীয়ান সম্পাদক তোয়াব খান, এটা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের সংবাদপত্র জগতে এক আনন্দের সংবাদ। যারা পত্রিকাটি প্রকাশ করছেন তাদের অভিনন্দন জানাই দুটি কারণে।
এক. তারা নতুন কোনো নামের পত্রিকা না করে একটি ঐতিহ্যবাহী পত্রিকার নাম বেছে নিয়েছেন, বাংলাদেশের সংবাদপত্রের ইতিহাসে হয়তো এর মাধ্যমে একটি নতুন যুগের সূচনা হবে। দুই. অভিনন্দন আরও এক কারণে, তা হলো- তোয়াব খানের মতো বিরল গুণের অধিকারী একজন অসাধারণ পেশাদার সম্পাদককে বেছে নেয়া।
আমার সাংবাদিকতা জীবনে সাতজন সম্পাদকের নেতৃত্বে কাজের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, সবকিছুতেই তোয়াব খান অতুলনীয়। বঙ্গবন্ধু-বাংলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধ তার প্রাণের স্পন্দন হলেও সম্পাদক হিসেবে তিনি বিস্ময়করভাবে নিরপেক্ষ। শতভাগ পেশাদার। সততা, দক্ষতা আর যোগ্যতাই তার কাছে পছন্দের মাপকাঠি। যে কারণে সম্পূর্ণ ভিন্নমতের বহু সাংবাদিককে তিনি তার সঙ্গে কাজ করার সুযোগ দিয়েছিলেন দৈনিক জনকণ্ঠে। যোগ্যতার মানদণ্ডেই তিনি সবার কাজের মূল্যায়ন করেছেন।
সৌভাগ্যই বলতে হবে, দৈনিকে আমার সাংবাদিকতার শুরু হয়েছিল ১৯৭৯ সালে দৈনিক বাংলায়। দুবার আমি তোয়াব ভাইয়ের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি, দৈনিক বাংলায় বছর দেড়েক আর দৈনিক জনকণ্ঠে একটানা ১৫ বছর। খুব কাছ থেকে দেখেছি তার কর্মস্পৃহা আর সত্যনিষ্ঠ উদার মানসিকতা। তিনি এতটাই মোহমুক্ত এবং স্বল্পবাক মানুষ তার কাজের বাইরে অন্যকিছুই ভাবতে পারেন না। আত্মপ্রচারের ব্যাপারে কঠিনভাবে সংকুচিত।
কেউ তার মুখোমুখি প্রাপ্য প্রশংসাটুকু করলেও বিরক্ত হতেন। সর্বক্ষণ তার ধ্যান-জ্ঞান কাগজের মানোন্নয়ন এবং সৃজনশীলতায় নতুন উদ্ভাবন। দেশের সব দৈনিকে আজ শিক্ষাপাতা দেখা যায়। এরও পথিকৃৎ তোয়াব খান। দেশের মানুষের দৈনন্দিন চাহিদার বিষয়গুলো, মানবাধিকার রক্ষার বিষয়গুলো জনকণ্ঠের প্রথম পৃষ্ঠায় স্থান দিয়েছিলেন তিনি। ‘সেই রাজাকার’ শিরোনামের দেশ কাঁপানো প্রতিবেদন জনকণ্ঠের প্রথম পৃষ্ঠায় চালু করে দেশের ৬৪ জেলার রাজাকারদের স্বরূপ উন্মোচনে জনকণ্ঠ নিয়েছিল ঐতিহাসিক ভূমিকা। বাংলাদেশে ৬ কলামের প্রথম এবং শেষ পৃষ্ঠার দৈনিকেরও পথিকৃৎ তিনি।
বাংলা ভাষার তথা দুই বাংলার শ্রেষ্ঠ লেখক-কলাম লেখকদের মহামিলন ঘটিয়েছিলেন তিনি দৈনিক জনকণ্ঠে। একটি দৈনিক পত্রিকা যে সংবাদ অভিমত প্রকাশের বাইরেও বহু সামাজিক কল্যাণমূলক ভূমিকা পালন করতে পারে, সে পথ এ দেশে তিনি প্রথম দেখিয়েছিলেন জনকণ্ঠের মাধ্যমে। যতদিন মালিক কর্তৃপক্ষ পত্রিকার টেক্সট নিয়ে হস্তক্ষেপ করেনি, সাংবাদিকতা বুঝতে যায়নি ততদিনই দৈনিক জনকণ্ঠ ঐতিহ্যের সঙ্গে আধুনিকতার আশ্চর্য সমন্বয় ঘটিয়ে অসাধ্য সাধন করে একটি উৎকৃষ্ট দৈনিক হিসেবে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত মানুষের ঘরে ঘরে টিকে ছিল।
আমার ধারণা ছিল প্রকাশক ও সম্পাদক আতিকুল্লাহ খান মাসুদের মৃত্যুর পর এই কিংবদন্তি সম্পাদকের নামটিই প্রিন্টার্স লাইনে শোভা পাবে। কিন্তু আমার সে ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। একেই বলে মানুষের অজ্ঞানতা। তোয়াব খানের নাম কোনো দৈনিকের প্রিন্টার্স লাইনে থাকা যে সেই দৈনিকের জন্য কতটা ওজন, এটা বোঝার মতো মেধা এবং প্রজ্ঞা থাকতে হয়। টাকা থাকলেই শিল্পপতি হয় না, শৈল্পিক মানসিকতাও থাকতে হয়।
যা হোক, যে দুই সাংবাদিক নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছেন মতপ্রকাশের দুঃসাহসিক লড়াইয়ের স্বীকৃতি হিসেবে, সেই লড়াই তোয়াব খানও করেছেন, তা দৈনিক বাংলায় যেমন, জনকণ্ঠেও তেমনি। সত্য প্রকাশের সাহস দেখিয়েছিলেন সরকারি ট্রাস্টের পত্রিকা দৈনিক বাংলার সম্পাদক হয়ে। পুলিশের গুলিতে ছাত্র নিহত হওয়ার ঘটনায় টেলিগ্রাম প্রকাশের অসীম সাহস দেখিয়েছিলেন। তিনি স্বাধীনতাবিরোধীদের মুখোশ উন্মোচন করেছেন জনকণ্ঠের রিপোর্টিংয়ে এবং অভিমত বিভাগে।
যা হোক, দৈনিক বাংলায় দেশের সর্বজ্যেষ্ঠ সম্পাদক এবং সর্বকনিষ্ঠ নির্বাহী সম্পাদকের সমন্বয় দেখে আশাবাদী হচ্ছি এই ভেবে যে, ঐতিহ্যের সঙ্গে আধুনিকতার সমন্বয়ে মহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে একুশ শতকের দৈনিক বাংলা মুক্তিযুদ্ধের রক্তফসল এই বাংলাদেশের কল্যাণে অসামান্য ভূমিকা পালন করবে, সংবাদপত্রের জগতে যুক্ত হবে গৌরবের আরেকটি নতুন পালক, এই শুভকামনা নিয়েই বলি জয়তু দৈনিক বাংলা!
লেখক: কবি ও সিনিয়র সাংবাদিক। উপদেষ্টা সম্পাদক, দৈনিক দেশের কণ্ঠ