গত দেড় বছরেরও বেশি সময় আমরা হতবিহ্বল, ভীতিকর, কষ্টকর নিদারুণ এক জীবন যাপন করছি। মৃত্যু, সংক্রমণ, দুর্দশা, উৎকণ্ঠা, অভাব, অবিশ্বাস আর হাহাকার ছিল খবরের শিরোনাম। এই জীবনে ক্লান্ত, বিপর্যস্ত, বিধ্বস্ত মানবজাতি।
সংখ্যাতিরিক্ত অকস্মাৎ মৃত্যুর আঘাতে অসংখ্য পরিবার ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। অনাহুত এই সময়ে আমরা দেশ-বিদেশে বহুজনকে হারিয়েছি। দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর মৃত্যুর মিছিল দেখতে দেখতে অবসন্ন হয়ে পড়েছি। স্বজনহারানোর মর্মস্পর্শী বেদনায় বিদীর্ণ একেকটি পরিবার। মহামারির ভয়ংকর ছোবলে সেই পরিবারগুলোর আত্মবিলাপও যেন নিঃশব্দ ছিল।এই দীর্ঘ সময়ে সব কিছুই ছিল স্থবির। অর্থনীতি, শিক্ষায় সীমাহীন প্রভাব পড়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় ধস নেমেছে, পড়াশোনা হয়নি বললেই চলে। পরিবারগুলোর অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তায় অসংখ্য শিক্ষার্থীর জীবন পুরোই পাল্টে গিয়েছে। কোনো কোনো পরিবারের মাসিক আয় কমেছে, কারো পেশা বদলে গিয়েছে, কারো উপার্জন প্রায় পুরোটাই বন্ধ। কেউ কেউ শহর ছেড়ে গ্রামে ফিরেছে। সন্তানরাও এতদিন ধরে নিরন্তর যুদ্ধ চালিয়েছে পরিবারের সঙ্গে। প্রান্তিক মেয়েদের একটা বড় অংশ বাল্যবিবাহের শিকার হয়েছে।
শিশু থেকে শুরু করে প্রাপ্তবয়স্ক বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী, যারা ইতোমধ্যে শ্রমবাজারে প্রবেশ করেছে, তারা আর কখনই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ফিরবে বলে মনে হয় না। বিপর্যয়ের ধাক্কা লেগেছে ঘরের ভেতরেও। ভয়, মানসিক অবসাদ, বিষণ্ণতা, চাকরি হারানো, অর্থনৈতিক টানাপোড়েন সব মিলিয়ে কত যে ঘর ভেঙেছে, তার হিসেব নেই। তছনছ হয়ে গেছে অনেক পরিবার। করোনার দীর্ঘ অভিঘাতে এমন অসংখ্য হৃদয়বিদারক ঘটনায় লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে অনেকের জীবন।
করোনার ঢেউগুলো এখন স্তিমিত প্রায়। দেশে সংক্রমণ ক্রমেই নিয়ন্ত্রণে আসছে। সংক্রমিত নতুন রোগী, পরীক্ষার বিপরীতে রোগী শনাক্তের হার, মৃত্যু— সবই ক্রমান্বয়ে কমছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) নির্ধারণ করা মানদণ্ড অনুযায়ী কোনো দেশে রোগী শনাক্তের হার টানা দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে ৫ শতাংশের নিচে থাকলে করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে ধরা যায়। দেশে সংক্রমণের হার গেল দুই সপ্তাহের বেশি সময় ৫ শতাংশের নিচে এবং এক সপ্তাহ ধরে তিন শতাংশেরও নিচে। সংক্রমণ বন্ধ হয়নি কিন্তু এর প্রকোপ কমেছে, ভয়াবহতা কমেছে। এই যে ক্রমান্বয়ে কমছে- এটাই আমাদের জন্য সবচেয়ে স্বস্তির খবর।
পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে এসেছে যে, এই অদৃশ্য ভাইরাসের সঙ্গে লড়াই করতে করতে, তাকে নিয়ে চলতে আমরা অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি। এখন আর করোনায় আক্রান্ত রোগীর বাসায় লাল পতাকা নেই, রোগীর অবস্থান নিয়ে ফলাও করে প্রচারও নেই। লকডাউন, শাটডাউন, আইসোলেশন, কোয়ারেন্টাইন শব্দগুলো মানুষের মুখে মুখে আর খুব বেশি শোনা যায় না। অক্সিজেন সিলিন্ডারের কাড়াকাড়ি নেই, আইসিইউ-ভেন্টিলেটার জোগাড় করতে না পারার তীব্র হতাশা নেই। অ্যাম্বুলেন্সের তীক্ষ্ণ-তীব্র সাইরেনের শব্দ এখন আর সে অর্থে প্রচণ্ড আতঙ্ক জাগায় না। ভার্চুয়াল শব্দটির প্রতিও তীব্র অনীহা চলে এসেছে।
