আমাদের ২১ ফেব্রুয়ারি, ২৬ মার্চ, ১৬ ডিসেম্বর, ১৭ মার্চ, ১০ জানুয়ারির মতো স্মরণীয় দিনগুলো যেমন ত্যাগ আর গৌরবের মহিমায় জ্বল জ্বল করছে, তেমনি গণহত্যার ২৫ মার্চ, ১৫ আগস্ট, ২১ আগস্ট, ১৭ই আগস্ট, ২৬ সেপ্টেম্বর, ৯ জুলাইয়ের মতো ভয়াবহ বিপর্যয় সৃষ্টিকারী কিছু কালো দিনও আছে। না চাইলেও আমরা ভুলে যেতে পারব না। তেমনই কলঙ্কিত একটি দিন ২৬ সেপ্টেম্বর। ১৯৭৫ সালের এই দিনে খন্দকার মোশতাক তার সেই কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করেছিল, যা জেনারেল জিয়াউর রহমান বিএনপি গঠনের পরে ১৯৭৯ সালের ৯ জুলাই পার্লামেন্টে আইনে পরিণত করে পঞ্চম সংশোধনী হিসেবে সংবিধানে ভুক্ত করা হয়।
দেশি-বিদেশি চক্রান্ত বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছিল যে খুনিরা, তাদের যাতে কোনোদিন বিচারের মুখোমুখি হতে না হয়, সেই অশুভ উদ্দেশ্যেই রাষ্ট্রীয় প্রশাসনযন্ত্র যখন ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে, তখন তা কেবল কোনো ব্যক্তি বা প্রশাসনযন্ত্রের জন্যেই নিন্দনীয় কাজ নয়, গোটা জাতির জন্যই তা কলঙ্ক আর চরম লজ্জার ঘটনা।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পূর্বপরিকল্পনা অনুসারে ঘাতকচক্রের গড়া পুতুল সরকারের রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদ ওই সালেরই ২৬ সেপ্টেম্বর জারি করেছিল ইন্ডেমনিটি অধ্যাদেশ, শিরোনাম ছিল রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ নম্বর ৫০। খন্দকার মোশতাকের পাশাপাশি তাতে স্বাক্ষর করেন সে সময়ের আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিবও।
সেই অধ্যাদেশ এর আইনগত বৈধতা দেয় বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রধান বেনিফিশিয়ারি জেনারেল জিয়াউর রহমান। ১৯৭৯ সালের ৯ জুলাই জাতীয় সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় বিএনপি এই কলঙ্কিত অধ্যাদেশকে বিল হিসেবে পাস করিয়ে নেয়। সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর পর সেদিন সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত করা হয় এই কালো আইনটি। সপরিবারে বঙ্গবন্ধুহত্যা তো বটেই ১৯৭৫-এর ৩ নভেম্বর জেলে জাতীয় চার নেতা হত্যা পর্যন্ত বিচার থেকে অব্যাহতি পেয়ে যায়! দায় মুক্তির পাশাপাশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বাংলাদেশ দূতাবাসে চাকরি দিয়েও খুনিদের পুরস্কৃত করা হয়।
বঙ্গবন্ধু হত্যার অব্যবহিত পর পরই সেনাপ্রধান হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন জেনারেল জিয়াউর রহমান। মেজর জেনারেল থেকে হয়ে যান লেফটেন্যান্ট জেনারেল। সামরিকশাসন জারি থাকা অবস্থায়ই প্রেসিডেন্ট পদে থাকার বৈধতা নিয়েছিলেন হ্যাঁ-না ভোটের প্রহসন করে। কয়েক কোটি টাকা খরচ করে সারা দেশে ভোটকেন্দ্র বসিয়ে সেই হ্যাঁ-না গণভোটের নাটক হয়েছিল।
সামরিক পোশাকেই জেনারেল জিয়ার রাজনৈতিক দল বিএনপি গঠন এবং ১৯৭৯ সালে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার বিজয় নিয়ে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী আনার পূর্বাপর সব ঘটনাই আজ ইতিহাসের অংশ। সেই সংসদেই সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী এনে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালে সামরিকশাসন তুলে নেয়া পর্যন্ত জিয়া-মোশতাক গংদের সমস্ত কার্যক্রমকেই বৈধতা দেয়া হয়।
