বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

নির্বাচনের পেছনে ছায়া: বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক দুর্বিপাক

  • সম্পাদকীয়   
  • ২ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ ২২:৩০

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে প্রতিটি নির্বাচন একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। কখনো তা আশার, কখনো আশঙ্কার। এবারও ব্যতিক্রম নয়। জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে জনমনে প্রশ্নের পর প্রশ্ন। ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে তো? না হলে কবে হবে নির্বাচন? কারা করবেন? কারা অংশ নেবেন না? নির্বাচন কি অবাধ হবে? আলোচনায় এসেছে জাতীয় সরকারের ধারণাও। কেউ আবার প্রস্তাব করছেন আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (চজ) পদ্ধতির নির্বাচন। এসব কিছুর ভেতর দিয়ে উঠে এসেছে বড় এক সংশয়। গণতন্ত্র কি তার নির্ধারিত পথে থাকবে, না কি আবার কোনো ‘ব্যতিক্রমী ব্যবস্থা’র দিকে যাবে রাষ্ট্র? প্রতিটি নির্বাচন হওয়া উচিত একটি গণতান্ত্রিক উৎসব। কিন্তু যখন নির্বাচনই হয়ে যায় জনগণের উদ্বেগ, তখন বোঝা যায় গণতন্ত্র গভীর কোনো ব্যাধিতে আক্রান্ত। এই প্রেক্ষাপটে জাতীয় সরকার, পিআর পদ্ধতি ও আশঙ্কাজনক রাজনৈতিক পরিবেশ নিয়ে নিচের দীর্ঘ পর্যালোচনাটি জরুরি।আলোচনায় আসা পিআর পদ্ধতি জনগণের ন্যায্যতা না নির্বাচনী জটিলতা? আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতি বা চজ বিশ্বের বহু দেশে ব্যবহৃত হয়। জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, ইসরায়েল, নিউজিল্যান্ডসহ বহু দেশে এটি কার্যকরভাবে প্রয়োগ হয়েছে। এতে ভোটের হার অনুযায়ী আসন বণ্টন হয়। ফলে ছোট দলগুলোও পার্লামেন্টে প্রবেশ করতে পারে এবং রাজনৈতিক বৈচিত্র্য ও প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হয়। এই পদ্ধতির বড় সুবিধা হচ্ছে-এটি অধিকতর ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করে এবং একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠীর মতামত উপেক্ষিত হয় না। কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতায় এটি প্রয়োগ করা কতটা বাস্তবসম্মত? এ নিয়েও প্রশ্ন আছে। পর্যালোচনার প্রয়োজন আছে। বাংলাদেশের ভোটার মনস্তত্ত্ব, রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও সংগঠনভিত্তিক দলীয় রাজনীতির কারণে চজ পদ্ধতি এক প্রকার দূরহ হয়ে পড়ে। একে বাস্তবায়নের জন্য সাংবিধানিক সংশোধন প্রয়োজন, যার জন্য সংসদীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা দরকার, যা বর্তমান কাঠামোতে কঠিন। সেইসঙ্গে ভোটারদের এই পদ্ধতি সম্পর্কে পর্যাপ্ত ধারণাও নেই। তাছাড়া রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও এ বিষয়ে ঐকমত্য নেই। বড় দলগুলো এতে আগ্রহী নয়, কারণ এতে তাদের একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। অতএব, চজ পদ্ধতি বর্তমানে একাডেমিক আলোচনা পর্যন্তই সীমাবদ্ধ এবং রাজনৈতিক বাস্তবতায় তা প্রয়োগে এখনো অনেক দূর যেতে হবে। তবে বাংলাদেশে এ পদ্ধতিতে নির্বাচন করা গেলে একক দলের ক্ষমতা কমবে। তাতে দুর্নীতি, বলপ্রয়োগ, অপরাধ প্রবণতা কমে আসবে।