আজ প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার ৭৫তম জন্মদিন। নানা আয়োজনে দেশ-বিদেশে তার অনুরাগীরা উদযাপন করছেন দিনটি। রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ সংগঠনসমূহ ব্যাপক আয়োজনে প্রিয় নেত্রীকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে যোগদান উপলক্ষে এখন তিনি যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছেন। সংগত কারণেই ঢাকায় তার অফিস কিংবা গণভবনে শুভেচ্ছা জানাতে কেউ যাবেন না, তারা শুভেচ্ছা জানাবেন ফেসবুকসহ নানা সামাজিক নেটওয়ার্কে।
এর বাইরে এমন বহু মানুষ আছেন, যারা আওয়ামী লীগের কোনো পর্যায়ের নেতাও নন, কর্মীও নন, অথচ শেখ হাসিনার জন্য শুভ কামনা জানাচ্ছেন, দোয়া করছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তারা পরিচিতও নন কিন্তু তারা ভালোবাসেন তাকে। তার সুখে-দুঃখে উদ্বেলিত হন এসব মানুষ। এদেরকেই আমরা বলি জনসাধারণ। এই জনসাধারণের ভালোবাসাতেই বঙ্গবন্ধু মহান নেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এই দুঃখিনী বাংলার দুঃখমোচনের জন্য।
সেই বিপুলসংখ্যক সাধারণেরই একজন হিসেবে বলছি : শুভ জন্মদিন বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রিয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা! আপনার সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু হোক। বার বার ফিরে আসুক জন্মতিথির এই সোনালি সকাল।
সোনালি সকাল আর শেখ হাসিনার জন্মদিন প্রায় সমার্থক। কারণ এ দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এমন এক আশ্চর্য অধ্যায় তিনি রচনা করেছেন, যা অন্ধকারে নিমজ্জিত একটি দেশের মানুষের জন্য দীর্ঘ প্রতীক্ষার শেষে সোনালি সূর্যোদয় দেখার আনন্দের সঙ্গে তুল্য।
দীর্ঘ অন্ধকার কথাটা এ কারণে বলা- ৩০ লাখ শহিদের রক্তফসল এই বাংলাদেশ ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর ভয়ংকর অন্ধকারের দিকেই যাত্রা করেছিল! অথচ এই অন্ধকার একাত্তরেই মুছে গিয়েছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তা আবার ফিরে আসে।
যে অন্ধকার তাড়াতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সারা জীবন সংগ্রাম করতে হয়েছে, চরম ত্যাগ স্বীকার করে এই জাতিকে ২৩ বছরের ঔপনিবেশিকতার গ্লানি থেকে স্বাধীনতার সোনালি সূর্যের মুখোমুখি করেছিলেন ১৯৭১ সালের ঐতিহাসিক মার্চে এবং ১৬ ডিসেম্বর জাতি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পরাস্ত করে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে স্বাধীন সার্বভৌম দেশের পতাকা উঁচু করে ধরেছিল পৃথিবীর বুকে।
কিন্তু স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যেই যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে নিমগ্ন স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতাকে হত্যার মধ্য দিয়ে স্বাধীনতাবিরোধী দেশি-বিদেশি চক্র বাংলাদেশকে তার কক্ষচ্যুত করে নিয়ে যেতে থাকে সামরিক শাসন, মৌলবাদ, জঙ্গিবাদ আর সন্ত্রাসের ভয়ংকর অন্ধকার পথে!
