বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কি আধিপত্যের নীতি থেকে সরছে

  • হীরেন পণ্ডিত   
  • ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ১৬:৫৭

অভিযুক্ত আল-কায়দার মতো সংগঠনের মার্কিন মাটিতে সফল হামলা চালানোর ক্ষমতার অধিকারী সংগঠনগুলো হয়তো হ্রাস পেয়েছে, বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে বা দুর্বল হয়ে গেছে। কিন্তু অনুরূপ মতাদর্শী সহানুভূতিশীল গোষ্ঠী বিশ্বের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়েছে, বিশেষ করে আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য এবং এশিয়ার মধ্যে- বলছেন বিশ্লেষকরা।

সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ হলো যুক্তরাষ্ট্র ও এর অন্যান্য মিত্র দেশের সূচিত একটি যুদ্ধাভিযান যার দৃশ্যত উদ্দেশ্য হলো সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোকে অপসারণ করা ও যেসব দেশ সন্ত্রাসবাদের পৃষ্ঠপোষকতা করে তাদেরকে শাস্তি দেয়া। এটি বর্তমানে শীতল।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সময়সীমা নির্ধারণ করেছিলেন যে, ২০২১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর মার্কিন সৈন্যদের আফগানিস্তান থেকে প্রত্যাহার করা হবে। এর আগে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট থাকার সময় তালেবানদের সঙ্গে চুক্তিতে পৌঁছেছিলেন যে, ২০২১ সালের মে মাসে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সৈন্যদের প্রত্যাহার করা হবে।

১১ সেপ্টেম্বর-পরবর্তী বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির কথা তুলে ধরতে গিয়ে প্রেসিডেন্ট বাইডেন বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রকে তার ভুল থেকে শিক্ষা নিতে হবে এবং কোনো যুদ্ধে যাওয়ার আগে পরিষ্কার লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে। তবে জাতি কিংবা রাষ্ট্র গঠনে তার দেশ আর জড়িত হবে না।

প্রেসিডেন্ট বাইডেন বলেছেন, তিনি স্থলযুদ্ধ পরিহার করবেন। কোনো দেশে বিশাল সৈন্য বাহিনী মোতায়েনের পরিবর্তে তিনি জোর দেবেন কূটনীতি ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ওপর। বিশেষ করে চীন ও রাশিয়ার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, হুমকি মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্রকে এখন অর্থনৈতিক ও সাইবার নিরাপত্তার প্রতিযোগিতাকে গুরুত্ব দিতে হবে। তিনি মনে করেন, বিশাল সৈন্য বাহিনী পাঠিয়ে, যেমনটা আফগানিস্তানে করা হয়েছে, সেরকম না করে বরং সামরিক প্রযুক্তির সাহায্যে সন্ত্রাসীদের মোকাবিলা করতে হবে।

২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর মাত্র ১০২ মিনিটের মধ্যে ঘটে যায় বিশ্বের ভয়াবহ ঘটনা। সেদিন আধুনিক ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলায় নিহত হয় প্রায় তিন হাজার মানুষ। এর পরেই শুরু হয় আফগানিস্তানে যুদ্ধ, যাতে সময় লেগেছে ১৯ বছর, ১০ মাস, তিন সপ্তাহ দুই দিন।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের হিসাব মতে, এই যুদ্ধে মারা গেছে কমপক্ষে ২ হাজার ৩২৫ আমেরিকান সৈন্য। ঠিক কতজন বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছে তা কেউ জানে না।

২০২১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সেই ট্র্যাজেডি যার যন্ত্রণার আগুনে সূচনা হয়েছিল আমেরিকার দীর্ঘতম যুদ্ধ, একটি সমাপ্তি টানার চেষ্টা করবেন এবং শ্রদ্ধা জানাবেন তিনটি স্থানে। ভয়েস অব আমেরিকার খবরে এমনটা বলা হয়েছে।