সংগত কারণেই ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে বিচারহীনতার অপসংস্কৃতি সৃষ্টিকারী কালো দিন ৯ জুলাই অনাগত কাল ধরে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি কলঙ্কিত তারিখ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।
একই সঙ্গে বিএনপি এবং এর দোসরদের ললাটেও এই কলঙ্কের দাগ অমোচনীয় হয়েই থাকবে। ইতিহাসের শিক্ষাই হচ্ছে এই যে, কেউ ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে না। যদি করত, তাহলে খন্দকার মোশতাক বাংলার ইতিহাসের আরেক মীরজাফর হিসেবে ধিকৃত হয়ে বিদায় নেবার পরও ১৫ আগস্টের হত্যাকারীদের পক্ষে কারো দাঁড়াবার কথা ছিল না।
মীরজাফরের মতো মোশতাকওতো মাত্র কদিনের রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন খুনিদের ক্রীড়নক হিসেবে। গলাধাক্কা দিয়ে তাকে বিদায়ের পর বিচারপতি সায়েমকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক করেন জেনারেল জিয়া। তাকে নামমাত্র রাষ্ট্রপতি বানিয়ে জিয়া নিজের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে রাজনীতিতে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন মাত্র।
প্রশ্ন তোলা যেতেই পারে, খন্দকার মোশতাকের মতো গণধিকৃত, সেই একই বেঈমানি তিনিও কি করেননি? রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হবে জেনেও তিনি কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি বরং ‘গো এহেড’ বলে ফারুক-রশীদের সমর্থন দিয়ে গেছেন বঙ্গবন্ধু হত্যায়! বিস্ময়কর হলেও সত্য একজন উপপ্রধান সেনাবাহিনী প্রধান হয়েও তিনি এমন নৃশংস ভূমিকাই পালন করেছিলেন!
জিয়াউর রহমান যে ক্ষমতার কী তীব্র পিপাসু, সেটা স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরু থেকেই টের পাওয়া গিয়েছিল। কালুরঘাটে স্থাপিত বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠের জন্য ২৭ মার্চ জিয়াউর রহমানকে নিয়ে যাওয়ার পরে তিনি যে কাণ্ড করেছিলেন, তাও ইতিহাসে লিপিবদ্ধ।
চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা এমএ হান্নান ঘোষণা দেয়ার পরও সবাই ভাবলেন যে, একজন বাঙালি সেনাকর্মকর্তাকে দিয়ে ঘোষণাটি দেয়ানো গেলে সশস্ত্র বাহিনীতে কর্মরত বাঙালি সেনারা মুক্তিযুদ্ধে যেতে উদ্বুদ্ধ হবেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর পক্ষে ঘোষণা না করে সরাসরি নিজেকে রাষ্ট্রপতি বলে সে ঘোষণা পাঠ করেছিলেন জিয়া! সঙ্গে সঙ্গে বিরূপ প্রতিক্রিয়া! আবার পাঠ করলেন তিনি এবং এবার বললেন, “অন বিহাফ অব আওয়ার ন্যাশনাল লিডার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান...।”
সুতরাং সেই জিয়ার স্বরূপ উন্মোচন যে একদিন হবে সে তো ছিল অনিবার্য সত্য এবং সময়ের ব্যাপার মাত্র। বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথে জিয়া কেন যাবেন? তার অন্তরে যে পাকিস্তান! বঙ্গবন্ধু হত্যার পর জিয়াউর রহমানের গভীর পাকিস্তানপ্রীতি প্রকটভাবে দৃশ্যমান হয়ে উঠেছিল!
পঞ্চম সংশোধনীতে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশের মতো জঘন্য কালাকানুন শুধু সংবিধানে অন্তর্ভুক্তই করেননি রাষ্ট্রপতি জিয়া, বঙ্গবন্ধু-হত্যার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িতদের বিচারের পথ চিরতরে রুদ্ধ করায় সহযোগী ভূমিকা পালনের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের মূল প্রেরণা ও চেতনাই বাঙালি জাতির জাগরণের মূলশক্তি ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’ই সংবিধান থেকে মুছে দিলেন সংবিধান সংশোধন করে!
