বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

খাদ্য, পানি, বায়ু ও প্রকৃতি নিরাপত্তার সন্ধানে

  • সম্পাদকীয়   
  • ২ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ ২২:৩২

মানব জীবনের টিকে থাকার মূল ভিত্তি হলো খাদ্য, পানি, বায়ু এবং প্রকৃতি। এ চারটি উপাদান ছাড়া জীবন কল্পনাই করা যায় না। কিন্তু আধুনিক সভ্যতার অগ্রগতি, অতিরিক্ত শিল্পায়ন, জনসংখ্যার চাপ, নগরায়ণ এবং পরিবেশ দূষণের কারণে আজ এ মৌলিক উপাদানগুলো বিপর্যয়ের মুখে। টেকসই ভবিষ্যতের জন্য খাদ্য, পানি, বায়ু ও প্রকৃতির সুরক্ষা নিশ্চিত করা এখনই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।খাদ্য সুরক্ষা: খাদ্য হলো মানুষের মৌলিক অধিকার। কিন্তু নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্যের অভাবে বিশ্বব্যাপী কোটি কোটি মানুষ অপুষ্টি ও রোগব্যাধিতে ভুগছে। কৃষিতে অতিরিক্ত কীটনাশক ও রাসায়নিক সার ব্যবহারের কারণে খাদ্যদ্রব্যে বিষাক্ত উপাদান জমছে, যা মানুষের স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। অপরদিকে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে খাদ্য উৎপাদন হুমকির মুখে। বাংলাদেশসহ বহু দেশে খরা, বন্যা, লবণাক্ততা এবং অনিয়মিত বৃষ্টিপাতের কারণে কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। খাদ্য সুরক্ষার জন্য প্রয়োজন জৈব কৃষি সম্প্রসারণ, নিরাপদ খাদ্য সংরক্ষণ ব্যবস্থা, কৃষকের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিতকরণ এবং খাদ্য অপচয় রোধ। পাশাপাশি খাদ্যপণ্যে ভেজাল ও রাসায়নিক ব্যবহার কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।পানি সুরক্ষা: পরিষ্কার ও নিরাপদ পানি মানুষের সুস্থ জীবনের অপরিহার্য উপাদান। কিন্তু ভূগর্ভস্থ পানির অতিরিক্ত উত্তোলন, শিল্প বর্জ্য, কীটনাশক, এবং প্লাস্টিক দূষণের কারণে পানির গুণমান দ্রুত নষ্ট হচ্ছে। বাংলাদেশে আর্সেনিক দূষণ ইতোমধ্যেই লক্ষ লক্ষ মানুষের জন্য মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি করেছে। একই সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পানির স্বল্পতা ও লবণাক্ততা বেড়ে চলেছে। পানি সুরক্ষার জন্য বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ, নদী ও খাল পুনরুদ্ধার, পানি দূষণ নিয়ন্ত্রণে আইন প্রয়োগ এবং পানির সাশ্রয়ী ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য কার্যকর বর্জ্য শোধনাগার স্থাপন বাধ্যতামূলক করা জরুরি।বায়ু সুরক্ষা: বায়ুদূষণ বর্তমানে বৈশ্বিক স্বাস্থ্যঝুঁকির অন্যতম বড় কারণ। যানবাহনের কালো ধোঁয়া, শিল্প কারখানার নির্গমন, নির্মাণকাজ এবং জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বায়ুকে বিষাক্ত করে তুলছে। ঢাকাসহ বিশ্বের বড় বড় শহরগুলোতে বায়ুর মান বিপজ্জনক মাত্রায় পৌঁছে গেছে, যার ফলে শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি, ফুসফুস ক্যান্সারসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। বায়ু সুরক্ষার জন্য প্রয়োজন পরিচ্ছন্ন জ্বালানির ব্যবহার, গাছ লাগানো, গণপরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন, যানবাহনে মানসম্মত জ্বালানি ব্যবহার এবং শিল্প বর্জ্য নিয়ন্ত্রণ। একই সঙ্গে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহারকে উৎসাহিত করতে হবে।