বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

পিঠেতে খাবার তবু তা যাবে না ছোঁয়া

  • চিররঞ্জন সরকার   
  • ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ১৬:৫৯

ডিজিটাল প্রযুক্তি, লগ্নিপুঁজি ও নতুন উপভোক্তা-সংস্কৃতি মিলে কী করে নতুন সেবা তৈরি হচ্ছে। ফ্ল্যাটবাড়ির মানুষ আর বাজারে গিয়ে আনাজ কিনবেন না, হোটেলে গিয়ে খাবেন না, সেলুনে গিয়ে চুল কাটাবেন না, ওষুধের দোকানে যাবেন না, ট্যাক্সি ধরতে স্ট্যান্ডে যাবেন না। মোবাইলের স্ক্রিন বেয়ে বাজারই তাদের দরজায় বেল বাজাচ্ছে। নতুন এই পরিষেবা-সংস্কৃতি এক নতুন শ্রম-সংস্কৃতিরও জন্ম দিচ্ছে, যেখানে কাজ অস্থায়ী, তাৎক্ষণিক, এবং পারিশ্রমিক পাওয়ার শর্ত শ্রমিকের কাছে অস্বচ্ছ।

শহরের রাস্তাঘাটে এখন পিঠে একটা বড় ব্যাগ ঝোলানো মোটরসাইকেল বা বাই-সাইকেল-আরোহী একদল তরুণ-তরুণীকে দেখা যায়। যাদের বলা হয় ডেলিভারি ম্যান বা ডেলিভারি পার্সন। তারা মূলত কোনো পণ্য বা খাবার গ্রাহকের কাছে সরাসরি পৌঁছে দেবার দায়িত্ব পালন করে থাকেন।

বর্তমানে ইন্টারনেটভিত্তিক বেচাকেনা আর হোম ডেলিভারি সার্ভিসের প্রসারের কারণে দেশের শহরাঞ্চলগুলোতে এ পেশার মানুষের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। করোনা মহামারি অনলাইনে অর্ডার–‌করা খাবার গ্রাহকদের কাছে পৌঁছে দেয়া পেশার এক নতুন দিক খুলে দিয়েছে। আগে ছিল বাইকে করে খাবার পৌঁছে দেয়া। এখন এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সাইকেলও।

ফুড ডেলিভারি থেকে বহুজাতিক ই-কমার্স সংস্থার পণ্য নিয়ে যাচ্ছে তরুণরা। দোকানে গিয়ে খাবার বা পণ্য কিনে আনার পরিবর্তে এখন অনেকেই ঘরে বসে কেনাকাটা সারেন।ফেসবুক বা অ্যাপসভিত্তিক খাবার বা পণ্যক্রয়ের এই সুযোগ ব্যস্ত নাগরিক জীবনকে অনেক সহজ করে দিয়েছে। এখন অনলাইনে বা ফোনে অর্ডার করলে গরম গরম খাবার কয়েক মিনিটের মধ্যে চলে যায় দোরগোড়ায়। পণ্যও পৌঁছে যায় ঘরে।

করোনার কারণে দেশে অনেক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম সংকুচিত অথবা বন্ধ হয়ে গেছে। ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগও কমে গেছে। এ পরিস্থিতিতে মানুষ নতুন পেশার দিকে ঝুঁকছে। পণ্য বা খাবার পৌঁছে দেবার পেশাটি অনেক গরিব মানুষের জন্য বেঁচে থাকার অবলম্বনে পরিণত হয়েছে। করোনার কারণে ভিড় বা জনসমাগম এড়াতে দোকান বা হোটেলে না গিয়ে অনলাইনে খাবার বা পণ্য কেনার আগ্রহও মানুষের মধ্যে বেড়েছে। আর এসব পণ্রে ঘরে পৌঁছে দেবার কাজটিকে একদল তরুণ-তরুণী নতুন পেশা হিসেবে নিয়েছেন।

এই ডেলিভারি পার্সনের দেখলে চোখে ভেসে ওঠে স্কুলের পাঠ্যবইয়ের পাতায় ‘হাতে লন্ঠন আর পিঠে চিঠির বোঝা’— সেই রানারের ছবিটির কথা। মনে পড়ে গায়ে কাঁটা দেয়া সেই পঙ্‌ক্তি, “পিঠেতে টাকার বোঝা তবু এই টাকাকে যাবে না ছোঁয়া।” প্রায় এক শতাব্দী আগে লেখা সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতার সেই রানার আজও ছুটে চলেছে। আজও যখন দেখি পেটে খিদে চেপে ডেলিভারি পার্সন স্বাদ ও গন্ধে ভরপুর খাবারের প্যাকেট বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেয়, কিন্তু সে খাবার কিনে খাওয়ার স্বপ্ন দেখার সাহস করতে পারে না, বুকের ভেতর বড় আন্দোলন হয়!

