রাষ্ট্র ও সমাজ ক্রমেই বিকশিত হচ্ছে। সমাজের বহুমাত্রিক বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে ‘গণমাধ্যম’ ধারণাটিরও পরিবর্তন হচ্ছে। শত বছর আগের গণমাধ্যমের ধারণা ও আজকের গণমাধ্যমের ধারণার সঙ্গে অনেক ফারাক। এমনকি দুই দশক আগের গণমাধ্যমের সঙ্গেও সাম্প্রতিক গণমাধ্যমের তুলনা চলে না।
এখন নয়া জমানা। এ জমানায় অনেক কিছুই আর আগের মতো নেই। এখানে মানুষের সঙ্গে মানুষের, রাষ্ট্র ও সমাজের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কে পরিবর্তন এসেছে। সব কিছুই চেনা চেনা লাগে, তবু অচেনা। রাষ্ট্র একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। গণমাধ্যমও একটি প্রতিষ্ঠান। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্র ও গণমাধ্যমের সম্পর্কের মাঝেও পরিবর্তন এসেছে। অতীতে একটি রাষ্ট্র গণমাধ্যমকে বন্ধু মনে না করলেও শত্রু মনে করত না। তারা একে অপরের সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করেছে।
রাষ্ট্রকে নিছক একটি রাজনৈতিক ধারণা থেকে আজকের স্বাধীন-সার্বভৌম ও আধুনিক রাষ্ট্রে রূপান্তরের যে ভ্রমণগাথা গণমাধ্যম সেখানে বাতিঘরের মতো কাজ করেছে। পথ দেখিয়েছে, সতর্ক করেছে। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে রাষ্ট্র ও গণমাধ্যমের সেই সম্পর্কও অনেকটাই বদলে গেছে। বিশ্বজুড়েই আজ মুক্ত গণমাধ্যমের অন্যতম চ্যালেঞ্জটির নামও ‘রাষ্ট্র বনাম গণমাধ্যম’।
গণমাধ্যমের মূল চ্যালেঞ্জ রাষ্ট্র নয়। যদি চ্যালেঞ্জ হতো তবে কোনো রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যেই গণমাধ্যম দাঁড়াতে পারত না। বাংলাদেশে আজ গণমাধ্যমের শুধু বিকাশই হয়নি, বিস্ফোরণ ঘটেছে। তাই গণমাধ্যমের মূল চ্যালেঞ্জ আজকের বিশ্ব বাস্তবতা যার নাম ডিজিটাল বাস্তবতা। ডিজিটাল বিশ্বে সব গণমাধ্যমই একই দৌড়ে শামিল এবং সে দৌড় শুরুও হয় সময়ের একই রেখায়। কে কার আগে সংবাদকে গ্রাহক বা পাঠকের কাছে কতটা চটকদার করে উপস্থাপন করতে পারে সেই দৌড় শুরু হয় ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গেই। সময় এখন আগের চেয়ে দ্রুত বহমান। আগে একটি ঘটনা ঘটার পরের দিন গ্রাহকের কাছে পাঠানোই ছিল বড় কৃতিত্ব, দুই-তিন দিন বা সপ্তাহ খানেক না হলেই হলো।
সাংবাদিকের হাত ধরে পত্রিকামারফত একটি সংবাদ মানুষের কাছে পৌঁছাত। সাংবাদিক ছাড়া সংবাদ চলতে-ফিরতে পারত না। সংবাদ ছিল স্থবির একটি ঘটনামাত্র। কিন্তু ডিজিটাল বিশ্বে সবাই আজ সাংবাদিক। ডিজিটাল যুগে নাগরিকের হ্যান্ডহেলের মাধ্যমে মুহূর্তেই একটি সংবাদ পৌঁছে যায় টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া। সিটিজেন জার্নালিজমের যুগে সংবাদ ঢাকায় আসার জন্য সাংবাদিকের অপেক্ষায় থাকে না।
