বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

আমেরিকা, তালেবান ও চায়না

  •    
  • ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ১৩:২৪

চায়না সরকারের মুখপত্র গ্লোবাল টাইমসও জানিয়েছে, চায়না আফগানিস্তানে জরুরি আর্থিক সাহায্যসহ অন্যান্য সাহায্য দিতে যাচ্ছে। তারা এ মুহূর্তে ৩০ লাখ কোভিড-১৯ টিকা, কিছু খাদ্য ও ৩১ মিলিয়ন ডলার সাহায্য দিতে যাচ্ছে আফগানের তালেবান সরকারকে। আর চায়নার কাছে এখন এই তালেবান গুড তালেবান। যতটা গুড ইরানের কাছেও নয়। ইরান তাদের জন্য বর্ডার লাইন দিয়ে দিয়েছে। তারা জানিয়ে দিয়েছে তালেবান সরকারে সব আফগান নৃগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব না থাকলে তাদের পক্ষে সেই সরকারকে সহয়তা করা সম্ভব নয়। অথচ তালেবানের কেয়ারটেকার সরকার গড়া থেকেই স্পষ্ট হয়েছে তারা সেদিকে যাচ্ছে না।

সকাল ৮টা ৪০ মিনিটে আমেরিকান এয়ারলাইনস-১১ যখন টুইন টাওয়ারের নর্থ টাওয়ারে আঘাত করে, সে সময়ে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বুশ একটি স্কুলের বাচ্চাদের সামনে। তাকে কানে কানে এ সংবাদ দেয়া হলে তার প্রথম মন্তব্য ছিল, পাইলট কি ড্রাঙ্ক ছিলেন? কিন্তু এর ১৭ মিনিট পরেই অর্থাৎ ৯টা ০৩ মিনিটে ইউনাইটেড এয়ারলাইনস ফ্লাইট-১৭৫ সাউথ টাওয়ারকে আঘাত করে দ্রুত বিধ্বস্ত করে দেয়। আর ৯টা ৩০ মিনিটে আমেরিকান এয়ারলাইনস ফ্লাইট-৭৭ আঘাত করে পেন্টাগনকে। অর্থাৎ সব আঘাত করতে সময় নেয় মাত্র ৫০ মিনিট। আর এই শেষের দুটি আঘাতের পরেই প্রেসিডেন্ট বুশকে বলা হয়, আমেরিকা আন্ডার অ্যাটাক। বুশও পরবর্তী তার ভাষণে একই কথা বলেছিলেন।

বাস্তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে আমেরিকার ওপরে এটাই ছিল সব থেকে বড় কোনো আঘাত। যে আঘাতে ২ হাজার ৭৫০ জন সিভিলিয়ান মারা যান টুইন টাওয়ারে। পেন্টাগনে মারা যান ১৮৪ জন। পেনসিলভেনিয়া থেকে জঙ্গিরা আরও একটি প্লেন হাইজ্যাক করার চেষ্টা করে। যাত্রীদের কাউন্টার আক্রমণে সেটা ব্যর্থ হলেও সেখানে ৪০ জন সিভিলিয়ান মারা যান। আর টুইন টাওয়ার ও পেন্টাগনের আগুন নেভাতে এবং মানুষ বাঁচানোর চেষ্টা করতে গিয়ে ফায়ার ফাইটার মারা যান ৩৪৩ জন।

আমেরিকার ওপর এই যে এত বড় আঘাত করা হয়, এর কোনো চিহ্নিত শত্রু ছিল না। চিহ্নিত কোনো দেশ বা তাদের সেনাবাহিনী আমেরিকা আক্রমণ করেনি। এই শত্রু দৃশ্যত অদৃশ্য। আর এই অদৃশ্য শত্রুর মূল শত্রু আমেরিকা মনে করে আফগানিস্তানের তৎকালীন তালেবান সরকার ও তাদের আদর্শিক নেতা ওসামা বিন লাদেনকে।

অবশ্য গত ২০ বছরে আমেরিকা এই শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুধু তালেবান ও লাদেনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেনি; তারা ইরাক আক্রমণ করেছে সেখানে বায়োলজিক্যাল অস্ত্র আছে বলে। সন্ত্রাসবাদের হোতা বলে আক্রমণ করেছে ইরাক ও লিবিয়া। সাদ্দাম ও গাদ্দাফি সরকার শুধু উৎখাত হয়নি। তাদের করুণ মৃত্যু হয়েছে। অপরদিকে লাদেনকে হত্যা করা হয়েছে নাটকীয় এক অপারেশনে পাকিস্তানের সামিরক ঘাঁটি অ্যাবোটাবাদের এক সুরক্ষিত বাড়িতে কমান্ডো আক্রমণ চালিয়ে।

