২০২১ সালের সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন তানজানিয়ার কথাসাহিত্যিক আবদুরাজাক গুরনাহ। তার জন্ম ১৯৪৮ সালে। বর্তমানে তিনি বসবাস করছেন ব্রিটেনে। আবদুরাজাক গুরনাহ তার লেখায় ‘উপনিবেশবাদের প্রভাব এবং সাংস্কৃতিক ও মহাদেশীয় বিচ্ছিন্নতায় শরণার্থীদের ভাগ্যের আপসহীন এবং করুণামিশ্রিত উপস্থাপনার জন্য’ এবারের সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন।
আবদুরাজাক গুরনাহর কথাসাহিত্যের কেন্দ্রে থাকে স্মৃতি; স্মৃতির সঙ্গে বিশেষভাবে জড়িয়ে থাকে তার মাতৃভূমি জানজিবারের মানুষের ইতিহাসের পুনরায় জীবন দানের স্পৃহা। তিনি ইতিহাসের প্রচলিত বয়ানকে ভেঙেচুড়ে নতুন রূপে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেন। এ ক্ষেত্রে স্মৃতি তার কাছে হাতিয়ারের মতো। তিনি ব্যক্তির দৃষ্টিভঙ্গি এবং সমষ্টির দৃষ্টিভঙ্গির মাঝে ইতিহাসের টানাপোড়েনটা ধরার চেষ্টা করেন তার কথাসাহিত্যে।
লেখার কাজে যথেষ্ট সহায়ক হয়েছে তার ব্রিটেনে নিজের অভিবাসনের অভিজ্ঞতা। নিজের অভিজ্ঞতার নির্যাসটাই তিনি চরিত্রদের ভেতর ঢুকিয়ে দেন। তার চরিত্ররা বিচ্ছিন্নতাবোধের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ। ‘পিলগ্রিমস ওয়ে’ উপন্যাসের দাউদ, ‘ডোটি’ উপন্যাসের প্রধান চরিত্র ডোটি এবং ‘অ্যাডমায়ারিং সাইলেন্স’-এর কথকের মতো আরও অনেক চরিত্র আছে এমন অভিজ্ঞতার উদাহরণ হিসেবে। এমনকি বর্ণবাদের পর্দাও তাদের সামনে প্রায়ই দেয়ালের মতো জেগে ওঠে।
গুরনাহ নিষ্ঠুরতা, প্রতারণা, হতাশা এবং ব্যর্থ আশার কথা বলে যান কিছুটা চাপা গদ্যে। কাহিনি বলার মাধ্যমে পূর্ব আফ্রিকার ইতিহাসের পর্দায় আরও রঙিন সুতা জুড়ে দেন গুরনাহ। কাহিনির ভেতর দিয়েই তিনি স্মৃতির ক্ষমতার প্রমাণ রাখেন। বিশেষ করে মানুষের পরিচয় প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে স্মৃতি কতটা জোরালো ভূমিকা রাখতে পারে তার উদাহরণ দিয়ে যান অনেকটা না খোলা নিম্নস্বরের ভাষ্যে, সঙ্গে থাকে হালকা রস, করুণা এবং সহানুভূতির যোগ।
পশ্চিমা ইহবাদী পরিসরে তিনি মুসলিম পরিচয়ের কল্পনা সাজান, তবে পাশে থাকে এক জাতি থেকে আরেক জাতির অভিজ্ঞতায় পাওয়া করুণা, উদারতা ইত্যাদির মতো মানবিক মূল্যবোধ। পরিবর্তনশীল বহুসংস্কৃতির পরিসরে নারী এবং পুরুষের লক্ষণীয় নিজস্ব বিবর্তনের চিত্রও তুলে ধরেন গুরনাহ। তার মুসলিম পুরুষদের দৃষ্টির সামনে থাকে নতুনতর পৌরুষ অর্জনের লক্ষ্য। নারীরা অর্জন করতে চায় নিজেদের মতো নতুন এবং সামষ্টিক পরিসর।
