কিশোর অপরাধ আমাদের সমাজের নতুন কোনো ঘটনা নয়। চালের মধ্যে যেমন কাকর, মরা চাল থাকে, সমাজের সুস্থ কিশোর-তরুণদের মধ্যেও দুচারজন বিপথগামী হিংস্র স্বভাবের থাকতে পারে। আমাদের শৈশব-কৈশোরেও আমরা এরকম বখাটে কিশোর দেখেছি। আতঙ্কিত হইনি। কারণ তারা সংখ্যায় এতই নগণ্য ছিল যে, তাদের নিয়ে সমাজের কোনো মাথাব্যথা ছিল না। গণমাধ্যমেরও এ নিয়ে প্রধান শিরোনাম করার দরকারও পড়ত না। কেননা তারা পাড়া-মহল্লায় কোনো অঘটন ঘটালেও তা পিলে চমকানোর মতো ভয়ংকর কোনো ঘটনার সৃষ্টি করেনি।
সাম্প্রতিককালে কিশোর অপরাধীদের নৃশংস আচরণ এমন ভয়াবহভাবে বিস্তৃত হয়েছে যে, তা এখন আর পাড়ার বখাটে ছেলেটির বখাটেপনায় সীমাবদ্ধ নেই, তারা এখন এমনই সংঘবদ্ধ, অবৈধ অস্ত্র রাখা, ঠান্ডা মাথায় খুন-খারাবির মতো যেকোনো ভয়ংকর অঘটন ঘটিয়ে ফেলে অনায়াসে। ফলে এসব ঘটনায় আতঙ্কিত না হয়ে উপায় নেই। এমনকি সংবাদপত্রের প্রধান শিরোনামও হয়ে উঠছে এসব কিশোর অপরাধীর ভয়ংকর তাণ্ডব।
দেশের একটি প্রথম শ্রেণির দৈনিকে গত ৩ সেপ্টেম্বরের প্রথম পৃষ্ঠায় শিরোনাম হয়েছে এদের অপরাধ। সংঘবদ্ধ কিশোর- অপরাধীদের ভয়াবহ নৃশংসতার বিস্তারিত বিবরণও প্রকাশিত হয়েছে। ওই রিপোর্টে কয়েক বছরের কিশোর অপরাধ তথা কিশোর গ্যাংয়ের অস্ত্রবাজিসহ পরিস্থিতির ভেতর বাহির উন্মোচিত হয়েছে। অতি তুচ্ছ ঘটনায় নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনাবলিও তুলে ধরা হয়েছে। ‘বড়দের আশকারায় ছোটরা ভয়ংকর’ শিরোনামের ওই প্রতিবেদন পড়ে আতঙ্কে চমকে উঠেছি।
কোথায় চলেছে আমাদের তরুণ প্রজন্ম! শুধু ঢাকা মহানগরের যে চিত্র পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে এসেছে তাই তো ভয়ংকর! খোদ রাজধানীতেই কিশোর গ্যাংয়ের ২৩০ সদস্য পুলিশের তালিকাভুক্ত। সারা দেশে সক্রিয় কয়েক হাজার! শুধু তাই নয়, কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণকে বড় চ্যালেঞ্জ বলেই বিবেচনা করছে পুলিশ।
দৈনিকটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে-
“কিশোরদের মধ্যে অপরাধ নতুন না হলেও পুলিশ সদর দপ্তরের রেকর্ড বলছে সংঘবদ্ধভাবে কিশোরদের অপরাধ সংঘটনের বিষয়টি তাদের নজরে আসে ২০১২ সালে। ওই বছর সারা দেশে ৪৮৪ মামলায় আসামি ছিল ৭৫২ শিশু-কিশোর। ২০১৭ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়, সারা দেশেই কিশোর গ্যাংয়ের অপতৎপরতা বাড়ছে। এরপর গত প্রায় পাঁচ বছরেও কিশোর গ্যাংগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়নি। বরং দিনকে দিন তারা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।’
পুলিশের মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদ সারা দেশের আইনশৃঙ্খলা নিয়ে গত ১১ জানুয়ারি এক বৈঠকে বলেছিলেন, পুলিশের জন্য এই কিশোর গ্যাং বা কিশোর অপরাধীরাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এখন।
কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রের গত বছরের শেষের দিকের তথ্য অনুযায়ী তখন পর্যন্ত দেশের কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রগুলোতে যেসব কিশোর ছিল, তাদের মধ্যে ২০ শতাংশ হত্যামামলার আসামি আর ২৪ শতাংশ নারী-শিশু নির্যাতন ও মাদক মামলার আসামি। বর্তমানে তা বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।”
নিঃসন্দেহে এই তথ্য ভয়বহ পরিস্থিতির ইঙ্গিত দিচ্ছে। একটি দেশের ভবিষ্যতের স্বপ্ন শিশু-কিশোর। সেই স্বপ্ন দেখবার মতো প্রজন্ম যদি এভাবে নষ্ট হয়ে যায়, সন্ত্রাসী হয়ে ওঠে, মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে, অবৈধ অস্ত্র তাদের হাতে চলে যায়, সামান্য কথা কাটাকাটিতে খুন-খারাবি করে বসে, নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা শুরু করে, তাহলে সেই প্রজন্মের পরিণাম কী আর দেশেরই বা ভবিষ্যৎ কী!
গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর মিরপুরের দারুসসালাম এলাকায় একটি হাসপাতালের সামনে সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্বে ছুরিকাঘাতে তিন শিক্ষার্থী আহত হয়েছে। ১৫ কিশোরকে আসামি করে মামলা হয়েছে। এই ঘটনার পর জানা গেছে ওই এলাকায় তিনটি কিশোর গ্যাং রয়েছে। তাদের রয়েছে কয়েকজন ‘বড় ভাই’!
এই ‘বড় ভাই’দের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েই শিশু-কিশোররা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে রাজধানীসহ সারা দেশে। এ প্রসঙ্গে দারুস সালাম থানার ওসির বক্তব্য উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনি ঘটনার বিবরণ দিয়ে বলেছেন, ‘বর্তমানে কেউ কাউকে মানে না। অভিভাবকরাও তাদের সন্তানকে ঠিকমতো নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না। আমরা নিয়মিত বিট পুলিশিংয়ের মাধ্যমে অভিভাবকদের পাশাপাশি তরুণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে এই সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছি। এরপরও শুধু পুলিশের পক্ষে সমস্যা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। সমাজের সবার দায় আছে।’ এই প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে বখে যাওয়া কিশোর সন্তানদের অপকর্মের জন্য অভিভাবকদেরকেও আইনের আওতায় আনার কথা বিবেচনা করা হচ্ছে।
অভিভাবক এবং জনপ্রতিনিধিরাও স্বীকার করেছেন, তারা সন্তানদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না। অনেক কিশোর মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে। শিশু-কিশোরদের সুষ্ঠু পরিবেশ দিতে ব্যর্থ হচ্ছেন এলাকার জনপ্রতিনিধিরাও।
রাজধানীর মিরপুর, মোহাম্মদপুর থেকে শুরু করে উত্তরা টু কোতোয়ালি পর্যন্ত রাজধানীজুড়েই কিশোর গ্যাং অপসংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। এই চিত্র ঢাকার বাইরেও দৃশ্যমান। সংক্রামক ব্যাধির মতোই তা সারা দেশে সংক্রমিত হয়ে গেছে। কিন্তু কেন এই গ্যাং কালচার! কোথায় এর সমাধান, তা নিয়ে ভাবতে হবে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে। কিশোরদের মধ্যে যেভাবে দিনকে দিন অপরাধপ্রবণতা বাড়ছে তাতে বিবেকবান মানুষমাত্রই আতঙ্কিত না হয়ে পারেন না।
সমাজবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ, মন্ত্রণালয়, সরকারের নীতিনির্ধারকসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে আজ বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে। সমাজবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানীদের অভিমত কমবেশি আমরা জানি। প্রচার ও গণমাধ্যমে তাদের পর্যবেক্ষণ বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত এবং প্রচারিত হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। আজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্ণধার, শিক্ষক, অভিভাবক, তৃণমূল পর্যায়ের জনপ্রতিনিধি, থানা ও উপজেলা প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, মসজিদ-মাদ্রাসার ইমাম, মোদারেসীন, পরিচালনা কমিটিসহ সংশ্লিষ্ট সবার মিলিত উদ্যোগ আজ জরুরি হয়ে পড়েছে।