আমেরিকা তাদের ৯/১১-এর মূল শত্রু বলে যাকে চিহ্নিত করেছিল, সেই লাদেনকে তাদেরই বন্ধু পাকিস্তানের ভেতরই সুরক্ষিত স্থানে পায়; এবং পাকিস্তানকে না জানিয়ে তাকে হত্যা করে। আমেরিকার অনেক নিরাপত্তা বিশ্লেষকের মতে, পাকিস্তানকে জানালে তারা লাদেনকে হত্যা করতে পারত না। তালেবান পাকিস্তানের সহায়তায় আমেরিকারই সৃষ্টি।

সোভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য আমেরিকা উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হয়েও কোনো উদার রাজনৈতিক শক্তিকে আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসনের প্রতিরোধ গড়ে উঠতে সাহায্য করেনি, বা তেমন কোনো শক্তি তারা গড়ে তোলেনি। তারা পাকিস্তানের সহায়তায় একটি ধর্মান্ধ জঙ্গিগোষ্ঠী সেখানে গড়ে তোলে। আর সেই জঙ্গিরাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে আমেরিকায় সব থেকে বড় আঘাত করে। সেই আঘাতের পরে তারা জঙ্গি তালেবানদের বিরুদ্ধে করে যুদ্ধ ঘোষণা। গত ২০ বছর ধরে তারা এ যুদ্ধ করে চলতি বছর আগস্টে আফগানিস্তান তালেবানের হাতে ছেড়ে দিয়ে চলে গেছে।

বাস্তবে তালেবানের দুই স্রষ্টা অর্থাৎ আমেরিকা ও পাকিস্তানের ভূমিকা এখানে বেশ রহস্যজনক। পাকিস্তান আমেরিকার ঘনিষ্ঠ মিত্র হলেও তারা কখনও তালেবানকে ত্যাগ করেনি। তাদের দেশের সীমান্তে গত ২০ বছর ধরে বেড়ে উঠতে দিয়েছে তালেবানকে। এবার আফগানিস্তানে যেখানে তালেবানরা বেশ বড় বাধার সামনে পড়েছিল, সেখানে পাকিস্তান তাদের সাহায্য করেছে প্রত্যক্ষভাবে। পাকিস্তানি সৈন্যরা তালেবানদের সঙ্গে মিশে পানশিরে তালেবানবিরোধীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তালেবানকে জয়লাভ করতে সাহায্য করেছে।

অপরদিকে গত ২০ বছর আমেরিকার আফগানে জাতি ও দেশ গঠন করার কাজ করেছে বলে দাবি করছে। অথচ তারা কি জানত না ওই একই সময়ে পাকিস্তান হাজার হাজার তালেবানকে ট্রেনিং দিচ্ছে? তাদের সেনাবাহিনী নিয়মিত এ কাজ করছে। তাহলে সেটা কি আমেরিকা মেনে নিত? শুধু এই নয়, আফগানিস্তানের তালেবান সরকার আমেরিকা ২০০১-এ উৎখাত করে ঠিকই, তবে তাদের পরবর্তী কোনো সঠিক পরিকল্পনা ছিল বলে মনে হয় না। আর এই ২০ বছর পরে তালেবানদের ফিরে আসা থেকে সেটা আরও স্পষ্ট হয়। আমেরিকার এই সঠিক পরিকল্পনা না থাকা সত্যিই রহস্যময় ও আশ্চর্যজনক! অথচ তারা প্রায় তিন ট্রিলিয়ন ডলার আফগানিস্তানে খরচ করে গেছে।

অপরদিকে এবার আফগানিস্তানে যে তালেবানরা সরকার গঠন করেছে ও করতে যাচ্ছে, তাদের শুরুতে বলা হলো ‘গুড তালেবান’। তালেবান আবার গুড ও ব্যাড হয় কি না, এর উত্তর আমেরিকা ৯/১১-এ নিহতদের পরিবারের সদস্যদের কাছে জিজ্ঞাসা করলে সঠিক জবাব জানতে পারবে। তবে এবারের তালেবানও যে আগের তালেবান- তার প্রমাণ তারা ধীরে ধীরে রাখতে শুরু করেছে। তারা যে কেয়ারটেকার সরকার গঠন করেছে, সেখানে তাদের সেই পুরোনো লোকজনই আছে। তাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এফবিআইয়ের মোস্ট ওয়ান্টেড ব্যক্তি এখনও।

তার কাছে এখনও অন্তত একজন আমেরিকান হোস্টেজ আছে। তা ছাড়া তারা নারী অধিকার মেনে নেবে বললেও এখন দেখা যাচ্ছে নতুন বোতলে সেই পুরোনো মদ। অর্থাৎ ইতোমধ্যে তারা মেয়েদের ক্রিকেট খেলা নিষিদ্ধ করেছে। নিষিদ্ধ করতে যাচ্ছে মেয়েদের অন্যান্য খেলাও। সাংবাদিকদের ওপর আগের মতোই চড়াও হচ্ছে। তা ছাড়া তারা তাদের ব্যাখ্যা অনুযায়ী শরিয়াহ আইন চালু করতে যাচ্ছে। যা আগের মতোই নারীদের সব ধরনের অধিকার কেড়ে নেবে।