‘মেমরি অব ডিপারচার’, ‘পিলগ্রিমস ওয়ে’ এবং ‘ডোটি’ তার প্রথম তিন উপন্যাস। এ উপন্যাসগুলোতে তিনি সাম্প্রতিককালে ব্রিটেনে অভিবাসনের অভিজ্ঞতার কথা বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে তুলে ধরেছেন। ‘পিলগ্রিমস ওয়ে’ উপন্যাসের চরিত্র দাউদ একজন হাসপাতালের আর্দালি। ১৯৭০-এর দশকের যাপিত জীবনে সে ব্রিটেনের সমাজের এক প্রান্তে পড়ে আছে দেখা যায়। তার জীবনের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো বিষণ্নতা।
তার চরিত্রের মধ্যে জাতিগত পরিচয় এবং স্থানচ্যুতির বিশ্লেষণ দেখানো হয়েছে। সে আসলে বিকল্প ঔপনিবেশিক অতীতের মুখোমুখিও হয়। সে বাস্তব এবং কল্পিত মানুষের কাছে কাল্পনিক পত্র লিখে চলে। দাউদের বিষণ্নতার পেছনে রয়েছে পূর্ব আফ্রিকায় ঔপনিবেশিকতার কারণে সৃষ্ট দীর্ঘস্থায়ী মানসিক ও ঐতিহাসিক ক্ষত। পরিবার এবং সম্প্রদায় হারানো এবং জাতপাত বিচারের মতো ব্রিটিশ সমাজে বসবাস করতে আসা- এগুলোও তার বিষণ্নতার পেছনে কাজ করে।
স্থানচ্যুত আাফ্রিকানদের ইউরোপে স্থান করে নেয়ার যে চেষ্টা সেটা তিনি নিজের অভিজ্ঞতায় দেখেছেন এবং উপন্যাসে সে বিষয়টিই তুলে ধরেছেন। অবশ্য তার উপন্যাস ‘ডোটি’র চরিত্র ডোটি অন্যান্য উপন্যাসের প্রধান চরিত্রদের থেকে একটু আলাদা। জন্মগতভাবে সে একজন ইংরেজ নারী। একদিকে সে ইংরেজ, তার আরেকটি অনন্য দিক হলো সে নারী। তার চরিত্রের মধ্যে পার্থক্যের বিষয়টি হলো, সে উনিশ শতকের নারীদের মতো লিঙ্গবাদের বেড়াজালে বন্দি নয়।
সে দেখতে পায়, অশ্বেতাঙ্গ নারীর জন্য ইংরেজ হওয়ার বিষয়টি তেমন গুরুত্বের নয়। ব্রিটিশ জ্ঞান এবং ইংরেজি টেক্সের পাশাপাশি নতুন টেক্সট তৈরির চেষ্টা চালান অশ্বেতাঙ্গ লেখকরা; তাদেরই একজন হয়ে গুরনাহ প্রচলিত ব্রিটিশ টেক্সটের বিকল্প টেক্সট দাঁড় করার। ডোটি এবং তার ভাইবোনদের চরিত্রের উপস্থাপনায় সেটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে এ উপন্যাসে।
গুরনাহর চতুর্থ উপন্যাস ‘প্যারাডাইস’। বুকার এবং হুইটব্রেড উভয় পুরস্কারের মনোনয়ন পায় তার এ উপন্যাসটি। প্যারাডাইস একটি ঐতিহাসিক উপন্যাস। এ উপন্যাসটির পটভূমি হিসেবে ব্যবহার করেছেন প্রথম মহাযুদ্ধকালের পূর্ব-আফ্রিকা। প্যারাডাইস উপন্যাসের শেষের দিকে দেখা যায়, জার্মানরা সংগ্রহ করে নিয়োগ দিয়েছে পূর্ব-আফ্রিকার স্থানীয় সৈন্যদের; তাদের একটা দল পূর্ব-আফ্রিকার উপকূলের এক শহরে প্রবেশ করে আরও সৈন্য সংগ্রহের উদ্দেশে। কারণ বিট্রিশদের সঙ্গে আসন্ন যুদ্ধে তাদের লড়তে হবে।
