পাট বাংলাদেশের সোনালি আঁশ। বর্তমানে দেশে পাট চাষির সংখ্যা প্রায় ৪০ লাখ। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় চার কোটি মানুষের জীবন-জীবিকার সংস্থান হচ্ছে পাট চাষে। পাট শিল্পে ও পাটপণ্য রপ্তানির কাজে জড়িত আছেন প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার শ্রমিক। জিডিপিতে পাটের অবদান প্রায় শূন্য দশমিক ২০ শতাংশ। কৃষি জিডিপিতে পাটের শরিকানা প্রায় ১ শতাংশ। মোট রপ্তানি আয়ের প্রায় ২ শতাংশ উপার্জন হয় পাট ও পাটপণ্য রপ্তানি থেকে। তৈরি পোশাক শিল্পের পর এটি দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানি খাত। পাট থেকে আহরিত মোট বৈদেশিক মুদ্রার প্রায় এক-চতুর্থাংশ আসে কাঁচা পাট রপ্তানি থেকে। এক সময় পাট ও পাটজাত পণ্যই ছিল বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি খাত। পাট থেকে আহরিত মোট বৈদেশিক মুদ্রার প্রায় এক-চতুর্থাংশ আসে কাঁচা পাট রপ্তানি থেকে। এক সময় পাট ও পাটজাত পণ্যই ছিল বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি খাত। স্বাধীনতার পর ১৯৭২-৭৩ সালে মোট বৈদেশিক আয়ে পাটের অংশ ছিল প্রায় ৯০ শতাংশ। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে তা নেমে এসেছে ১ দশমিক ৮৮ শতাংশে। ১৯৫৮ সালে এ দেশে সাদা পাটের আওতাধীন জমির পরিমাণ ছিল শতকরা ৭৫ দশমিক ৪৮ ভাগ এবং তোষা ২৪ দশমিক ৫২ ভাগ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তোষা পাট শতকরা প্রায় ৮৯ ভাগ, সাদা পাট প্রায় ৪ ভাগ এবং মেস্তা ও কেনাফ প্রায় ৭ ভাগ জমিতে চাষ করা হয়। তোষা পাটের হেক্টরপ্রতি উৎপাদন ১৩ দশমিক ৬৪ বেল, সাদা পাটের উৎপাদন ৯ দশমিক ৭৩ বেল এবং মেস্তা ও কেনাফের গড় উৎপাদন ১০ দশমিক শূন্য ৬ বেল। সারাদেশে হেক্টরপ্রতি পাটের গড় উৎপাদন ১৩ দশমিক ২৪ বেল। নব্বইয়ের দশকে এ দেশে পাটের চাষ হতো প্রায় ১২ লাখ হেক্টর জমিতে। ক্রমেই তা নেমে আসে সাড়ে চার থেকে পাঁচ লাখ হেক্টরে।
মাঠ গবেষণায় দেখা যায় একসময় রংপুর অঞ্চলের অর্থনীতির মূল প্রাণ ছিল পাট। কিন্তু এখন সেই ঐতিহ্য হারাচ্ছে। গত ২০ বছরে পাট চাষ কমেছে প্রায় ৭০%, ফলে হাজার হাজার কৃষক বেকার হয়েছেন। এর প্রধান কারণ বন্যা, ভালো বীজের অভাব এবং বাজারের অনিশ্চয়তা। তবে এবার নতুন পাট বাজারে ওঠায় এবং ভালো দাম পাওয়ায় কৃষক খুশি। রংপুর কৃষি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, এ বছর (খরিফ-১ মৌসুমে) রংপুর বিভাগের আট জেলার (রংপুর, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নীলফামারী) মোট ৫৪ হাজার ৬৬৯ হেক্টর জমিতে পাট চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। প্রত্যাশা ৭ লাখ ৯ হাজার ৭৯৯ বেল পাট উৎপাদন হবে। উল্লেখ্য, গত তিন বছরে এই অঞ্চলে প্রতি বছর