অভিভাবক এবং শিক্ষকদেরও সতর্ক পর্যবেক্ষণ থাকতে হবে তাদের সন্তান এবং ছাত্রদের সম্পর্কে। বিশেষ করে প্রতিটি অভিভাবক যদি সতর্ক থাকেন এবং তার সন্তান কোথায় যায়, কার সঙ্গে মিশে সে খোঁজখবর নিয়মিত রাখেন, তাহলে আর যা-ই হোক, একটি কিশোর কখনও খুনি হতে পারে না। নেশাখোর হতে পারে না, অবৈধ অস্ত্র বহন করতে পারে না। মাদকের বাহক এবং ব্যবহারকারী হতে পারে না।
আমাদের দুর্ভাগ্যের বিষয়, আমরা দিন দিন এমনই অর্থলিপ্সু হয়ে উঠছি যে, প্রায় সবাই বিশেষ করে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত শ্রেণি ভয়ংকরভাবে আত্মকেন্দ্রিক, বৈষয়িক স্বার্থের পেছনে ছুটতে ছুটতে আমরা আমাদের সন্তান এবং সংসারের বিষয়েও উদাসীন। সন্তান কোথায় যাচ্ছে, কার সঙ্গে মিশছে, স্কুলে যাচ্ছে, নাকি অন্য কোথাও যাচ্ছে, বাসায় কারা আসছে, কাদের বাসায় বা কোথায় যাচ্ছে- এসবের কোনো খোঁজখবর খুব কম অভিভাবকই রাখেন।
অপ্রিয় হলেও সত্য শহুরে শিক্ষিত এমনকি মফস্বলের শিক্ষিত পরিবারগুলোতেও মা-বাবা সন্তানের বিষয়ে বড় ইদানীং খুব একটা মনোযোগী নন। তারা নিজেদের জগত নিয়ে এমনই বিভোর যে অন্য কিছু দেখার কথা ভাবতেও পারেন না যেন। বিশেষ করে অ্যান্ড্রয়েড ফোনে ফেসবুকসহ নানা গণমাধ্যমে সারাক্ষণ নিমগ্ন বয়স নির্বিশেষে সবাই। যে কারণে শিশু-কিশোরদের প্রতি মোটেও মনোযোগ দেয়া হয় না। তারা যে মোবাইল ফোনে কোথায় যোগাযোগ করছে, কার সঙ্গে কথা বলছে চ্যাটিং করছে, কী ভিডিও দেখছে, সেই খোঁজখবর কজন অভিভাবক রেখেছেন, নিজের বিবেককে প্রশ্ন করলে তার উত্তর পেয়ে যাবেন।
সম্ভবত এর খেসারতই আমরা দিচ্ছি এখন। আমাদের অনেকের সন্তান মাদকসেবী হয়ে যাচ্ছে, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ হচ্ছে তাদের। কিশোর বয়সেই তারা অবৈধ অস্ত্রের সন্ধান পেয়ে যাচ্ছে! রাজনীতি সংশ্লিষ্ট ‘বড় ভাই’য়েরা এই কচিপ্রাণ শিশুদের, উঠতি বয়সী কিশোরকে নিজেদের হাতের লাঠি বানিয়ে এলাকায় প্রভাব বিস্তার করতে চান। বিভিন্ন নামের গ্রুপ তৈরি হয় নানা এলাকায়। এরকম একাধিক গ্রুপের হাতে ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের ঘটনাও ঘটে।
পটুয়াখালীর রিফাত হত্যাকাণ্ড সারা দেশে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল। সেই হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়েছিল কিশোর-যুবাদের হাতেই। যা জেলা আদালতের রায় শেষে এখন উচ্চ আদালতে বিচারাধীন। এরকম বহু কিশোর গ্যাংয়ের অপকর্ম সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। নষ্ট হয়ে যাচ্ছে সম্ভাবনাময় কত তরুণের ভবিষ্যৎ!
