বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

প্রতিটি ঘরে জ্বলুক মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাতি

  • হীরেন পণ্ডিত   
  • ৪ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ১৮:৩৮

সমাজ জীবনের সব ক্ষেত্রে সংস্কৃতির চর্চার অভাব, অসহিষ্ণুতা, সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মের নামে হিংসা, নারী নির্যাতন এ রকম নেতিবাচক বিষয়গুলো আমাদেরকে পিছিয়ে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। বর্তমান প্রজন্ম পাকিস্তানি দুঃশাসন বা পাকিস্তানি স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে লড়াই দেখেনি। শুধু শুনেছে বা পড়েছে। তাতে মহান স্বাধীনতা দিবস বর্তমান প্রজন্মের কাছে কতটা স্পষ্ট তা পরিষ্কার নয়; তাই এখানে পরিবারের সিনিয়র সদস্যদের কাজ করতে হবে। আমাদের নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শাণিত করতে হবে।

মুক্তিযুদ্ধ হচ্ছে বাঙালি জাতির শোষণের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হওয়ার যুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হলো একটি জাতির স্বপ্নের নাম। যে স্বপ্ন জাতিকে অনুপ্রাণিত করেছে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায়। যে চেতনা বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল একটি গণতান্ত্রিক ও শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠায়।

বাঙালি জাতির হাজার বছরের ইতিহাসের গৌরবজনক ঘটনা বা অধ্যায় হচ্ছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। ৩০ লাখ শহিদের বুকের তাজা রক্ত, লাখ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানি এবং সীমাহীন আত্মত্যাগের বিনিময়ে একাত্তরের নয় মাস যুদ্ধের মাধ্যমে আমাদের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে।

২৩ বছরের আন্দোলন সংগ্রাম এবং নয় মাস সশস্ত্র যুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করেই বিজয় ছিনিয়ে আনা হয়েছে ১৬ ডিসেম্বরে। বাংলার স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করেছেন বাঙালির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, ইতিহাসের মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি জাতির কাছে সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল ঘটনা এবং যতদিন বাঙালি জাতি থাকবে ততদিন এই মুক্তিযুদ্ধই থাকবে শ্রেষ্ঠ গৌরবের অধ্যায় হিসেবে, অবিস্মরণীয় এক গৌরবগাথা হিসেবে। কারণ বাঙালি জাতির জন্ম থেকেই কোনো না কোনো শাসকের মাধ্যমে শোষিত হয়েছে, অনেক কিছু বিসর্জন দিতে হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম না হলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না। যে নেতার জন্ম না হলে, যে বাংলাদেশ আমরা পেয়েছি, সেই বাংলাদেশ পেতাম না।

বঙ্গবন্ধু নিজে ছিলেন স্বাধীনচেতা, তিনি দেশকেও স্বাধীন করেছেন নিজ উদ্যোগে। বাংলাদেশের এমন কোনো অঞ্চল নেই, যেখানে তিনি বিচরণ করেননি, মানুষকে সমবেত করেছেন আপন মহিমায়। তিনি মানুষের মাঝে আত্মসচেতনতা সৃষ্টি করেছিলেন, স্বাধিকার আন্দোলনের চেতনা এবং বীজ দু’টোই ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন বাঙালির মন ও মননে। অধিকার চেতনাবোধ জাগ্রত করেছেন। মানুষের মনে অনুপ্রেরণা সৃষ্টি করেছেন। তিনি বার বার কারাবরণ করেছেন। কিন্তু কোনো লোভ-লালসার কাছে তিনি মাথা নত করেননি, আত্মসমর্পণ করেননি। বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশ- এ দুটি প্রত্যয়, দুটি শব্দ অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। ১৯৭১ সালে এই ক্ষণজন্মা মহান পুরুষের কালজয়ী ও গতিশীল নেতৃত্বেই বাঙালি জাতি মুক্তির স্বাদ লাভ করেছিল।

বাঙালির ইতিহাস মানেই শোষণ আর অধিকার থেকে বঞ্চনার ইতিহাস। আজকের তরুণ প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করার জন্য দরকার মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তাদের সামনে উপস্থাপন। সঠিক তথ্যটি তাদের সামনে তুলে ধরা। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে একটি জাতিকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করার জন্য যত ধরনের ব্যবস্থা নেয়া দরকার সব ধরনের ব্যবস্থাই নিয়েছিল পাকিস্তানিরা। এ কারণেই তারা দেশের শ্রমজীবী, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিকদের হত্যা করে। যারা বাঙালিকে নিশ্চিহ্ন করতে চাচ্ছিল বাঙালি জাতি কীভাবে তাদের পরাজিত করেছিল তার সঠিক ইতিহাস তরুণ প্রজন্মের সামনে তুলে ধরা সবারই দায়িত্ব ও কর্তব্য।