এক ডেলিভারি বয়কে চিনি যার নাম আলম, থাকেন শ্যামলীর আদাবরে। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত পরিশ্রম করেন। সে সাইকেলে করে খাবার পৌঁছে দেন বিভিন্ন ফ্ল্যাটবাড়ি ও বিভিন্ন অফিসের তলায় তলায়। তিনি সারাদিনে ১০ থেকে ১২টা খাবারের অর্ডার ডেলিভারি করেন। দূরত্বের ওপর নির্ভর করে ডেলিভারি-প্রতি বিশ থেকে ত্রিশ টাকা মেলে। গ্রাহক যদি একটু বেশি মানবিক হন, তাহলে কোথাও কোথাও এর বাইরেও কিছু টিপস মেলে। সাইকেলে ডেলিভারি করলে বাইকে ডেলিভারির চাইতে ট্রিপ প্রতি একটু কম রেট পাওয়া যায়।

আলমের বাড়ির লোকেরা এখনও বুঝতে পারেননি, হোটেল থেকে খাবার পৌঁছে দেয়া কেমন চাকরি? আলমও বোঝাতে পারেননি যে, ডিজিটাল প্রযুক্তি, লগ্নিপুঁজি ও নতুন উপভোক্তা-সংস্কৃতি মিলে কী করে নতুন সেবা তৈরি হচ্ছে। ফ্ল্যাটবাড়ির মানুষ আর বাজারে গিয়ে আনাজ কিনবেন না, হোটেলে গিয়ে খাবেন না, সেলুনে গিয়ে চুল কাটাবেন না, ওষুধের দোকানে যাবেন না, ট্যাক্সি ধরতে স্ট্যান্ডে যাবেন না। মোবাইলের স্ক্রিন বেয়ে বাজারই তাদের দরজায় বেল বাজাচ্ছে। নতুন এই পরিষেবা-সংস্কৃতি এক নতুন শ্রম-সংস্কৃতিরও জন্ম দিচ্ছে, যেখানে কাজ অস্থায়ী, তাৎক্ষণিক, এবং পারিশ্রমিক পাওয়ার শর্ত শ্রমিকের কাছে অস্বচ্ছ।

খাবার ডেলিভারি বা অ্যাপভিত্তিক যাত্রী পরিবহন সেবা দিন দিন প্রসারিত হচ্ছে। সেসঙ্গে এসব কাজে বেকারদের অংশগ্রহণও বাড়ছে। কিন্তু শ্রমিক যত বেড়েছে, তত ব্যক্তিপ্রতি অর্ডার কমছে। স্বাধীন পেশায় তাৎক্ষণিক উপার্জনের খোয়াব ফিকে হয়ে যায় অর্ডার ঢোকার তিতিবিরক্ত অপেক্ষায়।

দুনিয়াজুড়ে ‘গিগ ইকনমি’-র চিত্রটি একই রকম—কর্মীরা ক্রমাগত লড়ে যাচ্ছেন কাজের অনিশ্চয়তা, মজুরির ওঠা-নামা, খামখেয়ালি ‘ইনসেন্টিভ’ নীতির সঙ্গে। অধিকাংশ ডেলিভারি কোম্পানি প্রতি বছর বিপুল লোকসান দেখায়, অথচ বছরের পর বছর নতুন পুঁজি আসতেই থাকে।