জাতীয় সরকারের প্রস্তাব সমঝোতার ডাক, না রাজনৈতিক হিসাবনিকাশ? জাতীয় সরকার গঠনের দাবি নতুন কিছু নয়। অতীতেও এমন প্রস্তাব এসেছে রাজনৈতিক সংকট উত্তরণের বিকল্প হিসেবে। যারা এটি চাইছেন, তারা বলছেন, জাতীয় সরকারই একমাত্র গ্রহণযোগ্য রূপরেখা যা নির্বাচনের আগে একটি নিরপেক্ষ পরিবেশ তৈরি করতে পারে। বিশেষ করে যেখানে রাজনৈতিক বিভাজন তীব্র এবং পারস্পরিক অবিশ্বাস ব্যাপক, সেখানে জাতীয় সরকারের মতো একটি অন্তর্বর্তী ব্যবস্থা জরুরি বলে মনে করেন অনেকে। তবে প্রশ্ন জাগে-এই সরকার কাদের নিয়ে গঠিত হবে? কী হবে ক্ষমতার কাঠামো? কতদিন চলবে? এর সাংবিধানিক ভিত্তি কী? জাতীয় সরকারের আইনি কাঠামো কোথায়, তার ম্যান্ডেট কী, নির্বাচন কমিশনের উপর এর কর্তৃত্ব কতটা থাকবে—এসব প্রশ্নের কোনো স্বচ্ছ জবাব নেই। সমালোচকদের মতে, জাতীয় সরকারের ধারণাটি অনেকটাই অস্পষ্ট। একপক্ষের কাছে এটি ‘নিরপেক্ষতার নামান্তর’, আরেকপক্ষের কাছে ‘ক্ষমতা হস্তান্তরের পাঁয়তারা’। আর যেহেতু সংবিধানে জাতীয় সরকারের কোনো ধারা নেই, তাই এই ধারণার বাস্তবায়ন সাংবিধানিক টানাপোড়েন তৈরি করতে পারে। অতএব, এটি সমঝোতার মাধ্যমে প্রস্তাবিত হলে আলোচনাযোগ্য, অন্যথায় এটি রাজনৈতিক কৌশল ছাড়া আর কিছু নয়।একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন হলো সুষ্ঠু নির্বাচনের পূর্বশর্ত। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে ব্যাপক প্রশ্ন উঠেছে। ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনকে ঘিরে কমিশনের ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক ছড়ায়। বিশেষ করে ২০১৮ ও ২০২৪ সালের রাতে ভোট দেওয়ার অভিযোগ কমিশনের বিশ্বাসযোগ্যতাকে ব্যাপকভাবে ক্ষুণ্ণ করেছে। বর্তমান কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর কিছু প্রশংসনীয় উদ্যোগ নিলেও রাজনৈতিক পক্ষগুলোর আস্থা আদায়ে ব্যর্থ হয়েছে। ঊঠগ ব্যবহারের প্রসঙ্গে একপক্ষের আপত্তি, পর্যবেক্ষকদের সীমিত অনুমতি এবং রাজনৈতিক সংঘর্ষে কমিশনের নীরবতা জনমনে আরও অনাস্থা জন্ম দিয়েছে। আস্থা অর্জনের একমাত্র পথ হলো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ, স্বচ্ছতা বজায় রাখা এবং সব পক্ষকে সমানভাবে সুযোগ দেওয়া। তা না হলে কমিশন যতই প্রচার চালাক, ততই তা প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে উঠবে।অনেকেই মনে করেন, দেশে যদি নির্বাচন সুষ্ঠু না হয়, তাহলে সেনাবাহিনী একটি নিরপেক্ষ রক্ষক হিসেবে কাজ করতে পারে। যদিও এ কথা বললে গণতন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে, কিন্তু বাস্তবতা হলো জনগণের বিশ্বাস অর্জন করার জন্য সেনা হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা কিছুটা প্রবল। অন্যদিকে, সেনা শাসন চিরকালীন নয়, এ ধরনের পরিস্থিতি গণতন্ত্রের পক্ষে একটি প্রতিকূল সংকেত। সেনা হস্তক্ষেপ সাময়িক স্বস্তি দিতে পারে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে তা দেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি আস্থা কমিয়ে দেয়।বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বর্তমানে ব্যাপক চ্যালেঞ্জের মুখে। বড় দলগুলো অথবা একাধিক রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম একাধিকবার একে অপরকে খারাপ হিসেবে অভিহিত করেছে। ফলে একটি কার্যকরী রাজনৈতিক সমঝোতা তৈরি করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখানে বিভাজনের প্রভাব এতটাই গাঢ় যে, জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার আগেই বিভিন্ন পক্ষ তাদের মতামত জোরালভাবে তুলে ধরছে। এ ধরনের আস্থা সংকট রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা তৈরি করতে পারে এবং এতে নির্বাচনী প্রস্তুতি বিলম্বিত হতে পারে। শুধু রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোই নয়, নাগরিক সমাজও এর অংশ হতে পারে। প্রত্যাশিত নির্বাচন নিয়ে গুজবের বাজার কিছুটা তোলপাড় হয়ে উঠেছে। কেউ বলছেন, নির্বাচন এক বছরের জন্য স্থগিত হতে পারে, আবার কেউ বলছেন, জাতীয় সরকার গঠন হওয়ার পর নির্বাচন এগিয়ে আসবে। এসব গুজব পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলছে, যা ভোটারদের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে। রাজনৈতিক দলগুলোর নিজেদের অবস্থান নির্ধারণ না করার কারণে এইসব গুজবের প্রতি জনগণের বিশ্বাস স্থাপন করা বাড়িয়ে দিয়েছে।