যে ‘জয়বাংলা’ রণধ্বনি দিয়ে বাংলার মানুষ মুক্তিযুদ্ধ করেছে, সেই জয়বাংলা মুছে দিয়ে মৃত পাকিস্তানের ‘জিন্দাবাদ’ ফিরিয়ে আনলেন সংশোধনীতে। বাংলাদেশ বেতারের নাম বদলে রেডিও পাকিস্তানের স্টাইলে করলেন রেডিও বাংলাদেশ!
জ্ঞাতসারে বলতে হবে এ কারণে যে, কর্নেল ফারুক-রশিদ, ডালিমদের ১৫ আগস্টের পরিকল্পনা জিয়াউর রহমান জেনেছিলেন বঙ্গবন্ধু হত্যার ৪ মাস ১৯ দিন আগে! ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে কর্নেল ফারুক ও রশিদ গং প্রথমে ঢাকা থেকে ব্যাংককে চলে গিয়েছিলেন। সেনাপ্রধান জিয়া তাদেরকে দ্রুত বিশেষ ব্যবস্থায় দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেন। সেখানেই ব্রিটিশ সাংবাদিক ম্যাসকারাহ্যানসকে টেলিভিশনের জন্য যে সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন, রশিদ, ফারুকরা তাতে উল্লেখ করেছিলেন জেনারেল জিয়াউর রহমানের ভূমিকার কথা।দুজনই বলেছেন ২০ মার্চ সন্ধ্যায়
আমরা জিয়ার সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পাই। আমাদের পরিকল্পনা শুনে তিনি বললেন, সিনিয়র অফিসার হিসেবে আমি তোমাদের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত থাকতে পারি না। তোমরা ইয়াং অফিসাররা করতে চাইলে এগিয়ে যাও। শেষ বাক্যটা ছিল, ‘গো এহেড।’
ফারুক ও রশিদের সেই সাক্ষাৎকার আগ্রহী পাঠক ইচ্ছে করলে ইউটিউবে সার্চ দিয়ে এখনও শুনতে পারেন।
যাহোক, পৃথিবীর ইতিহাসের এই কলঙ্কিত আইন, বিচারহীনতার এই বিধানটি বঙ্গবন্ধু হত্যার ২১ বছর পর তার সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে সংবিধানে সংশোধনী এনে সংবিধানকে কলঙ্কমুক্ত করেন কালো আইনটি বাতিলের মাধ্যমে।
দুঃখের বিষয়, এই একুশটি বছর দেশ যারা পরিচালনা করেছেন তাদের কারো বিবেক দংশিত হয়নি এই কালো আইনটি দেখে! বিচারপতি আব্দুস সাত্তার, জেনারেল এরশাদ এবং বেগম খালেদা জিয়ার সরকার এই একুশ বছর রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিলেন। একটি রাষ্ট্রের স্বাধীনতার স্থপতি, জাতির পিতাকে হত্যা করা হলো- তার হত্যাকারীদের বিচারের কোনো ব্যবস্থাই নেয়া যাবে না!
এমন কালো আইন সংবিধানে লিপিবদ্ধ থাকলে তা জাতি হিসেবে তাদের কোন আদিম বর্বর যুগে ঠেলে দেয়? এ প্রশ্ন কি তাদের কারো মনেই জাগেনি? নিশ্চিত করেই বলা যায়, জাগেনি। কারণ, যারা ক্ষমতায় ছিলেন তারা সকলেই পাকিস্তানি সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দর্শনের অনুসারী।
বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের পথ যারা রুদ্ধ করে রেখেছিলেন তারা দেশের যে সর্বনাশ করে গেছেন, তা কোনোদিন মোচন হবার নয়। ১৫ আগস্ট কোনো সরকারপ্রধানকেই হত্যা করা হয়নি, হত্যা করা হয়েছিল একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন আর আকাঙ্ক্ষাকেও। বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন একটি ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক মানবিক রাষ্ট্র, যেখানে থাকবে না কোনো অর্থনৈতিক বৈষম্য আর ধর্মীয় সহিংসতা। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের রাষ্ট্রে থাকবে না ধর্মের নামে রাজনীতি আর শোষণ-বঞ্চনার মতো পাকিস্তানি অভিশাপ। মানুষের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হবে।
লেখক: কবি ও সিনিয়র সাংবাদিক, সাবেক পরিচালক (বার্তা), বিটিভি।