গড়ে দুইশ থেকে চারশ হেক্টর জমিতে পাট চাষ কমেছে। ২০২৩ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, রংপুর, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা ও নীলফামারী জেলায় মোট ৫১ হাজার ৬২৭ হেক্টর জমিতে পাট চাষ হয়েছিল। এ উৎপাদনে প্রায় ৭০ হাজার কৃষক যুক্ত ছিলেন। ২০২২ সালে, ৫৬ হাজার ৪১২ হেক্টর জমিতে পাটের চাষ হয়। ওই প্রায় ৭৫ হাজার কৃষক এতে জড়িত ছিলেন। গত ১০ বছরে এই অঞ্চলে পাট চাষের পরিমাণ প্রায় ৪০% কমেছে। আর গত ২০ বছরের হিসাবে এই হ্রাসের পরিমাণ ৭০%।
পাট চাষ কৃষি শ্রমিকদের জন্য কাজের সুযোগ তৈরি করে। কৃষকরা পাট কাটার পর আমন ধানের চারা রোপণ করেন। এরপর প্রায় এক থেকে দেড় মাস তাদের হাতে কোনো কাজ থাকে না। এই সময়ে পাট জাগ দেওয়া ও আঁশ ছাড়ানোর কাজ করে কৃষি শ্রমিকরা কর্মসংস্থান পান।তবে পাট চাষ কমে যাওয়ায় কাজের সুযোগও কমে গেছে। কৃষি শ্রমিকের বাজারও ছোট হয়ে আসছে। তবে আশার কথা, এই বছর নতুন পাট বাজারে উঠতে শুরু করেছে। প্রতি মণ পাট মানভেদে ৩,০০০ থেকে ৩,২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এতে কৃষকরা কিছুটা লাভবান হচ্ছেন। এছাড়াও, প্রতি মণ পাটকাঠি ৭০০ থেকে ১,০০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। পাটকাঠি এখন আর শুধু জ্বালানি নয়, এটি শিল্পের কাঁচামাল হিসেবেও ব্যবহৃত হচ্ছে। পাটকাঠি দিয়ে হার্ডবোর্ড তৈরি হয়। এছাড়াও, বিশেষ প্রক্রিয়ায় পুড়িয়ে কয়লা তৈরি করা হয়, যা গুঁড়ো করে কার্বন ও ডিজিটাল প্রিন্টারের কালি বানানো হয়। পাট চাষ এখন কৃষকদের জন্য একটি লাভজনক ফসল।
লালমনিরহাটের কৃষক মো. আশরাফ দুই একর জমিতে ৪৫ মণ পাট উৎপাদন করে ১ লাখ ৩৫ হাজার টাকা আয় করেছেন। ৭০ মণ পাটকাঠি বিক্রি করে আরও ৪৯ হাজার টাকা আয়ের আশা করছেন তিনি। চাষের সব খরচ বাদ দিয়ে তার ৫০ হাজার টাকা লাভ হবে। কৃষক আব্দুস সাত্তার (৫০) জানান, একসময় উত্তরাঞ্চলের কৃষকদের আয়ের অন্যতম উৎস ছিল পাট। গ্রামীণ অর্থনীতিতে এই ফসলটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখত। কিন্তু আধুনিকতার প্রভাব, চাষের খরচ বৃদ্ধি এবং ন্যায্য মূল্য না পাওয়ায় পাট চাষ এখন বিলুপ্তির পথে। তবে এই সংকট মোকাবিলায় সরকার পাটজাত পণ্যের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করায় বাজারে কিছুটা গতি ফিরেছে। ভবিষ্যতে পাট চাষ বাড়াতে হলে কৃষকদের উচ্চ ফলনশীল জাতের বীজ ব্যবহারে উৎসাহিত করতে হবে এবং পাটের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করতে হবে।