বাংলাদেশের বর্তমান তরুণ প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি কিন্তু শুনেছে বা বইয়ে পড়েছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। এখন প্রশ্ন হলো- তারা যেখান থেকে পড়েছেন সেগুলো কতটুকু সঠিক। তাও দেখার বিষয়। আমাদের পূর্ববর্তী প্রজন্ম কি সঠিকভাবে আমাদের সামনে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তুলে ধরেছেন? নাকি আমরা তরুণ প্রজন্মের সবাইকে বিকৃত ইতিহাস জানিয়ে বিভ্রান্ত করেছি? এই বিষয়ে তরুণদের সজাগ দৃষ্টি রাখা উচিত। তরুণদের বা নতুন প্রজন্মের জানা উচিত সঠিক ইতিহাস।

মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাসটি নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার জন্য অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারেন পরিবারের সদস্যরা। কারণ পরিবারের কাছে একটি শিশু অথবা কিশোর প্রাথমিক জ্ঞান লাভ করে। পরিবার যদি তাকে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাসটি জানায় তাহলে নতুন প্রজন্মের বিভ্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কম।

আমাদের স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সবার সামনে তুলে ধরার ক্ষেত্রে কতটুকু সফল? আমরা লক্ষ করি যখন যে সরকার আসে সেই সময় ইতিহাসের বিভিন্ন পরিবর্তন আসে। নিজের চাহিদা বা সুবিধামতো ইতিহাসের পরিবর্তন করে নেয়া হয়। এই পরিবর্তন তো একটি জাতির জন্য সুখের বিষয় নয়। ইতিহাস বিকৃতি একটি জাতিকে ধ্বংস আর বিভ্রান্ত করারই নামান্তর। এখন মক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিষ্ঠা করার জন্য নতুন প্রজন্মের পাশে থাকতে হবে এবং পাশে দাঁড়াতে হবে বিজ্ঞ অভিভাবকদের।

মুক্তিযুদ্ধের কারণেই আমরা পেয়েছি একটি স্বাধীন দেশ। অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা নিজের জীবন দিয়ে, মা-বোনেরা তাদের সম্ভ্রমের বিনিময়ে আমাদের হাতে তুলে দিয়েছেন একটি স্বাধীন দেশ এবং সেই দেশটিকে গড়ার গুরুদায়িত্ব আমার আপনার ও আমাদের সবার। মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জেনে সব বিভেদ ভুলে আমরাই গড়ে তুলব এক স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ যার স্বপ্ন দেখেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

তারুণ্য একটি প্রাণশক্তি যা অফুরন্ত সম্ভাবনা ও বর্ণিল স্বপ্ন দ্বারা উজ্জীবিত থাকে। একটি স্ফুলিঙ্গ তারুণ্যকে উদ্দীপ্ত শিখায় পরিণত করতে পারে যা হয়ে উঠতে পারে নক্ষত্রের মতো সমুজ্জ্বল। তরুণদের স্বপ্নগুলো হবে বাংলাদেশের স্বপ্ন, ভাবনাগুলো হবে বাংলাদেশের ভাবনা, কাজগুলো হবে বাংলাদেশের কাজ।’ এতেই গড়ে উঠবে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বাস্তবায়িত হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা।

আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের ইতিহাসের প্রতিটি পাতায় লেগে রয়েছে লাখো মানুষের ত্যাগ, সংগ্রাম ও আত্মদানের উজ্জ্বল চিহ্ন। স্বাধীনতার এই ৫০ বছরে কয়েকটি প্রশ্ন মনের মধ্যে উঁকি দিয়ে যায়, স্বাধীনতার প্রকৃত মানে আসলে কী? স্বশাসিত হওয়ার ক্ষমতাই কি ‘স্বাধীনতা’? আমরা কি সেদিন দেশ-সম্পর্কিত বোধ, স্বাধীনতার ধারণা, ন্যায়-নৈতিকতা বিষয়ে উত্থাপিত প্রশ্নগুলো নির্দিষ্ট গ্রহণযোগ্য উপসংহারে পৌঁছাতে পেরেছিলাম? সদ্যস্বাধীন দেশের প্রতিটি ক্ষেত্রে গর্ব, আবেগ এবং দেশপ্রেমের প্রতীক হিসেবে যখন পতাকা উড়ছিল তখন শরণার্থীশিবির থেকে কোটি কোটি মানুষ সম্বলহীন অবস্থায়, চোখের জলে বুক ভিজিয়ে যখন স্বাধীন দেশে প্রত্যাবর্তন করে, তাদের সেই ভেঙে যাওয়া স্বপ্নগুলোর পুনর্নিমাণে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করার আরও উদ্যোগ প্রয়োজন ছিল।