যাকে বলা হতো সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বৈশ্বিক যুদ্ধ, মধ্য এশিয়ার ছোট দেশ আফগানিস্তান ছাড়িয়ে ইরাকে পৌঁছে যায়, এমনকি বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে, দূর-দুরান্ত আফ্রিকা পর্যন্ত এর বিস্তৃতি ঘটে। ইরাকে এই সংঘাতে প্রায় ৪ হাজার ৫০০ আমেরিকান সেনাসদস্য এবং লাখ লাখ বেসামরিক লোক নিহত হয়েছে। আগস্টের শেষ নাগাদ আফগানিস্তান থেকে সব সৈন্য প্রত্যাহারের পর থেকে বাইডেন প্রশাসন গত ২০ বছরকে পিছনে ফেলে আসার জন্য বেশ কিছু চূড়ান্ত পদক্ষেপ নিয়েছে। ১১ সেপ্টেম্বরের ঘটনাবলির ওপর আলোকপাত করতে পারে এমন কিছু নথিপত্রকে গোপনীয়তামুক্ত করেছে এবং আমেরিকানদের প্রত্যাহারের পর আফগানিস্তানে ক্ষমতা দখলকারী তালেবান সরকার থেকে দূরত্ব বজায় রেখে পর্যবেক্ষণ করছে।

৯/১১-এর তিনটি জায়গা পরিদর্শন করবেন বাইডেন যেখান থেকে এই মারাত্মক স্ফুলিঙ্গের সূচনা : নিউইয়র্ক সিটি, যেখানে সেপ্টেম্বরের রৌদ্রোজ্জ্বল সকাল ৮:৪৬ মিনিটে আমেরিকান এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট-১১ ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের উত্তর টাওয়ারে বিধ্বস্ত হয়েছিল এবং ঠিক ১৭ মিনিট পর ইউনাইটেড এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট-১৭৫ দক্ষিণ টাওয়ারে আঘাত হানে।

বাইডেন পেন্টাগনও পরিদর্শন করবেন, যেখানে নিউইয়র্কের ঘটনার ঠিক ৩৪ মিনিট পর আমেরিকান এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট ৭৭ বিধ্বস্ত হয়েছিল। পৃথকভাবে, তিনি এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস পেনসিলভেনিয়ার শ্যাঙ্কসভিলের মাঠে যেখানে ইউনাইটেড এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট-৯৩ বিধ্বস্ত হয় সেখানে শ্রদ্ধা জানাবেন।

২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্ক ও পেন্টাগনে সন্ত্রাসী হামলার পর যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ ডাবলিউ বুশ প্রতিজ্ঞা করেছিলেন আল-কায়দা ও অন্যান্য কথিত সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর মূলোৎপাটন করবেন। ২০ বছর পর, যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ইরাক ও আফগানিস্তান যুদ্ধের হিসাব কষলে দেখা যায়, কয়েক লাখ বেসামরিক লোক নিহত হন, কয়েক ট্রিলিয়ন ডলার খোয়া গেছে যুক্তরাষ্ট্রের।

অথচ এখনও হামলার হুমকিতে রয়েছে দেশটি। যদিও ২০০১ সালের পর থেকে ২০ বছর পর যুক্তরাষ্ট্র অন্যভাবে ব্যাখ্যা করছে বিষয়টিকে। বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর গণহত্যার কৌশল অনেকটা স্তিমিত হয়ে পড়েছে। তা সত্ত্বেও অভ্যন্তরীণ শক্তি পুরোপুরি সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলার মতো সামর্থ্য অর্জন করতে পারেনি যুক্তরাষ্ট্র। অভিযুক্ত আল-কায়দার মতো সংগঠনের মার্কিন মাটিতে সফল হামলা চালানোর ক্ষমতার অধিকারী সংগঠনগুলো হয়তো হ্রাস পেয়েছে, বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে বা দুর্বল হয়ে গেছে। কিন্তু অনুরূপ মতাদর্শী সহানুভূতিশীল গোষ্ঠী বিশ্বের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়েছে, বিশেষ করে আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য এবং এশিয়ার মধ্যে- বলছেন বিশ্লেষকরা।

আল-কায়দার বহু নেতা ৯/১১-এর পর যুক্তরাষ্ট্রের টার্গেটে পরিণত হয় এবং সবশেষ পাকিস্তানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভিযানে ২০১১ সালে নিহত হয় ওসামা বিন লাদেন। তবে এখনও আল-কায়দা সক্রিয় রয়েছে ১৭টির মতো দেশের সহযোগী গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে।