রংপুর পাট গবেষণা ও উন্নয়ন বোর্ডের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বন্যা, বীজের অভাব, পর্যাপ্ত পানির সংকট এবং বাজারের অনিশ্চয়তার কারণেই রংপুর বিভাগে পাট চাষের জমি ও উৎপাদন ধারাবাহিকভাবে কমে আসছে। তবে আশার কথা হলো, চলতি খরিফ মৌসুমে উঁচু জমিতে পাট চাষের পর্যাপ্ত লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। অনাবৃষ্টির কারণে পাট জাগ দেওয়া (পচানো) নিয়ে একসময় কৃষকের মনে ভয় ছিল। কিন্তু আষাঢ় মাসের শেষের দিকে বৃষ্টি হওয়ায় খাল-বিলে পানি জমে যায় এবং শেষ পর্যন্ত পাট পচন নিয়ে বড় ধরনের কোনো সমস্যায় পড়তে হয়নি।
লালমনিরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক, কৃষিবিদ ড. মো. আবু সাইখুল আরিফিন জানান, পাট এখন কৃষকদের জন্য একটি লাভজনক ফসল। কৃষক এই অঞ্চলে দুটি প্রধান ফসলের মাঝে পাট চাষ করতে পারেন। কারণ পাট কাটার পর আমন ধানের চারা রোপণ করা যায় । তিনি জানান, এই অঞ্চলের কৃষকরা এখনও সনাতন পদ্ধতিতে পাট আঁটি করে জাগ দেন। এতে পাটের মান ও রং খারাপ হয়ে যায়, শ্রমিক বেশি লাগে এবং উৎপাদন খরচও বাড়ে। তিনি কৃষকদের সনাতন পদ্ধতির বদলে ‘ফিতা রেটিং’ পদ্ধতিতে পাট জাগ দিতে উৎসাহিত করেন। এই পদ্ধতিতে কম পানি লাগে, প্রযুক্তি ব্যবহার করে সহজে আঁশ ছাড়ানো যায় ও উৎপাদন খরচও কমে।
এখন নীতিনির্ধারণী ও গবেষণা পর্যায়ে অনেক কিছু করার রয়েছে। পাট গবেষণার ক্ষেত্রে এ নাগাদ সাদা পাটের ১২টি উচ্চ ফলনশীল জাত পাওয়া গেছে। তোষা পাটের আটটি, কেনাফের চারটি ও মেস্তার তিনটি উচ্চ ফলনশীল জাত উদ্ভাবন ও অবমুক্ত করা হয়েছে। এগুলোর সম্প্রসারণ চলছে মাঠ পর্যায়ে। বর্তমানে পাটের গড় ফলন পৃথিবীর পাট উৎপাদনকারী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশেই বেশি। এর পেছনে কৃষি বিজ্ঞানীদের এবং বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের অবদান অনস্বীকার্য। সম্প্রতি পাটের বংশ গতি বিন্যাস (জেনোম সিকুয়েন্স) উদ্ভাবন হয়েছে। তাতে রোগ ও পোকা প্রতিরোধক আরো উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবনের সম্ভাবনা উন্মোচিত হয়েছে। হচ্ছে। এখন আমাদের এমন পাটের জাত উদ্ভাবন করতে হবে যা খরা, লবণাক্ততা ও শীতসহিষ্ণু। সারা বছর উৎপাদন উপযোগী পাটজাত উদ্ভাবন এখন সময়ের দাবি। এরই মধ্যে বছরে দুবার অর্থাৎ ফেব্রুয়ারি ও মে মাসে পাট বোনার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। তাতে পাটের উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। তবে গবেষণার মাঠে নতুন উদ্ভাবিত পাট জাতের ফলন যত বেশি, কৃষকের মাঠে তত বেশি নয়। গবেষণা ও কৃষকের মাঠে প্রাপ্ত উৎপাদনে প্রায় ৪০ শতাংশ ফারাক বিদ্যমান। এটি কমাতে হবে। এর জন্য গবেষণা ও সম্প্রসারণের মধ্যে জোরাল সমন্বয় প্রয়োজন। পাট গবেষণা ও সম্প্রসারণে বিনিয়োগ বাড়ানো প্রয়োজন ৷ তার সঙ্গে বাজার স্থিতিশীল রাখতে সচেষ্ট হতে হবে। পাট সংশ্লিষ্ট শিল্পকে আরও সমৃদ্ধ করতে হবে।
লেখক: কৃষি অর্থনীতিবিদ ও গবেষক