ডিজিটাল ডিভাইস ও বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে সবাই আজ সক্রিয় সাংবাদিক। সংবাদ পেতে পাঠককে আজ আর হকারের জন্য সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয় না। ঘটনা ঘটার পর কোনো অনলাইনের কত মিনিট আগে কোন অনলাইন পাঠককে জানাতে পারল সেটাই বড় কথা। ডিজিটাল বাস্তবতা মানে এখন ঘটনা এখনই প্রচার-প্রসার, লাইভ-লাইক-কমেন্ট-রিঅ্যাক্ট-ভাইরাল-ইত্যাদি ইত্যাদি।
আমাদের দেশে এই ডিজিটাল প্রতিযোগিতার সূচনা হয় দুই দশক আগে। ২০০০ সালের গোড়ার দিকেই দেশে আজকের যে প্রচলিত অনলাইন পোর্টাল তার সূচনা হয়। তবে এদেশে গণমাধ্যমের অনলাইনে উত্তরণের কাজটি কিন্তু করেছিল কাগজের ওই পত্রিকাগুলোই। তারাই প্রথমে নিজেদের অনলাইন ভার্সন চালু করেছে। এরপর দেশে শুরু হয় পুরোপুরি অনলাইন-ভিত্তিক মিডিয়া যাকে আমরা বলি অনলাইন গণমাধ্যম।
পাশাপাশি কাগজের ওই পত্রিকাগুলোও তাদের অনলাইন ভার্সন চালু করে। কাগজের পত্রিকাগুলোর গ্রাহক থাকুক বা না থাকুক সবারই একটি অনলাইন ভার্সন আছে। গণমাধ্যমের আত্মপরিচয়ের জায়গার নামই তাদের অনলাইন ঠিকানা। ডিজিটাল প্লাটফর্মেই সবাই সবার অস্তিত্বের জানান দেয়। বিস্তীর্ণ সাইবার স্পেসে নিজের একখণ্ড জমিই (ডোমেইন) যেন সব গণমাধ্যমের মাথাগোঁজার ঠাঁই।
এক সময় গণমাধ্যমকে পৌরবিজ্ঞানীরা আদর করে বলতেন ফোর্থ স্টেট বা রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। এখনও আমরা বলছি। কিন্তু আজকের বৈশ্বিক রাজনৈতিক বাস্তবতায় গণমাধ্যমের আয়নায় রাষ্ট্র তার চেহারা দেখতে চায় কি না সেটা সব দেশের প্রেক্ষাপটেই একটি বড় প্রশ্ন। এমনকি গণমাধ্যমের দর্পণে সেই ‘গণ’ নিজেদেরও দেখতে পায় কি না সে প্রশ্নও অবান্তর নয় কোনো কোনো প্রেক্ষাপটে। এসব প্রশ্ন ওঠার পেছনে বহু কারণ থাকলেও মূল কারণ হয়তো ‘সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট’। টিকতে হলে এখানে অনেক কিছুর সঙ্গে ফিট করতে হবে, হিটও বাড়াতে হবে।
ডিজিটাল মাধ্যম গণমাধ্যমের জন্ম যেমন সহজ করে দিয়েছে, ঠিক একইভাবে কঠিন করে দিয়েছে তার সারভাইভাল। এখানে প্রসব বেদনা ছাড়াই জন্মের সুখ অনুভব করা যায় সত্য, কিন্তু তার বেঁচে থাকার লড়াইটা আগের চেয়ে আরও কঠিন। তদুপরি মান-ইজ্জত ও চরিত্র নিয়ে (মানোত্তীর্ণ হয়ে) বেঁচে থাকা আরও কঠিন।
এরকম একটি পরিস্থতিতে যা প্রথমেই প্রশ্নবিদ্ধ হয় তা হচ্ছে- বিশ্বাস ও আস্থা। সোজা কথায় গণমাধ্যম তার নিজস্ব সারভাইভালের জন্য অনেক সময়ই রাষ্ট্রের আস্থা ও জনগণের বিশ্বাস দুই-ই হারায়। একজনের কাছে আস্থাভাজন হতে গেলে আরেকজনের বিশ্বাস হারাতে হয়। এক কথায় এটাই অনলাইন গণমাধ্যমের সাম্প্রতিক লড়াইয়ের ইতিবৃত্ত এবং এ লড়াইয়ে সে একেবারেই একা, কিন্তু প্রতিদ্বন্দ্বী অনেক।