পৃথিবীর দেশে দেশে বহু রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড হয়েছে। সরকারপ্রধান নিহত হয়েছেন। কোনো কোনো দেশে জিন্নাহ-গান্ধীর মতো জাতির পিতারাও নিহত হয়েছেন, কিন্তু তাতে কোনো রাষ্ট্রের চরিত্র হনন হয়নি, স্বাধীনতার মূল চেতনা থেকেও কোনো দেশ বিচ্যুত হয়ে যায়নি।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার কারণে বাংলাদেশ আমূল পাল্টে গেছে! যে পাকিস্তানি সামরিক শাসন আর ধর্মান্ধতা থেকে বেরিয়ে এসেছিল বাংলাদেশ একটি প্রগতিশীল রাষ্ট্র হিসেবে, সেই পথ উল্টো করে দিয়েছিল বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী এবং খুনিচক্রের সহযোগীরা। সামরিক শাসকেরা বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে ক্ষমতা দখল করেই তুষ্ট ছিল না, তারা বাংলাদেশকে পাকিস্তানি অন্ধকারেই নিমজ্জিত করতে থাকে।
দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল এবং মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়ার গৌরবের অধিকারী আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব সংকটেও পড়ে যায়- এরকম একটা সময়েই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাকে দেশে ফিরিয়ে আনে এবং শেখ হাসিনাকে দলের সভাপতির মতো গুরু দায়িত্ব অর্পণ করে এবং তা সর্বসম্মতভাবেই।
১৯৮১ সালের ১৭ মে স্বজনহারা শেখ হাসিনা বাংলাদেশে ফেরার পর থেকে বাংলাদেশে শুরু হয় তার মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় অস্তিত্ব ফিরিয়ে আনার সাধনা। স্বজনহারানো শোক ভুলেছেন তিনি দেশবাসীর ভালোবাসা পেয়ে। তবু দেশের কাণ্ডারি হওয়ার সেই পথ কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। বরং ছিল ভয়াবহ কণ্টকিত।
তার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন যে কত তাৎপর্যপূর্ণ ছিল, তা ওই সময়ের বিদেশি পত্র-পত্রিকার খবরের দিকে দৃষ্টিপাত করলে বোঝা যায়।
১৯৮১ সালের ৩১ মে লন্ডনের ‘সানডে টেলিগ্রাফ’ পত্রিকায় বলা হয়- ‘বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মুজিবের কন্যা শেখ হাসিনার প্রত্যাবর্তনের ফলে দেশে রাজনৈতিক কর্মচাঞ্চল্য দেখা দেয়। ছয়বছর ভারতে নির্বাসিত জীবন যাপনের পর তিনি আওয়ামী লীগের সভানেত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ ও জিয়া শাসনের বিরোধিতা করার জন্য দেশে ফিরে এসেছেন।’
১ জুনের ‘দি গার্ডিয়ান’ ও ‘মর্নিং স্টার’ পত্রিকায় বলা হয় ‘শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন জিয়ার পক্ষে গুরুতর উদ্বেগজনক ছিল’।
একই তারিখের ‘দি টাইমস’-এ বলা হয়- ‘সংসদের ক্ষমতা হ্রাস করে জিয়াউর রহমান কর্তৃক অধিক ক্ষমতা কুক্ষিগত করার ফলে আওয়ামী লীগের প্রতি জনসমর্থন ক্রমেই বৃদ্ধি পায়। শেখ হাসিনার দেশে প্রত্যাবর্তনের ফলে উক্ত জনসমর্থন আরও পুঞ্জিভূত হয়। ‘ফিনান্সিয়াল টাইমস’ ও সাপ্তাহিক ‘ইকোনোমিস্ট’ পত্রিকায়ও অনুরূপ মন্তব্য করা হয়। (সূত্র: শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন/ সুভাষ সিংহ রায় , পৃষ্ঠা ৯৭)
এসব তথ্য থেকেই বোঝা যায় শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন এবং নেতৃত্ব কী বিপুল প্রভাব সৃষ্টি করেছিল বাংলাদেশের রাজনীতিতে!
জেনারেল জিয়াকে আকস্মিকভাবে সেনা-অভ্যুত্থানে নিহত হলে তার গড়া রাজনৈতিক দল বিএনপি সবচেয়ে অতিষ্ঠ ছিল শেখ হাসিনা-আতঙ্কে। তাকে একাত্তরের স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত-মুসলিম লীগের মতোই বিএনপিও ভয় পেত। কারণ বিএনপি জানত মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব-দানকারী বঙ্গবন্ধুর গড়া দল আওয়ামী লীগ ও তার কন্যা শেখ হাসিনার চেয়ে বড় শত্রু তাদের আর নেই। তাই আওয়ামী লীগ এবং তার প্রধান চালিকাশক্তি শেখ হাসিনা শুরু থেকেই তাদের চোখের বালিতে পরিণত হয়েছিলেন। যে কারণে বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক দলের প্রধানকে হত্যার চেষ্টা করা না হলেও ১৯৮১ সালে দেশে ফেরার পর থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত কম করে হলেও শেখ হাসিনাকে অন্তত ১৯ বার হত্যার চেষ্টা করা হয়!