অভিভাবকদের উদাসীনতার পাশাপাশি শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশও কম দায়ী নয়। একটা সময় ছিল স্কুলের শিক্ষকদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের স্নেহ আর শ্রদ্ধার নিবিড় বন্ধনের সম্পর্ক! সেই সম্পর্ক দিনে দিনে আলগা হতে হতে এখন প্রায় বিচ্ছিন্ন বললেও অতিশয়োক্তি হবে না হয়তো! হাতেগোনা ব্যতিক্রম ছাড়া অধিকাংশ শিক্ষক শিক্ষকতা পেশাকে অর্থ উপার্জনের মাধ্যম ছাড়া কোনো আদর্শ হিসেবে গ্রহণই করছেন না বলা যায়। অনেকে বাণিজ্যিকভাবেই বিষয়টিকে বিবেচনা করেন। যে কারণে স্কুলে পড়ানোর চেয়ে কোচিংয়ে পড়াতেই তারা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। একজন শিক্ষার্থী কেন স্কুলে আসছে না, তার খোঁজ খবর নেয়ার প্রয়োজন কোনো শিক্ষক বোধ করেন কি না বলা মুশকিল।
এরপর মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হচ্ছে শিশুদের সুস্থভাবে বিকশিত হওয়ার পরিবেশের চরম অভাব। খেলার মাঠ আছে এমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শহরে তো এখন প্রায় বিরল। অথচ স্কুলে খেলার মাঠ থাকাটা ছিল বাধ্যতামূলক। শিশু-কিশোররা ছুটির শেষে বিকেলে মাঠে খেলবে, দৌড়ঝাঁপ করবে, সংলগ্ন পুকুরে সাঁতার কাটবে, এই ছিল আমাদের প্রজন্মের শৈশবের স্কুল।
স্কুলে নিয়মিত বইপড়া, সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা হবে, ইনডোর গেমের ব্যবস্থা থাকবে, একটি শিশু বা কিশোরের সুস্থ দেহ এবং সুস্থ মন নিয়ে বিকশিত হওয়ার জন্য স্কুলেই পরিবেশ তৈরি হওয়ার কথা। সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে বাসায় ফিরবে, পড়ার টেবিলে বসবে, পড়া শেষে কিছুক্ষণ টেলিভিশন দেখবে, অর্থাৎ পড়া এবং বিনোদন পাশাপাশি চলত। কিন্তু এখন?
এ প্রশ্নের উত্তর আমাদের কারো আজ অজানা নেই। এখন শিশু-কিশোরদের শারীরিক এবং মানসিক বিকাশের কথা কেউ ভাবেন বলে মনে হয় না। ভাবলে তো অন্তত স্কুলের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলো থাকত। শিশু-কিশোরদের মানসিক বিকাশের লক্ষ্যে অতীতের মতো প্রতিটি স্কুলে মাসিক বইপড়া প্রতিযোগিতা, বার্ষিক ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা, পুরস্কার বিতরণ, এর সবকিছুই এখন সংকুচিত হয়ে গেছে। এখন যে পরিবেশে স্কুল চলে সেই পরিবেশ স্কুলের উপযোগী নয়। একটি বাসা ভাড়া নিয়ে দেখা যায় যে, এক বা দুটি ফ্লোরে একটি স্কুল চলছে। দেশের শহর নগরের অধিকাংশই স্কুলের চেহারাই এরকম। শিক্ষকদের মান? অধিকাংশ নিম্নমানের। যেমন লেখাপড়ার দিক থেকে এমনি মূল্যবোধের দিক থেকেও।
মুক্তিযুদ্ধের রক্তফসল যে বাংলাদেশ, সেই বাংলাদেশের শিশু কিশোরদের মধ্যে মুক্তচিন্তার উদার মানসিকতা গঠনের কোনো উদ্যোগই সেভাবে চোখে পড়েনি। বিশেষ করে ১৯৭৫ পরবর্তী কালের বাংলাদেশে ধর্মান্ধতার যে অপসংস্কৃতি দিন দিন প্রসারিত হয়েছে, তাতে অন্তত দুই তিনটা প্রজন্মের তো ভয়াল সর্বনাশই হয়ে গেছে। তারা মুক্তচিন্তা আর আধুনিক জীবনবোধের সুস্থ সংস্কৃতির সন্ধান পায়নি।
একটা সময় ছিল, এমনকি পাকিস্তানি আমলেও পূর্ব বাংলার যে কোনো থানা সদরে কিংবা মহকুমা শহরে ভোরবেলা কিংবা বিকেলবেলা হেঁটে গেলে হারমোনিয়ামের সুর শোনা যেত, কিশোর-কিশোরীরা গান শিখছে, কলেজপড়ুয়া ছেলেমেয়েরা সংগীতের চর্চা করছে। কিন্তু আজ?