দ্য কাউন্সিল ফর ফরেন রিলেশনসের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড হোমল্যান্ড সিকিউরিটির সিনিয়র ফেলো বরেস হফম্যান বলেন, ‘আমরা যদি ২০ বছরের কথা বলি তাহলে আমরা যে অঞ্চলে সন্ত্রাসী হুমকি মনে করে প্রতিরোধ করি ঠিক অন্য অঞ্চলে তা আবার ছড়িয়ে পড়ে।’ তিনি আরও বলেন, কঠিন হলেও সত্য যে গোটা বিশ্ব, এমনকি যুক্তরাষ্ট্র, নিরাপত্তার ঝুঁকি টের পাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, দুর্ভাগ্যের বিষয় যে, আমরা এখন অতটা নিরাপদে নেই। এখনও যুক্তরাষ্ট্রের ওপর বিভিন্ন ধরনের হুমকি আসছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা, তারা বিশ্বের কোথাও একত্রে নেই, সন্ত্রাসীদের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে তাদের প্রতিরোধ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। ৯/১১-এর পর সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর বড় হামলার শক্তি ক্ষয় হয়েছে কিন্তু তারা বুশের ‘সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর’ নাম ঘোচাতে চায় এবং সেটিই কৌশলে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক এবং ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের ডিরেক্টর অব ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটি, সেথ জি জোন্স বলেছেন, ২০০১ সালের পর তারা এখন ভিন্ন জায়গা বেছে নিয়েছে।

সম্প্র্রতি যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারের পর তাদের নেটওয়ার্ক আরও বাড়ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা আগেই সতর্ক করেছিলেন যে, যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার করলে এবং তালেবান ক্ষমতা নেয়ার পর আবারও যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী গোষ্ঠীগুলো সামর্থ্য অর্জন করবে যেটা গত কয়েক বছরে হয়নি। ফলে আধিপত্যকারী যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তার বিষয়টি আবারও ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে।

৯/১১ হামলা নামে পরিচিত ওই সন্ত্রাসী হামলার পর পরই যুক্তরাষ্ট্রে ভুক্তভোগীদের সহায়তার জন্য একটি তহবিল গঠন করা হয়। পরে ২০১১ সালে এসে খোলা হয় আরেকটি তহবিল। সেখান থেকে ৯/১১-এর হামলার জেরে যাদের শারীরিক জটিলতা দেখা দিয়েছে, তাদেরও সহায়তা দেয়া হচ্ছে। এখন পর্যন্ত ‘দ্য সেপ্টেম্বর ১১ ভিকটিম কমপেনসেশন ফান্ড (ভিসিএফ)’ নামের এই তহবিলে সাহায্যের আবেদন এসেছে ৬৭ হাজারের বেশি।

ভিসিএফের তথ্য অনুযায়ী, ৬৭ হাজার আবেদনের মধ্যে প্রায় ৩ হাজার ৯০০ আবেদন এসেছে ৯/১১-এর হামলার পরে মৃত ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে। সেদিনের সন্ত্রাসী হামলার কারণে সৃষ্ট নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগে তাদের মৃত্যু হয়েছে বলে পরিবারগুলোর পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে। এ নিয়ে ভিসিএফের শীর্ষ কর্মকর্তা রূপা ভট্টাচার্য বলেছেন, দেখা যাচ্ছে ৯/১১-এর সন্ত্রাসী হামলায় যাদের মৃত্যু হয়েছিল, তাদের চেয়ে হামলাসংশ্লিষ্ট নানা অসুস্থতায় ভুগে মৃত্যুর সংখ্যাটা বেশি।

গেল বছরগুলোয় যারা ভিসিএফের কাছে সাহায্যের আবেদন করেছেন, তাদের ৫০ শতাংশই ক্যানসারের রোগী বলে জানা গেছে। ভিসিএফ বলছে, এখন পর্যন্ত ৪০ হাজারের বেশি মানুষকে ৮ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি আর্থিক সহায়তা দেয়া হয়েছে। এ আর্থিক সহায়তা প্রমাণ করে তাদের অভ্যন্তরীণ আর্থিক সংকটটা কত জোরালো। এসব সামগ্রিক বিচারে মনে হতেই পারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের পররাষ্ট্রনীতিতে অলিখিতভাবে নমনীয় হয়েছে। বলা যায় অতীতের সাম্রাজ্যবাদী ও আধিপত্য মানসিকতা থেকে একটু সরে এসেছে বা সংকুচিত করেছে।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও রিসার্চ ফেলো, বিএনএনআরসি

এ বিভাগের আরো খবর