উপন্যাসের প্রধান চরিত্র ইউসুফ এবং তার বন্ধু খলিল দেখতে পায়, একজন জার্মান অফিসার বেশ কিছু স্থানীয় যুবককে সংগ্রহ করে নিয়ে আসছে। কিছুক্ষণ পর সংগ্রহ করে আনা যুবকদের দুই সারিতে সাজিয়ে মার্চ করে চলে যায় তারা। ইউসুফ যখন দেখতে পায়, সৈনিকদের সারি দৃষ্টির আড়ালে চলে যাচ্ছে সে দৌড়ে তাদের সঙ্গে যোগ দেয়। নিজের ইচ্ছেয় ইউসুফ জার্মান বাহিনীতে যোগ দিচ্ছে। এর পেছনে নিশ্চয় কারণ আছে। তৎকালীন পূর্ব-আফ্রিকার সমাজের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক স্তরবিন্যাসের বিশেষ ভূমিকা ছিল উপনিবেশকালের এরকম পরিস্থিতিতে।
উপন্যাসের অন্যান্য ঘটনায় যেমন চিত্র দেখা গেছে, জার্মান উপনিবেশ এসে ভাঙন তৈরি করেছে সেখানে। ইউসুফের মতো একজন যুবকের স্বেচ্ছায় জর্মান বাহিনীতে যোগদান তারই একটা উদাহরণ। আফ্রিকার সাহিত্যের সমালোচক জে ইউ জ্যাকবস মন্তব্য করেন, গুরনাহর এ উপন্যাসটি যোসেফ কনরাডের ‘হার্ট অব ডার্কনেস’ উপন্যাসের কথা মনে করিয়ে দেয়। জ্যাকবস মনে করেন, এ উপন্যাসের চরিত্র আজিজের কঙ্গো-যাত্রার মাধ্যমে ওই এলাকা সম্পর্কে বিশ শতকের গোড়ার দিকে প্রচলিত পশ্চিমা দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন গুরনাহ।
ইংরেজ কথাসাহিত্যিক আনিতা ম্যাসন বলেন, এ উপন্যাসের অর্থের অনেক স্তর রয়েছে। একদিকে শৈল্পিক সৌন্দর্যে ভরা, অন্যদিকে নতুনত্বের বৈশিষ্ট্যেও উত্তুঙ্গ এ উপন্যাস।
২০০৫ সালে প্রকাশ করেন তার সপ্তম উপন্যাস ‘ডিজার্শন’। এ উপন্যাসটির মাধ্যমে গুরনাহ ইতিহাসকে উপন্যাসের অবয়বে এনেছেন কথাসাহিত্যের উপভোগ্য মুন্সিয়ানায়। এখানে আপাত প্রথম পুরুষের অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে সর্বজনীন অভিজ্ঞতা ধরার চেষ্টা করেছেন তিনি। এখানে বিশেষ চরিত্র ফরিদা, আমিন, জামিলাসহ আরও কতিপয় মানুষের ব্যক্তিগত আনাগোনার মধ্যেই চিরন্তন মানুষ ও সময়ের কথা বলা হয়েছে। একই কাহিনির মধ্যে অনেকের কথা থাকতে পারে। কাহিনি কিছু মানুষের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়েও সবার জীবনের অংশ হয়ে উঠতে পারে। সীমাবদ্ধ একটি সময়ের পরিচয়ের মধ্যেই লুকিয়ে থাকতে পারে দীর্ঘ পরিসরের কাল- এমন সত্যের উদাহরণ লিখেছেন গুরনাহ তার এ উপন্যাসটি।
আফ্রিকায় জার্মান উপনিবেশ সম্পর্কে ইথিয়পিয়ার আমেরিকাবাসী লেখক মাজা মাঙ্গিস্তে বলেন, আফ্রিকায় ইউরোপীয় উপনিবেশ সম্পর্কিত আলোচনায় আগে জার্মানির কথা তেমন উচ্চারিত হয়নি, সম্প্রতি হয়েছে। জার্মানি আফ্রিকায় উপনিবেশ স্থাপন করে উনিশ শতকের শেষের দিকে। বিশ শতকের গণহত্যার সূচনায় ছিল জার্মানদের বর্বরতা: ১৯০৪ সালে নামিবিয়ায় হেরেরো এবং নামা বিদ্রোহ দমনের নামে এই বর্বতার উদাহরণ দেয় জার্মানি।