আপনি বাংলাদেশের এরকম জনপদগুলোতে যান, কোনো বাসায় সকালে কিংবা বিকালে সংগীতচর্চার এই সুর আপনি শোনেন কি না দেখুন। এগুলো এখন বিরল প্রায় দৃশ্য হয়ে গেছে! যে কারণে আগের একজন এসএসসি পাস মানুষ যত বিষয়ে কথা বলতে পারেন পরবর্তীকালে এর সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী অনেকেও সেই বোধের গভীর জায়গাটি স্পর্শ করতে পারেন না।
শুধু তাই নয়, লেখাপড়া যে জ্ঞানচর্চার বিষয়, নিজেকে চিনবার, জানবার এবং আত্মোপলব্ধির ক্ষমতা অর্জনের বিষয়, সেই চিরন্তন সত্যটাও আমাদের অনেক শিক্ষক এবং অভিভাবকের মন থেকে মুছে যেতে বসেছে যেন! সমস্ত অভিভাবকের লক্ষ্য জিপিএ। সন্তান তার কতটুকু জ্ঞান অর্জন করল বা যেকোনো বিষয়ে তার জ্ঞানবুদ্ধির প্রসার ঘটল কি না, সেদিকে দৃষ্টি দেয়ার প্রয়োজনই বোধ করেন না। জ্ঞান নয়, তারা চান সন্তানের জিপিএ ফাইভ!
এই অন্তঃসারশূন্য সার্টিফিকেট আর ডিগ্রির অধিকারী শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ যে কী, তা তো সবাই দেখতেই পাচ্ছেন। এর ওপর অধিকাংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের বিশাল বিপর্যয়। লেখাপড়ার মান সেখানে কোথায়, কীভাবে ছেলেমেয়েরা ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারিং, আইন, শিক্ষাসহ নানা বিষয়ে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করছেন, তাদের বেশির ভাগই জ্ঞানবঞ্চিত। তাদের দিকে তাকালে হতাশায় বুক ভারী হয়ে আসবে যেকোনো বিবেকবান মানুষের।
সুতরাং আত্মকেন্দ্রিকতার স্বার্থের পঙ্কে নিমজ্জিত আমরাই আমাদের সন্তানদের যেমন সর্বনাশ করছি, তেমনি সর্বনাশ করছি দেশেরও। সন্তানদের দেয়ার মতো সময়ও আমাদের নেই। তাদের ভালো-মন্দ নজর দেবার মতো, খোঁজ-খবর রাখার মতো সময় আমাদের নেই! আমরা অনুপার্জিত অর্থে, কালো টাকয়, অবৈধ মুনাফায় বিত্তবান হতে চেয়ে আমাদের চিত্তকে এমনই দরিদ্র করেছি যে, আজ আমাদের অধিকাংশের সন্তান-পরিবারের কাছে কোনো আদর্শ চিন্তা বা জীবনবোধের সন্ধান পায় না।
আবার অনেক রাজনীতিকও এমন স্বার্থান্ধভাবে গ্রুপিং করেন, অস্ত্রবাজ গ্যাং সৃষ্টি করেন, যারা ফ্রাঙ্কেনস্টাইন-সৃষ্ট দানবের মতো সৃষ্টিকারীকেই ধ্বংস করে পরিণামে। পরিবার-সমাজ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে- সব জায়গায় আজ অসুস্থ ভোগবাদী লিপ্সার বিস্তার। সুশৃঙ্খল আদর্শ মানবিক জীবনাচরণ শিখবে কোথা থেকে আমাদের শিশু-কিশোররা? আজকে শিশু-কিশোরদের এই পরিণতির পেছনে মূল ভূমিকা তো সমাজ রাজনীতি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ আমাদের সবার। আমাদের এরপরেও কি বোধোদয় হবে না? আমরা কি আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে কিশোর গ্যাং বানিয়ে নিজেদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার করে তুলব!
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, কবি। সাবেক পরিচালক (বার্তা), বাংলাদেশ টেলিভিশন।