গণতন্ত্রে ভোট একটি মৌলিক অধিকার, জনগণের মতামত জানানোর একমাত্র কার্যকর প্রক্রিয়া। কিন্তু যখন নির্বাচন গোপন এজেন্ডা, পূর্বনির্ধারিত ফলাফল কিংবা ক্ষমতাকেন্দ্রিক তদবিরের যন্ত্রে পরিণত হয়, তখন তা জনগণের অধিকারকে ছিনিয়ে নেয়। যা কিনা বিগত হাসিনা সরকারের সময় হয়েছে। আমাদের দেশে বহুবার দেখা গেছে ভোট হয়েছে, কিন্তু ভোটাররা বলতে পারছে না তাদের ভোট আসলে গণনা হয়েছে কি না। অনেক ভোটার ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিতে না পারার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন। আবার প্রশাসনিক প্রভাব, রাজনৈতিক প্রভাব কিংবা নির্বাচনী প্রক্রিয়ার অস্পষ্টতা পুরো নির্বাচনকে সন্দেহজনক করে তোলে। এভাবে যখন নির্বাচনকে স্বচ্ছ রাখা হয় না, তখন জনগণের আস্থা ভেঙে পড়ে। মানুষ প্রশ্ন তোলে আমরা কি সত্যিই ভোট দিচ্ছি, নাকি একটি নাটকের অংশগ্রহণ করছি? গণতন্ত্র তখন কাগজে-কলমে থেকে যায়, কিন্তু বাস্তবে তা জনজীবনে প্রতিফলিত হয় না। নির্বাচনের মূল প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায় ‘আমার ভোট কি গণনা হয়েছে?’। এই প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারলে গণতন্ত্রের অধিকার কেবলই একটি প্রতিশ্রুতি হয়ে থাকে, বাস্তবে তার কোনো কার্যকারিতা থাকে না। ফলত গোপন বা পূর্বনির্ধারিত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যে গণতন্ত্র গড়ে ওঠে, তা আসলে ফাঁপা এক কাঠামো যা জনগণের অধিকারকে নিঃশেষ করে দেয়। তবে অন্তর্বর্তীকালীন ইউনূস সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার দাবি রাখে আমজনতা।বাংলাদেশ আজ নিঃসন্দেহে এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অস্থিরতা, মারামারি রক্তপাত, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে অসহযোগিতা সব কিছু ওলটপালট করে দিচ্ছে। সব কিছুতে সন্দেহ তৈরি হয়েছে। গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য জাতীয় সরকার, আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব কিংবা সংবিধান সংশোধনের মতো বিভিন্ন প্রস্তাব আলোচনায় এসেছে। কিন্তু এগুলোর কোনোটি কার্যকর হবে না যদি জনগণের আস্থা অর্জন না করা যায়। গণতন্ত্র কেবল একটি কাঠামোগত ব্যবস্থা নয়; এর প্রাণশক্তি হলো জনগণের সম্মতি এবং রাজনৈতিক দলগুলোর আন্তরিকতা। আজকের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব হলো সেই সম্মতি ও আন্তরিকতাকে দৃঢ় করা।এ কথা বলতেই হয়, বাংলাদেশে আজ সংকটজনক ভোটের দ্বারপ্রান্তে। জাতীয় সরকার হোক বা পিআর পদ্ধতি, সবই তখনই অর্থবহ, যদি তার পেছনে থাকে জনগণের ইচ্ছা ও সর্বদলীয় সম্মতি। নচেৎ এগুলো কেবল স্লোগান বা ছলচাতুরি হয়ে থাকবে। ভোট কেবল ভোট না এটা হলো দেশের ভবিষ্যতের দিশা নির্ধারণ। তাই গণতন্ত্রের মর্যাদা রক্ষায় সবাইকে সংযমী, সংলাপমুখী এবং সর্বোপরি জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ হতে হবে। নইলে সামনে যে অন্ধকার, তা শুধু রাজনীতির জন্য নয় গোটা জাতির জন্যই হুমকিস্বরূপ। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, সকল রাজনৈতিক শক্তিকে বুঝতে হবে, একমাত্র লক্ষ্য হতে হবে একটি স্থিতিশীল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। সমঝোতা, সহমর্মিতা এবং ক্ষমতা ভাগাভাগির সংস্কৃতি ছাড়া এ পথ সম্ভব নয়। অন্যথায় ভবিষ্যৎ ইতিহাস হয়তো কঠিন ভাষায় লিখবে-এই জাতি জুলাই আন্দোলনের সুবাদে সুযোগ পেয়েছিল, কিন্তু তারা তা ধরে রাখতে পারেনি। ভোট তখন আর গণতন্ত্র রক্ষার হাতিয়ার হবে না, বরং ক্ষমতা কুক্ষিগত রাখার অস্ত্র হয়ে দাঁড়াবে। আর সেই ব্যর্থতা থেকে যে অরাজকতা ও অনিশ্চয়তা জন্ম নেবে, তার দায় পুরো জাতিকেই বহন করতে হবে। এর দায় আন্তর্বর্তীকালীন সরকারকেও নিতে হবে বৈকি!

লেখক: সাংবাদিক, সমাজ গবেষক, মহাসচিব-কলামিস্ট ফোরাম অব বাংলাদেশ।

এ বিভাগের আরো খবর