তালেবানরা কাবুল দখলের একমাস পূর্তি হলো। এই একমাসে স্থিতিশীলতা তো আসেইনি, বরং গভীর অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে। আফগানিস্তান এগিয়ে যাচ্ছে গভীর অন্ধকারের দিকে। প্রথম তিন সপ্তাহ আফগানিস্তান চলেছে কোনো সরকার ছাড়াই। দখলের তিন সপ্তাহ পর ‘অন্তর্বর্তীকালীন’ নামে যে সরকার গঠিত হয়েছে তা অনিশ্চয়তাকে আরও বাড়িয়েছে। ২০ বছর আগের আর পরের তালেবান সরকার এক হবে না, শুরুর দিকে এমন কথা বলা হলেও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে তার কোনো প্রতিফলন নেই।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার কালো তালিকায় থাকা কট্টর তালেবানরাই ক্ষমতায় এসেছে। অন্তর্বর্তী সরকারে কোনো নারী সদস্য তো নেই-ই, নেই অন্তর্ভুক্তিমূলক সরকারের প্রতিফলনও। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মহলের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানোর ঘোষণা থাকলেও এখন পর্যন্ত তেমন কোনো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও পায়নি তালেবান সরকার। যেমন আশঙ্কা করা হয়েছিল, পাকিস্তানের আইএসআই আফগান সরকারের পেছনে কলকাঠি নাড়ছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দুই দশকের যুদ্ধে আফগানরা স্বর্গে ছিল তেমন নয়, আবার মার্কিন বাহিনীর বিদায়ে আফগানিস্তান স্বাধীন হয়ে গেছে তেমনও নয়। আফগানিস্তান আসলে ফুটন্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত উনুনে ঝাঁপ দিয়েছে। কট্টর তালেবানরা অস্ত্রের জোরে ক্ষমতা দখল করলেও আফগানদের ভাগ্য বদলায়নি। বরং তাদের অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা আফগানিস্তানে
ভয়ংকর মানবিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন। অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়েছে। শিগগিরই রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকটের কোনো যৌক্তিক সমাধান না হলে দেশটির ৯৭ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বিশ্বব্যাংক, আইএমএফসহ বিভিন্ন দাতা সংস্থা তাদের সাহায্য বন্ধ করে দিয়েছে। বেঁচে থাকার জন্য আফগানরা আক্ষরিক অর্থেই ঘটিবাটি বিক্রি করছে। কিন্তু সেই ঘটিবাটি কেনারও লোক নেই। আর ঘটিবাটি শেষ হলে তারপর তারা কী খাবে, তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। দারিদ্র্য আর দুর্ভিক্ষের নিষ্ঠুর থাবা যেভাবে ধেয়ে আসছে, তাতে আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত সবাই। দুবেলা খাওয়ার জন্য রুটি চাই, ভাত চাই; ধর্মের বুলিতে হতভাগা আফগানদের পেট ভরবে না। আর আফগানদের তালেবান ভীতিও আর আগের মতো নেই।
তালেবানদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ তো হয়েছেই, চলছে শান্তিপূর্ণ প্রতিরোধও। বন্দুকের মুখে দাঁড়িয়েও আফগান নারীরা তাদের অধিকারের কথা বলছেন। দাবির মুখে তালেবানরা কিছুটা ছাড়ও দিয়েছে, তবে নারী অধিকার, মানবাধিকার, খাদ্য, নিরাপত্তা, চিকিৎসাই তাদের প্রধান দাবি। ঘরে চুলা না জ্বললে অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে তালেবানরা আফগানদের ঘরে আটকে রাখতে পারবে না। দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া আফগানরা রাস্তায় নামলে তালেবানদের আফগান শাসনের স্বপ্ন ভেস্তে যেতে পারে।
এসবই আফগানিস্তানের ভেতরের সমস্যা। কিন্তু তালেবানশাসিত আফগানিস্তানই বিশ্বের জন্য একটা বড় বিষফোঁড়া। ২০ বছর আগের তালেবান শাসনের ভয়ংকর শাসনের স্মৃতি এখনও ভুলে যায়নি বিশ্ব। তালেবানরা বলছে, এবার তারা আফগানিস্তানের ভূমি জঙ্গিদের ব্যবহার করতে দেবে না। কিন্তু আরও অনেক আশ্বাসের মতো এটাতেও আস্থা রাখা যাচ্ছে না। আফগানিস্তান হলো জঙ্গিবাদের আঁতুড়ঘর আর তালেবানরাই এখন বিশ্ব জঙ্গিবাদের অঘোষিত নেতা। প্রকাশ্যে না হলেও তালেবানরা গোপনে জঙ্গিবাদকে মদদ দেবে না, এমনটা বিশ্বাস করার লোক কম। আর জঙ্গিবাদ হলো ধর্মীয় আদর্শের মোড়কে সন্ত্রাস। তাই বিশ্বের কোনো এক
প্রান্তে জঙ্গিবাদের উত্থান সব জঙ্গিদের অনুপ্রাণিত করে। আশির দশকে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের আমদানি হয়েছিল আফগানিস্তান থেকেই। রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে আফগানিস্তান যাওয়া জঙ্গিরা দেশে ফিরে স্লোগান ধরেছিল- ‘আমরা হবো তালেবান, বাংলা হবে আফগান।’ তাদের সে স্বপ্ন পূরণ হয়নি। কিন্তু স্বপ্ন তারা বিসর্জনও দেয়নি। অনেকদিন ধরেই তারা নানা ফর্মে, নানা ভাগে বাংলাদেশকে আফগানিস্তান বানানোর চেষ্টা করছে। জঙ্গিরা নানাভাবে তাদের শক্তিমত্তার জানান দিয়েছে।
২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট দেশের ৬৩ জেলায় একযোগে বোমা হামলা চালিয়ে জঙ্গিরা তাদের সামর্থ্যের জানান দিয়েছিল। আর ২০১৬ সালের ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজানে হামলার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ তার সামর্থ্যের শীর্ষ বিন্দু ছুঁয়েছিল। একই সঙ্গে সেই হামলাতেই তারা রোপণ করেছিল তাদের ধ্বংসের বীজ। হলি আর্টজানের পর সরকার জঙ্গিদের বিরুদ্ধে সত্যিকার অর্থেই জিরো টলারেন্স নিয়ে মাঠে নামে।
সরকারের সাঁড়াশি অভিযানে তছনছ হয়ে যায় বাংলাদেশের জঙ্গি নেটওয়ার্ক। জঙ্গি নেতাদের অনেকেই ধরা পড়ে, মারা যায় বা পালিয়ে যায়। আর নেতৃত্বহীন জঙ্গিরা ঢুকে পড়ে গর্তে। গর্তে ঢুকলেও তারা মরে যায়নি, আদর্শ বদলায়নি। শুধু সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। তালেবানদের কাবুল দখলের বাংলাদেশের জঙ্গি মহলে দারুণ চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে।
মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণার পর তালেবানরা যখন একের পর এক আফগান শহর দখল করছিল, তখন থেকেই বাংলাদেশে উগ্রবাদীদের মধ্যে উল্লাসের ঢেউ লেগেছিল। কাবুল দখলের পর সে উল্লাস আর গোপন থাকেনি। অনেকে বাংলাদেশেও আফগান পরিস্থিতি সৃষ্টির আশঙ্কাও ব্যক্ত করেছেন প্রকাশ্যে। তালেবানদের আফগান দখলকে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে তুলনা করেছেন অনেকে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই তালেবানপন্থি উগ্রবাদীদের সরব উপস্থিতি। তবে তালেবানদের আফগানিস্তান দখলের প্রভাব বাংলাদেশে স্রেফ উগ্রবাদীদের উল্লাসে সীমাবদ্ধ নেই, অনুপ্রাণিত করছে জঙ্গিবাদকেও। এমনটা যে হতে পারে, সে আশঙ্কা আগেই করা হচ্ছিল।
ঢাকার পুলিশ কমিশনারও এ আশঙ্কার কথা বলেছিলেন। গর্তে লুকিয়ে থাকা বাংলাদেশের জঙ্গিদের কেউ কেউ আফগানিস্তান যাওয়ার চেষ্টা করেছেন, কেউ হয়তো গিয়েছেন, কেউ পথে আটক হয়েছেন। বাংলাদেশের জঙ্গিরা হয়তো এখনও সরাসরি তালেবানদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেনি। তবে তালেবানদের উত্থানই তাদের গা ঝাড়া দিয়ে গর্ত থেকে বেরোনোর জন্য যথেষ্ট। এরইমধ্যে জঙ্গিদের নানারকম মুভমেন্টের খবর মিলছে।
এই সময়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে আটক হয়েছেন বেশ কয়েকজন জঙ্গি। বড় কোনো অপারেশনের জন্য অর্থ সংগ্রহ করতে জঙ্গিরা ব্যাংক, এনজিও বা স্বর্ণের দোকানে ডাকাতির প্রস্তুতি নিচ্ছিল। ময়মনসিংহ থেকে আটক চার জঙ্গির কাছ থেকে এমন তথ্য পেয়েছে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তাই নিশ্চিন্ত থাকার সুযোগ নেই। সদা সতর্ক থাকতে হবে।
বাংলাদেশের জঙ্গিবাদের সুবিধা-অসুবিধা দুটোই আছে। সুবিধাটা হলো ইদানীং জঙ্গিবাদের সমর্থক উগ্রবাদীদের সংখ্যা বেড়ে গেছে। এটা তাদের ঢাল হতে পারে। আর জঙ্গি তৎপরতা চালাতে খুব বেশি অর্থ বা লোক লাগে না। ৭০টা হুরের লোভ দেখিয়ে ব্রেইন ওয়াশ করে হাতে বোমা দিয়ে ছেড়ে দিলেই হলো। এমনকি একজন আত্মঘাতী জঙ্গিও অনেক ভয়ংকর হতে পারে। জঙ্গিবাদে লোন উলফ, স্লিপার সেলের ধারণাও প্রচলিত।
তবে বাংলাদেশে জঙ্গিদের সুবিধার চেয়ে অসুবিধাই বেশি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উগ্রবাদীদের কিছু উল্লাস চোখে পড়লেও সাধারণভাবে বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ মানুষ জঙ্গি বা উগ্রবাদকে পছন্দ করে না। তাই সমাজে তারা কখনোই ঠাঁই পায়নি, পাবেও না। এটা একটা বড় অসুবিধা।
আরেকটা অসুবিধা হলো নেতৃত্বহীনতা ও সিদ্ধান্তহীনতা। সবচেয়ে বড় অসুবিধা হলো সরকার। একসময় বাংলাদেশে রাষ্ট্রযন্ত্রের আনুকূল্যে জঙ্গিবাদের বিস্তার ঘটেছে। কিন্তু বর্তমান সরকার বরাবরই জঙ্গিদের ব্যাপারে কঠোর। বিশেষ করে হলি আর্টিজানের পর থেকে একদম জিরো টলারেন্স। তালেবানদের আফগান দখলের পর থেকে সরকার আবার সতর্ক অবস্থানে। এরইমধ্যে বেশ কয়েকটি অভিযানে মাথাচাড়া দিতে চাওয়া জঙ্গিরা ধরা পড়েছে। তার মানে গর্ত থেকে মাথা বের করলেই ধরা পড়তে হবে। তবে জঙ্গিদের গর্তে রেখেও নিশ্চিন্ত থাকা যাবে না। এদের শিকড় উপড়ে ফেলতে হবে। তাই চাই, সরকারের জঙ্গিবিরোধী সর্বাত্মক অভিযান ও সমন্বিত চেষ্টা।
তালেবানের আফগান দখলের পর একটু মাথাব্যথা হলেও শঙ্কিত হওয়ার মতো কিছু নেই। তবে সতর্ক থাকতে হবে।
লেখক: সাংবাদিক, কলাম লেখক।