সবচেয়ে ভয়ংকর চেষ্টাটি ছিল ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউর সন্ত্রাসবিরোধী শান্তি সমাবেশে শেখ হাসিনাসহ দলের শীর্ষ নেতাদের একসঙ্গে গ্রেনেড ছুড়ে নির্মূল করে দেয়ার। সিনিয়র নেতা আইভি রহমানসহ অনেকে নিহত হলেও সৌভাগ্য ক্রমেই বেঁচে গিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। এর পরের ইতিহাস সবারই জানা।
সুতরাং শেখ হাসিনা যে মৌলবাদ-জঙ্গিবাদ এবং সামরিকতন্ত্রের বিরুদ্ধে সবচেয়ে সোচ্চার এবং প্রগতির বাতিঘর হবেন, সেটাই তো স্বাভাবিক। আর সে কারণেই দেশের শিল্পী-সাহিত্যিক, সাংবাদিক-শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবীসহ সমাজের প্রগতিশীল পেশাজীবী যেমন, তেমনই সমাজের সচেতন মানুষের সমর্থন ও ভালোবাসায় অভিষিক্ত হয়েছেন দেশরত্ন শেখ হাসিনা। গ্রেনেড হামলা ব্যর্থ হওয়ায় আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল অন্ধকারের অনুসারীরা।
২০০৬ সালের অক্টোবরে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও তাই রাষ্ট্রপতি ড. ইয়াজউদ্দিনকেই একই সঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে বসিয়ে আবার ক্ষমতায় যাবার জন্য চারদলীয় জোট সৃষ্টি করে রাজনৈতিক সংঘাতময় পরিস্থিতি! যার ফসল ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারির সামরিক বাহিনীর সমর্থিত মঈনউদ্দিন-ফখরুদ্দিন সরকার। সে সরকারও অবৈধ পথে ক্ষমতায় থেকে যেতে চেয়েছিল। তাদেরও টার্গেট ছিল শেখ হাসিনাকে রাজনীতি থেকে সরানো।
চাঁদাবাজির মিথ্যা মামলা দিয়ে তাকে কারারুদ্ধ করা হয়েছিল। তার আগে এই সামরিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারই তাকে দেশে ফিরতে বাধা দিয়েছিল। কিন্তু সকল বাধা তুচ্ছ করে সাহসী নেত্রী শেখ হাসিনা গণতন্ত্রের সংগ্রামে শামিল হয়েছেন। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তার দল নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় বিজয়ী হলে ২০০৯ সালে পুনরায় রাষ্ট্র পরিচালনা শুরু করেন দেশরত্ন শেখ হাসিনা। সে পথেও বাধা কম ছিল না, এখন তা আরও তীব্রতর। কিন্তু প্রাণের মায়া ত্যাগ করে দেশকে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
গত একযুগের বাংলাদেশের দিকে তাকালে বোঝা যায় কী বিস্ময়কর পরিবর্তনই না তিনি ঘটিয়েছেন দেশে! দেশকে ডিজিটাইজেশন করে অর্থনৈতিক এবং যোগাযোগের ক্ষেত্রে যে নতুন যুগের সূচনা করেছেন, কেউ তা কল্পনাও করতে পারেনি আগে।
নারীর ক্ষমতায়ন, শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার বিস্ময়করভাবে কমিয়ে আনা, সামাজিক নিরাপত্তা-বেষ্টনী সৃষ্টি করে দারিদ্র্য বিমোচনে গতি সঞ্চারসহ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এমন সব কর্মসূচি গ্রহণ করেছেন, যা মানুষের মাথাপিছু আয় বাড়িয়ে, জীবনমান উন্নত করে বাংলাদেশকে নতুন যুগে প্রবেশ করিয়েছে।
তাই মাত্র একযুগের ব্যবধানে দারিদ্র্যপীড়িত দেশ আজ উন্নয়নশীল মধ্যম আয়ের দেশের কাতারে! বাংলাদেশ আজ বিশ্ববাসীর কাছে উন্নয়নের রোল মডেল।
এর সবকিছুই সম্ভব হয়েছে শেখ হাসিনার দেশপ্রেম, সততা, কর্তব্যনিষ্ঠা আর লক্ষ্যে অবিচল পথচলায়। তার সুযোগ্য নেতৃত্বই বাংলাদেশ আজ বিশ্বসমাজে এত বড় সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত। উন্নয়নের নানা সূচকে বাংলাদেশের যে অগ্রগতি, তা দেখে কবিতার ভাষায় বলতে ইচ্ছে করে:
দেশপ্রেমী তুমি জনকের মতো, তুমি যে তুলনাহীন
সত্যে-সাহসে অবিচল তুমি, আশাবাদী চিরদিন।
আশার রৌদ্র ছড়াও তুমিই এদেশে প্রতিটি ভোরে
বাংলার নীল আকাশে তাইতো শান্তি-পায়রা ওড়ে।
জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে দেশরত্ন প্রধানমন্ত্রীর একটি সামান্য রেখাচিত্রই অঙ্কন করা গেল মাত্র। প্রথম একুশে সংকলনের সম্পাদক ও মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্রর সম্পাদক প্রখ্যাত কবি হাসান হাফিজুর রহমান বহুবছর আগে শেখ হাসিনাকে উদ্দেশ করে বলেছিলেন- ‘আপনিইতো বাংলাদেশ’।
এত বছর আগে কেন এমন মন্তব্য করেছিলেন তার মতো বিশাল ব্যক্তিত্ব, আজ আমরা তা উপলব্ধি করতে পারি যখন তিনি বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বাস্তবে রূপায়িত করতে চলেছেন।
শুভ জন্মদিন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, জয়তু শেখ হাসিনা!
লেখক: কবি ও সিনিয়র সাংবাদিক, সাবেক পরিচালক (বার্তা) বাংলাদেশ টেলিভিশন।