এই দীর্ঘ সময়ে একটি মাত্র ভালো শিরোনাম ছিল- ভ্যাকসিন; যা মানবজাতিকে আশার আলো দেখিয়েছে, বেঁচে থাকার সাহস জুগিয়েছে, স্পন্দিত করেছে। খুব স্পষ্ট করেই বলা যায়, সংক্রমণ ঠেকানোর মূল দায়িত্বও পালন করেছে ভ্যাকসিন। মানব ইতিহাসের স্বল্পতম সময়ে ভ্যাকসিনের আবিষ্কার ঠেকিয়ে দিয়েছে লক্ষ কোটি মানুষের প্রাণ। যদিও ইতোমধ্যে দেশে ২৭ হাজারেরও বেশি এবং সারা বিশ্বে প্রায় পঞ্চাশ লাখ মানুষের জীবন কেড়ে নিয়েছে এই অদৃশ্য ঘাতকটি। তবে নতুন নতুন ঢেউ এলেও ঠেকিয়ে দেবে ভ্যাকসিন; এটি এখন শুধু প্রত্যাশা নয়, বাস্তবতা।
এখন পর্যন্ত আমাদের দেশে টিকা এসেছে ৫ কোটি ৬০ লাখ ডোজ। দুই ডোজ পেয়েছে ১ কোটি ৭০ লাখ এবং এক ডোজ করে পেয়েছে ৩ কোটি ৩৪ লাখ মানুষ। সরকার ৮০ শতাংশ মানুষকে টিকা দানের আওতায় আনতে চায়। টিকা সংগ্রহে পিছিয়ে থাকলেও আশা করা যায়, সরকারের সদিচ্ছায় দ্রুতই এই সংকট কেটে যাবে।বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মূল্যায়ন অনুযায়ী- মডার্না, ফাইজার, আ্যাট্রাজেনেকা, জনসন অ্যান্ড জনসন, সিনোফার্মা এবং সিনোভ্যাকের টিকা নিরাপত্তা ও কার্যকারিতার সব শর্ত পূরণ করেছে। বাংলাদেশও এই ছয়টি টিকার অনুমোদন দিয়েছে।এখন আর নেতিবাচক খবরগুলো দিতে চাই না। আপাতত বিশ্লেষণ করতেও চাই না সেই অদৃশ্য ঘাতকের স্পর্ধা নিয়ে। করোনাকালীন জীবন কাহিনি লিখতে লিখতে আমরা ক্লান্ত, বিপর্যস্ত, দিশেহারা।এখন লিখতে চাই স্বস্তির কথা, আনন্দের কথা, উদযাপনের কথা, জীবনে ফেরার কথা। আশা-আকাঙ্ক্ষা, আনন্দ-স্বপ্ন দেখা এমন সব আবেগের বিষয়গুলোকে আবারও ফিরিয়ে আনতে চাই চলমান জীবনে।
এরই মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো আংশিকভাবে খুলে দেয়া হয়েছে। কলকারখানা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আগে থেকেই চালু। যানবাহনও চলছে পুরোদমে। হাটবাজার, দোকানপাট বেশ আগেই খুলে গেছে। পর্যটন এলাকাগুলো এখন মানুষের কলকাকলিতে মুখরিত। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে স্থবিরতা ক্রমান্বয়ে কাটছে। দেড় থেকে দুই বছরের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে উন্মুখ হয়ে আছে দেশের কর্মচঞ্চল মানুষ। নতুন উদ্যমে ঝাঁপিয়েও পড়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দা কাটিয়ে অর্থনীতির নতুন গতিপথ সৃষ্টির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। সব মিলিয়ে করোনাকালীন এবং করোনা-উত্তর সময়টা বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতির জন্য ভালো যাবে- এই আশাবাদ ব্যক্ত করাই যায়।
হয়তো একদিন করোনা চলে যাবে ইতিহাসের পাতায়, রেখে যাবে বিধ্বংসী স্বাক্ষর। গল্প-ছবি, কাব্য কিংবা সিনেমায় উঠে আসবে এমন দিনের চিত্র। উত্তর প্রজন্ম ইতিহাস ঘেঁটে জানবে এক গভীর কালো অন্ধকার নেমেছিল এই পৃথিবীতে। এক অদ্ভুত অদেখা রহস্যময় প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়েছিল প্রায় প্রতিটি মানুষ। অথবা পূর্ব প্রজন্মের মুখে শুনবে এক নীরব ঘাতক স্তব্ধ করে দিয়েছিল সারা পৃথিবীর মানুষের প্রাণের গতি।
অন্ধকার কেটে গিয়ে আবার ফিরে আসছে সোনালি দিন। সুস্থ হয়ে উঠছে ধরিত্রী। আর নিউ নর্মালের নামে অ্যাবনর্মাল নয়, ওয়ার্ক ফ্রোম হোম নয়, মুখোশের আড়ালে ঢেকে যাওয়া মুখচ্ছবি নয়; খুব স্বাভাবিক সুস্থ দিনযাপনে অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা করছি আমরা। দিগন্তের শেষে নতুন আলোক রেখা উদ্ভাসিত হয়ে উঠছে। নতুন সূর্যের সোনালি আলোতে নতুন দিন শুরুর আভাস মিলছে।
লেখক: প্রাবন্ধিক-শিক্ষক