এদিকে রোজগার কমছে আলমদের। আলমের ভাষ্য মতে, এখন অর্ডার ঢোকা, ‘ইনসেন্টিভ’ পাওয়া, দূরত্বের ওপর নির্ভর করে ট্রিপ-প্রতি রেট, সবটাই ভুতুড়ে হিসাব— কীভাবে সেগুলো ঠিক হয় আলমরা জানেন না, বোঝেনও না। আলম এ বছর গ্রাজুয়েট হয়েছে। গত বছর থেকে পার্ট-টাইম ডেলিভারি করতেন বিকেল পাঁচটা থেকে সাড়ে দশটা— গড়ে আট-দশটা অর্ডার ঢুকলে দুইশ টাকা আয় হতো, যা দিয়ে কোনো রকমে টিকে থাকা যায়। এখন মাস্টার্সে ভর্তির পাশাপাশি ফুলটাইম কাজ করছেন ডেলিভারির, দৈনিক পাঁচ শ টাকার ইনসেন্টিভ পেতে হলে দিনে অন্তত ষোলোটা অর্ডার চাই। কিন্তু তা সব সময় হয় না।

ওদের ব্যক্তিগত জীবনটা বঞ্চনা দিয়ে ঘেরা। রেস্তরাঁর ভেতরে যখন সুখাদ্য রান্না হয়, তখন বাইরে চলে বিড়ি আর চায়ের রোজনামচা। ফুলটাইম কর্মীরা রাস্তার ধারে বিক্রি করা পাউরুটি-কলা খান। কেউ সিঙ্গারা-চা খান। একটা ছোট্ট বার্গার বা, চিকেন রোল এখন পঞ্চাশ টাকা ছাড়িয়েছে সর্বত্র।

ব্যাগে যে মূল্যের খাবার বইছেন প্রতিবার, সেটা তাদের দৈনিক আয়ের চেয়ে অনেক বেশি। একটা নামকরা পিৎজা ডেলিভারির অর্ডার আসে আলমের কাছে, যার একটির দাম বারো শ’ টাকা। যা আলমের ৪৮টি ট্রিপের আয়ের সমান। পিঠের ব্যাগ থেকে উঠে আসা সুগন্ধ মাথায় ধাক্কা মারলেও নির্বিকার হয়ে থাকাটাই এদের শিক্ষা।

ইরানের পরিচালক জাফর পানাহির ক্রিমসন গোল্ড ছবিতে যুদ্ধফেরত নায়ক পিৎজ়া ডেলিভারি করেন। তার চোখ দিয়ে দর্শক দেখেন সমাজের উঁচুতলার ক্রেতাদের জীবনযাপন, সংস্কৃতি, পছন্দ, অগ্রাধিকার। শহরে এখন দুটি জগৎ, একটা হাউসিং কমপ্লেক্স ও রিয়েল এস্টেটের নিরাপত্তার ঘেরাটোপে, অন্যটি নিম্ন আয়ের মানুষের টিকে থাকার ভয়াবহ সংগ্রামে। ডেলিভারি-কর্মীরা এই দুই জগতের মধ্যে নিয়ত যাতায়াত করছেন।

স্বাধীনতার ৫০ বছর অতিক্রম করার পরেও সেই শ্রেণির মানুষের সংখ্যাধিক্য দেখা যাচ্ছে, যারা প্রদীপকে ধরে রাখা পিলসুজ। যারা খাবারের ‘কুরিয়ার’, পিঠে রসালো, সুগন্ধি খাদ্যসহ বিভিন্ন জিনিস বহন করেও খিদের যন্ত্রণা চেপে রেখে এগিয়ে চলেছেন। মানুষ যে বাঁচার জন্য কত যান্ত্রিক, জড়পদার্থ হয়ে গিয়েছে, তা এই খাবার-বহনকারী শ্রমিকদের মর্মন্তুদ জীবনচিত্র দেখলেই বেশ বোঝা যায়।

এদের প্রতি কারো কোনো সহানুভূতি নেই, নেই কোনো রাষ্ট্রীয় নীতি। দেশটা কেবল ধনীক শ্রেণির জন্য নিবেদিত হতে বসেছে। এই করোনাকালে তাদের অকল্পনীয় সম্পদবৃদ্ধি ঘটেছে। কোটিপতির সংখ্যাবৃদ্ধিও থেমে নেই। পাশাপাশি বঞ্চিত-প্রতারিত-অবহেলিত একটা শ্রেণিও বেড়ে চলেছে জ্যামিতিক হারে। এভাবেই যদি চলতে থাকে, তাহলে এই বঞ্চিত শ্রেণি কেড়ে ও মেরে খাওয়ার পথে এগোতে পারে কোনো এক সকালে, তা কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না!

লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা, প্রাবন্ধিক।

এ বিভাগের আরো খবর