প্রকৃতি সুরক্ষা: প্রকৃতি আমাদের জীবনের মূল সহায়ক। বন, নদী, পাহাড়, প্রাণীজগত এবং জীববৈচিত্র্য আমাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখে। কিন্তু বন উজাড়, পাহাড় কাটা, নদী দখল, প্লাস্টিক দূষণ এবং প্রাণীর আবাসস্থল ধ্বংসের কারণে প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। এর ফলে জলবায়ু পরিবর্তন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি বাড়ছে। প্রকৃতি সুরক্ষার জন্য বন সংরক্ষণ ও বৃক্ষরোপণ, নদী ও জলাশয় রক্ষা, বন্যপ্রাণী সুরক্ষা আইন কার্যকর করা এবং টেকসই উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন অপরিহার্য। একই সঙ্গে মানুষের ভোগবাদী মনোভাব পরিবর্তন করে প্রকৃতির সঙ্গে সহাবস্থান নিশ্চিত করতে হবে।খাদ্য, পানি, বায়ু এবং প্রকৃতি, এ চারটি উপাদানই মানবজীবন ও পৃথিবীর টেকসই অস্তিত্বের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। এগুলোর সুরক্ষা ছাড়া স্বাস্থ্য, অর্থনীতি কিংবা উন্নয়নের কোনোটিই সম্ভব নয়। তাই সরকার, নাগরিক সমাজ, শিল্প প্রতিষ্ঠান এবং প্রতিটি মানুষের সম্মিলিত উদ্যোগের মাধ্যমে পরিবেশবান্ধব নীতি ও কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে হবে। এখনই যদি আমরা সচেতন হই এবং সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করি, তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি বাসযোগ্য পৃথিবী নিশ্চিত করা সম্ভব।নীতি নয়, বাস্তবায়ন জরুরি:পরিবেশ সুরক্ষায় নীতি নয়, এখন কার্যকর বাস্তবায়ন জরুরি। বাংলাদেশসহ বিশ্বের সব দেশেই পরিবেশ সুরক্ষার জন্য নানা ধরনের নীতি, আইন ও কৌশলগত পরিকল্পনা তৈরি হয়েছে। কাগজে-কলমে এই নীতিগুলো নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়, তবে বাস্তবতায় এগুলোর প্রভাব খুব সীমিত। বন উজাড়, বায়ুদূষণ, পানিদূষণ, কৃষিজমি কমে যাওয়া, প্লাস্টিক বর্জ্যের বিস্তার, নদী দখল ও ভরাট, এসব সমস্যার মূল কারণ হচ্ছে কার্যকর বাস্তবায়নের ঘাটতি। শুধু নীতি প্রণয়ন করলেই পরিবেশ রক্ষা সম্ভব নয়, এর জন্য শক্তিশালী প্রশাসনিক পদক্ষেপ এবং জনসচেতনতার সমন্বিত প্রয়োগ জরুরি। নীতিগত কাঠামোতে পরিবেশের সুরক্ষা প্রাধান্য পেলেও বাস্তবে দেখা যায় শিল্প-কারখানার বর্জ্য পরিশোধন ছাড়াই নদীতে ফেলা হচ্ছে, নগরীতে নিয়ম ভঙ্গ করে বহুতল ভবন গড়ে উঠছে এবং বনভূমি ক্রমাগত ধ্বংস হচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে আইন থাকা সত্ত্বেও কার্যকর তদারকি ও কঠোর শাস্তির অভাব সমস্যাকে গভীরতর করেছে। পরিবেশ সুরক্ষার জন্য এখন সবচেয়ে প্রয়োজন নিয়মিত মনিটরিং, জবাবদিহি ও শাস্তির বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা। এছাড়া, জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া টেকসই পরিবেশ সুরক্ষা সম্ভব