স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে আমরা অনেক কিছুই অর্জন করেছি, আমরা অনেক এগিয়েছি। দেশের সব মানুষ দুবেলা দুমুঠো খেতে পাচ্ছে, শান্তিতে ঘুমাতে পারছে। সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে। তবে সুবিধাবঞ্চিত ও সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্য অনেক কিছু করার এখনও বাকি আছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখতেন তা বাস্তবায়নের জন্য তার সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এ কথা ঠিক যে, আর্থিক ও উন্নয়নের বিভিন্ন সূচকে আমরা অনেক দিক থেকেই এগিয়েছি। কিন্তু আরও যেসব ক্ষেত্রে যেভাবে অগ্রগতি হওয়ার কথা ছিল, আমাদের সেখানে কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি অর্জন করা সম্ভব হয়নি।

আসলে রাজনৈতিক স্বাধীনতা এসেছে ঠিকই, এখনো সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতার জন্য আরও কাজ করতে হবে। স্বাধীনতার অর্থ দেশকে একটি সুদৃঢ় ভিতের ওপরে দাঁড় করানো; দেশের মানুষের জন্য প্রয়োজন শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্য, বস্ত্র ও বসবাস যোগ্য স্থানের চাহিদা পূরণে সক্ষম করে তোলা। মানুষের জীবিকার ব্যবস্থা করা, বিজ্ঞান ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রসার ঘটিয়ে দেশকে স্বনির্ভর করে তোলা এবং সবাইকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে তোলা।

স্বাধীনতার অর্থ এটা নয় যে, যার মতো যা খুশি করবে। স্বাধীনতা মানে দায়িত্বশীল হওয়া, কর্তব্যপরায়ণ হওয়া। নিয়মনীতি মেনে চলা। অন্যের কল্যাণে পরিচালিত হওয়া। স্বাধীনতা অর্থবহ হতে পারে দেশের জনগণের জন্য কল্যাণে কাজ করা। সুশিক্ষাই পারে সবাইকে স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে। মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোতে নিয়ে আসতে পারে। দেশের মানুষের মধ্যে প্রকৃত শিক্ষার আলো জ্বালাতে না পারলে সব স্বাধীনতাকে সামনের দিকে নিয়ে যাওয়া অনেকটাই কঠিন হতে পারে। আমাদের মধ্যে স্বাধীনতার বোধ ও চেতনা খুব একটা স্পষ্ট নয়। স্বাধীনতা আসলে একটা মানসিকতা।

সমাজ জীবনের সব ক্ষেত্রে সংস্কৃতির চর্চার অভাব, অসহিষ্ণুতা, সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মের নামে হিংসা, নারী নির্যাতন এ রকম নেতিবাচক বিষয়গুলো আমাদেরকে পিছিয়ে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। বর্তমান প্রজন্ম পাকিস্তানি দুঃশাসন বা পাকিস্তানি স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে লড়াই দেখেনি। শুধু শুনেছে বা পড়েছে। তাতে মহান স্বাধীনতা দিবস বর্তমান প্রজন্মের কাছে কতটা স্পষ্ট তা পরিষ্কার নয়; তাই এখানে পরিবারের সিনিয়র সদস্যদের কাজ করতে হবে। আমাদের নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শাণিত করতে হবে।

বর্তমান সরকারের অঙ্গীকার ও নিরলস প্রচেষ্টায় ডিজিটাল বাংলাদেশ আমাদের জীবনকে নতুন স্বাভাবিক অবস্থায় নিয়ে গেছে এবং আমরা নতুন এক মাত্রায় উঠে এসেছে। আমাদের দেশ আধুনিক যন্ত্র ও প্রযুক্তির ব্যবহারে এগিয়ে যাচ্ছে। ইন্টারনেট ব্যবহার করে শিক্ষা, তথ্য আদান-প্রদান, ব্যবসা-বাণিজ্য, আর্থিক লেনদেন বাড়ছে। লাখ লাখ মানুষ লেখাপড়া, জীবিকা, চিকিৎসাসহ উন্নত সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে। কিন্তু তার পাশাপাশি ধর্মবিশ্বাস, গুজব, অনলাইনে হয়রানি সমান তালে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এগুলো নিয়ে আমাদের আরও কাজ করতে হবে। দেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমৃদ্ধ করার জন্য পরিবার, সমাজ, দেশ ও রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসতে হবে এবং বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে হবে সবাইকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমৃদ্ধ করার মাধ্যমে।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও রিসার্চ ফেলো, বিএনএনআরসি

এ বিভাগের আরো খবর