তালেবান যত একটার পর একটা খোলস ছাড়ছে, ততই পশ্চিমারা তাদের থেকে দূরে চলে যাচ্ছে। সব থেকে কঠিন কথা বা আমেরিকার ভবিষ্যৎ অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিয়ে সঠিক কথা বলেছেন ৯ তারিখে কুয়েতে সফররত অবস্থায় পেন্টাগনপ্রধান বা আমেরিকার ডিফেন্স মিনিস্টার। তিনি বলেছেন, জঙ্গিরা আবার আফগানিস্তানে সংগঠিত হবে। তারা যেকোনো মুহূর্তে জঙ্গি হামলা চালাতে পারে।

অর্থাৎ আবার হিউম্যান বোম হয়ে আরেকটি ৯/১১ তারা ঘটাতে পারে। অবশ্য আগে একসময়ে যেমন এই তালেবান আমেরিকার সাহায্য পেয়ে মাটিতে পা রেখেছিল, এবারও তাদের পাশে থাকছে আরেকটি বড় শক্তি। তালেবান মুখপাত্র জবিউল্লাহ মুজাহিদ ইতালিসহ ইউরোপের কটি নিউজ পেপারকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেছে, চায়না এখন তাদের মূল অংশীদার, অর্থনৈতিকভাবে চায়না এখন তাদের সাহায্য করবে। এমনকি পৃথিবীর যে অর্ধেক কপার আফগানিস্তানের ভূমির নিচে আছে, তা উত্তোলনের মূল দায়িত্ব পালন করবে চায়না।

চায়না সরকারের মুখপত্র গ্লোবাল টাইমসও জানিয়েছে, চায়না আফগানিস্তানের জরুরি আর্থিক সাহায্যসহ অন্যান্য সাহায্য দিতে যাচ্ছে। তারা এ মুহূর্তে ৩০ লাখ কোভিড-১৯ টিকা, কিছু খাদ্য ও ৩১ মিলিয়ন ডলার সাহায্য দিতে যাচ্ছে আফগানের তালেবান সরকারকে। আর চায়নার কাছে এখন এ তালেবান গুড তালেবান। যতটা গুড ইরানের কাছেও নয়। ইরান তাদের জন্য বর্ডার লাইন দিয়ে দিয়েছে। তারা জানিয়ে দিয়েছে তালেবান সরকারে সব আফগান নৃগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব না থাকলে তাদের পক্ষে সেই সরকারকে সহয়তা করা সম্ভব নয়। অথচ তালেবানের কেয়ারটেকার সরকার গড়া থেকেই স্পষ্ট হয়েছে, তারা সেদিকে যাচ্ছে না।

অবশ্য চায়না তাদের জন্য কোনো রকম বিধিনিষেধ রাখেনি। আর চায়নার আরেক বন্ধু পাকিস্তান ইতোমধ্যে পানশিরে তালেবানের সঙ্গে মিলে যুদ্ধ করেছে। এর অর্থ এবারের তালেবানের বন্ধু হতে যাচ্ছে চায়না ও পাকিস্তান। উজবেকসহ রাশিয়া না বুঝে পা ফেলবে না, তা এখন অবধি স্পষ্ট। চায়নার এই তালেবানকে অবাধ লাইসেন্স দেয়ার প্রথম উদ্দেশ্য আমেরিকাকে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিয়ে ব্যস্ত রাখা।

শুধু তা-ই নয়, তাদের বর্তমানের দক্ষিণ এশিয়ার সব থেকে বড় শত্রু ভারতের অভ্যন্তরীণ নিরপত্তা যাতে হুমকির মুখে পড়ে, সেটাও চায়নার আরেক লক্ষ্য। আর তালেবানের কথার ভেতর তার প্রতিধ্বনিও পাওয়া গেছে। কাশ্মীরের ভারত অংশ নিয়ে চায়না ও পাকিস্তানের যে অবস্থান, তালেবান মুখপাত্র ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সেই কথাই বলেছে।

আর ভারতের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা যদি তালেবান জঙ্গিদের পৃষ্ঠপোষকতায় হুমকির মুখে পড়ে, বাংলাদেশও তার বাইরে থাকবে না। এ ছাড়া বাংলাদেশে হেফাজত, জামায়াত ও বিএনপির একটি অংশ তালেবানদের অনুসারী। তার ওপরে রয়েছে রোহিঙ্গাদের ওপর পাকিস্তানের এক ধরনের নিয়ন্ত্রণ। তাদের অনেককেও এ কাজে ব্যবহার করা হবে বলে রোহিঙ্গা শিবির নিয়ে যারা সব সময়ই কাজ করেন, তাদের অনেকে মনে করছেন।

তাই ৯/১১-এর ২০ বছরে এসে কি চায়নার সহযোগিতায় আবার পৃথিবী ছোট-বড় অনেক ৯/১১-এর আশঙ্কার ভেতর ঢুকে যাচ্ছে?

এ বিভাগের আরো খবর