নয়। শিক্ষা, গণমাধ্যম এবং প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা দরকার। একই সঙ্গে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার, বর্জ্য পুনর্ব্যবহার এবং সবুজ শিল্প গড়ে তোলার মাধ্যমে একটি পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন কাঠামো দাঁড় করাতে হবে। অতএব, পরিবেশ সুরক্ষার জন্য নতুন নতুন নীতি নয়, বরং বিদ্যমান আইন-কানুন ও নীতির কঠোর ও কার্যকর বাস্তবায়নই এখন সময়ের দাবি। কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা গেলে আমাদের পরিবেশ, স্বাস্থ্য এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্ম, সবাই নিরাপদ থাকবে।টেকসই উন্নয়নে চাই জীবনধারায় বিবর্তন:টেকসই উন্নয়নের জন্য জীবনধারায় বিবর্তন আনতে হবে। বর্তমান বিশ্ব দ্রুত উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছে, তবে এই অগ্রযাত্রা অনেক ক্ষেত্রেই পরিবেশ ও প্রাকৃতিক সম্পদের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। জলবায়ু পরিবর্তন, জীববৈচিত্র্যের হ্রাস, পানির অভাব, খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা এবং দূষণের মতো সংকটগুলো আমাদের উন্নয়নের ধারা প্রশ্নবিদ্ধ করছে। এ পরিস্থিতিতে টেকসই উন্নয়ন আর কেবল একটি বিকল্প নয়, এটি এখন বেঁচে থাকার শর্ত। আর টেকসই উন্নয়নের জন্য ব্যক্তি ও সমাজ উভয় পর্যায়েই জীবনধারায় পরিবর্তন বা বিবর্তন অপরিহার্য।প্রথমত, ভোগবাদী মানসিকতা থেকে সরে আসতে হবে। প্রয়োজনের অতিরিক্ত ভোগ না করে ‘স্মার্ট কনজাম্পশন’ বা সচেতন ভোগ নিশ্চিত করতে হবে। খাদ্য, পানি ও শক্তির অপচয় রোধ করা প্রতিটি মানুষের দায়িত্ব। যেমন, খাবারের অবশিষ্টাংশ ফেলে না দিয়ে সঠিকভাবে ব্যবহার, পানি সাশ্রয়ী প্রযুক্তি ব্যবহার, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির অপচয় বন্ধ করা ইত্যাদি অভ্যাস দৈনন্দিন জীবনে গড়ে তুলতে হবে।দ্বিতীয়ত, পরিবেশবান্ধব জীবনধারা গ্রহণ করতে হবে। একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের পরিবর্তে পুনর্ব্যবহারযোগ্য সামগ্রী ব্যবহার, গণপরিবহন বা সাইকেল চালানো, গাছ লাগানো এবং কার্বন নিঃসরণ কমানো এ ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।তৃতীয়ত, সমাজে টেকসই সংস্কৃতি গড়ে তুলতে শিক্ষার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিশু থেকে শুরু করে প্রাপ্তবয়স্ক সবার মাঝে পরিবেশ সচেতনতা ও দায়িত্বশীলতা তৈরি করতে হবে। শিক্ষা ও গণমাধ্যমে টেকসই উন্নয়নের বার্তা ছড়িয়ে দিতে হবে।সবশেষে বলা যায়, টেকসই উন্নয়ন কেবল নীতি-নির্ধারকদের কাজ নয়; বরং প্রতিটি নাগরিকের সচেতনতার ফলাফল। ব্যক্তি জীবন থেকে শুরু করে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় প্রতিটি পর্যায়ে যদি পরিবেশবান্ধব জীবনধারার বিবর্তন ঘটানো যায়, তবে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম একটি নিরাপদ ও সুন্দর পৃথিবী পাবে।

লেখক: সমীরণ বিশ্বাস, কৃষি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ, ঢাকা।

এ বিভাগের আরো খবর