দেশে আজ অসংখ্য অনলাইন গণমাধ্যম রয়েছে। এর মধ্যে ‘এই আছি এই নেই’ মার্কা নিউজপোর্টালও কম নয়। কে কার আগে নিউজ ব্রেক করবে সে প্রতিযোগিতাতো রয়েছেই। কয়েক হাজার টাকায় ওয়েব সাইট কিনে কাট-কপি-পেস্টের দক্ষতা কাজে লাগিয়ে অতিদ্রুতই পাঠকসমাজে ঝড় তোলা যায়।
এ রকম ঝড় তোলা অনলাইন সংবাদমাধ্যমের ঘূর্ণিঝড়ে পেশাদার গণমাধ্যমগুলো আজ বিপর্যস্ত। ডিজিটাল যুগে শুধু খবর নয়, প্রয়োজন ঝড় তোলা খবর-সেনসেশন। সেই সেনসেশনের সাপ্লাই দিতে গিয়ে গণমাধ্যম নিজেই নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করছে। এ যুদ্ধে পেশাদারত্ব, সততা-নিরপেক্ষতা, বস্তুনিষ্ঠতা- কিছু আদর্শিক শব্দমালামাত্র। আর গণমাধ্যমের ’মান’ বিষয়টিওতো আপেক্ষিক। কার মান কে ঠিক করবে?
টিকে ও টপকে থাকার প্রতিযোগিতায় নিজের খরচ মিটিয়ে টিকে থাকাটাই বড় কথা। মান নিয়ে টিকে থাকার জন্য পেশাদারত্বের সঙ্গে সঙ্গে সাংবাদিকতা তথা গণমাধ্যমের নীতি-নৈতিকতা ও খরচের সম্পর্ক রয়েছে। সে সম্পর্কে কোনো রকম চিড় ধরলেই গণমাধ্যমে নিজের মান হারিয়ে ফেলে, কর্তৃপক্ষের আস্থা ও জনগণের ভালোবাসা সবই হারায়। এতে করে গণমাধ্যমের সঙ্গে সঙ্গে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় সেই প্রান্তিক পাঠক মানে জনগণ মানে রাষ্ট্র।
এত সব চ্যালেঞ্জের মধ্যেও থেমে নেই গণমাধ্যমের জন্ম, বিবর্তন ও বিকাশ। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নতুন আশা ও উদ্যোম নিয়ে, নতুন স্বপ্ন নিয়ে শুরু হয় নতুন গণমাধ্যমের পথচলা। এদের মধ্যে অনেকেই হয়তো গা ভাসিয়ে দিচ্ছে গড্ডলিকায়, সময়ের সহজ স্রোতে। কিন্তু কেউ কেউ থাকবে যারা শত প্রতিকূলতার মাঝেও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার শক্তি সঞ্চয় করে পথচলা শুরু করবে।
শক্তি যদি হয় পেশাদারত্ব, তবে এ পথচলা কঠিন হলেও উপভোগ্যও কম নয়। পেশাদারত্বের মাঝেই অনলাইন গণমাধ্যম নিজেকে আবিষ্কার করবে নতুন রূপে ও আঙ্গিকে। নিজেকে নিজে চ্যালেঞ্জ করার মাঝেই রয়েছে অনলাইন গণমাধ্যমের চলার শক্তি। বাইরে ঝড়, আছে অন্ধকার, বজ্রপাত। কিন্তু বিজলির আলোওতো আছে। প্রয়োজন প্রশান্ত হৃদয় ও দৃঢ় পদক্ষেপ।
নিউজবাংলা গত এক বছর ধরে সে কাজটিই যেন করে যাচ্ছে। প্রশান্ত হৃদয়ে দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে যাচ্ছে নিজের মতো করে। গড্ডলিকার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। নিজেকে নিজেই সে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। অব্যাহত থাকুক এ প্রয়াস। শুভ জন্মবার্ষিকীতে নিউজবাংলার লড়াকুদের জন্য শুভ কামনা।
লেখক: আইনজীবী ও কলাম লেখক