গুরনাহর ‘আফটারলাইভস’ উপন্যাসের পটভূমি হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে ওই সময়ের নৃশংসতা। উপনিবেশের শক্তির কাছে পুতুলের মতো ব্যবহৃত হওয়া মানুষদের প্রতিনিধি হিসেবে দেখা যায় ইলিয়াস, হামজা আফিয়া এবং আরও অনেককে। নতুন শতকের শুরুতে ইউরোপের শক্তিগুলো আফ্রিকাকে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিতেই বিভিন্ন চুক্তিও তৈরি করে।
উপনিবেশের শিকার যারা তারা আন্দোলন করবে- স্বাভাবিক। ইউরোপীয়রা কঠোর এবং নিষ্ঠুরভাবে দম করে সে আন্দোলনগুলো। এক সময় এ উপন্যাসের চরিত্ররা তাদের আগের জায়গায় ফিরে আসে। কিন্তু স্বস্তি আসে না। কারণ নতুন যুদ্ধের কালো ছায়া বাড়তে থাকে। তাদের ভবিষ্যৎ তছনছ করে দিতে পারে সে যুদ্ধ।
কোনো স্থানেরও প্রাণের যোগ থাকে মানুষের ইতিহাসের সঙ্গে, মানুষের স্মৃতিজাগানিয়া আবেগের সঙ্গে, এমনটাই মনে করেন গুরনাহ। তার মতে, কোনো জায়গা শুধু ভৌগোলিক অবস্থানে স্থবির হয়ে পড়ে থাকে না। বরং সেখানকার মানুষের সঙ্গে তাদের পরিবর্তিত স্থানেও চলে যেতে পারে। অর্থাৎ অতীতের স্মৃতির সঙ্গে মিশে মানুষের মনের ভেতর জেগে থাকে তার অতীতের প্রিয় জায়গাটি।
গুরনাহর উপন্যাস ‘দ্য লাস্ট গিফট’-এর প্রধান চরিত্র আব্বাসের ব্যর্থতার চিত্র দেখানোর সময় তার অতীতের কথা ফিরে আসে বর্তমানের সমান্তরালে। সামাজিক রাজনৈতিক পরিবেশে নিজেকে খাপ খাওয়াতে চেষ্টা করার একপর্যায়ে ষাট বছর বয়সী আব্বাস অসুস্থ হয়ে পড়ে। পেছনের দিকের ছবিগুলো যখন সামনে আসতে থাকে পাঠক দেখতে পান, আব্বাস এক সময় ছিল পূর্ব-আফ্রিকার ভারত মহাসাগরীয় উপকূলীয় এলাকায়। তার শারীরিক অবস্থার অবনতির সঙ্গে সমান্তরালে চলে আসে তার অতীতের সংকুচিত অবস্থা: পূর্ব আফ্রিকার ব্যাপক পরিসর থেকে সংকুচিত হয়ে ক্ষুদ্র জাঞ্জিবারে ছোট হয়ে আসে তার অতীত।
আবদুরাজাক গুরনাহর কথাসাহিত্যের জগৎ তৈরি হয় স্মৃতি, ইতিহাস, অভিবাসনের কারণ, অভিবাসনের অভিজ্ঞতা, শিকড়হীন মানুষের দুর্দশা- এসবের সমষ্টিতে। খুব নিষ্ঠুর ইতিহাস থেকে তুলে আনেন তার চরিত্রদের। কথাসাহিত্যেও চমৎকারিত্বে তার চরিত্ররা হয়ে ওঠে প্রাণবন্ত ও আবেদনময়।
ফুটনোট: ইউটিউবে লেখক ও নোবেল ঘোষকের মুখেও শোনা গেল তার নাম আবদুরাজাক গুরনাহ। তার নামের বানানে ল অক্ষরের উচ্চারণ নেই। লেখক
লেখক: প্রবন্ধকার, অনুবাদক ও শিক্ষক।