বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

জিয়ার কবর ও প্রাসঙ্গিক ভাবনা 

  •    
  • ৪ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ১৩:৩৫

যুদ্ধাপরাধীদের পুনর্বাসনকারী জিয়াউর রহমানের কবর সুদূর চট্টগ্রাম থেকে নিয়ে এসে তার জন্মস্থান বগুড়ায় না স্থাপন না করে, সেটি স্থাপন করা হয় দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থান জাতীয় সংসদ ভবন ক্যাম্পাসে। এমনকি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী কয়েকজন রাজনীতিককেও কবর দেয়া হয় এই সংসদ ভবন এলাকায়। অথচ জেলখানায় শহীদ জাতীয় চারনেতাকেও সংসদ ভবন এলাকায় কবর দেয়া হয়নি। মনে রাখা দরকার, এই ঘটনাগুলো ঘটেছে পঁচাত্তরের পট পরিবর্তনের পরে। অর্থাৎ রাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা সংসদ ভবন এলাকায় জিয়া এবং অন্য বিতর্কিত ব্যক্তিদের কবর দেয়া ছিল ওই সময়ের শাসকগোষ্ঠীর রাজনীতিরই অংশ।

বেশ কিছুদিন বিরতির পর নতুন করে আলোচনায় বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কবর। সংসদ ভবনের যে এলাকায় তার সমাধি, সেখানে আসলেই তার দেহাবশেষ আছে কি না— এ নিয়ে শুধু সংশয় বা প্রশ্নই নয়, বরং ক্ষমতাসীন দলের তরফে দাবি করা হচ্ছে, এখানে জিয়ার দেহাবশেষ নেই। তাছাড়া এই সমাধিস্থলটি নির্মাণ করা হয়েছে লুই কানের নকশা উপেক্ষা করে।

ইতিহাস বলছে, জিয়াউর রহমানকে প্রথমে কবর দেয়া হয় চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার পোমরা ইউনিয়নে। পরে সেখান থেকে দেহাবশেষ তুলে এনে ১৯৮১ সালের ২ জুন সংসদ ভবনের উল্টো দিকে সমাহিত করা হয়। তখনও জাতীয় সংসদের এই ভবনটি উদ্বোধন হয়নি। কাজ ছিল শেষপর্যায়ে এবং এই নান্দনিক ভবনের উদ্বোধন হয় জিয়াকে এখানে সমাহিত করার মাস ছয়েক পরে, ১৯৮২ সালের জানুয়ারিতে।

২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর জিয়ার কবরকে কেন্দ্র করে পাঁচ বিঘা জমিতে সমাধি কমপ্লেক্স গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তবে চট্টগ্রাম থেকে জিয়ার দেহাবশেষ আনা হলেও ওই কফিনে আসলেই জিয়ার দেহাবশেষ ছিল কি না, তা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে শুরু থেকেই বিতর্ক ছিল।

এখান থেকে জিয়ার কবরটি সরানোর বিষয়টি প্রথমে আলোচনায় আসে ২০১৪ সালের ১৭ জুন। ওইদিন জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, সংসদ ভবনের ঐতিহ্য রক্ষার পাশাপাশি লুই আই কানের নকশা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে যদি কবরগুলো সরানোর দরকার হয়, তাহলে সরকার তাই করবে। এরপর এ বিষয়ে একটি প্রস্তাব তৈরি করে ওই বছরের ১৪ জুলাই গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো হয়।

সেখানে স্থপতি লুই আই কানের নকশায় শেরেবাংলা নগর এলাকায় কবরস্থানের জন্য কোনো জায়গা রাখা হয়নি উল্লেখ করে জিয়াউর রহমানের কবরসহ জাতীয় সংসদ ভবন এলাকায় অবস্থিত সব কটি কবর সরানোর পক্ষে মত দেয় গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। তবে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্কিটেকচার আর্কাইভসে সংরক্ষিত লুই আই কানের মূল নকশার অনুলিপি আনারও উদ্যোগ নেয়া হয়। সেই মূল নকশাও আনা হয়।

করোনার কারণে হোক, আর যে কারণেই হোক, বেশ কিছুটা সময় প্রসঙ্গটি আলোচনার বাইরে ছিল। সম্প্রতি ইস্যুটি নতুন করে সামনে এনেছেন ক্ষমতাসীনরা। বলছেন, লুই কানের মূল নকশা বাস্তবায়ন তো বটেই, যেহেতু এই সমাধিতে জিয়ার দেহাবশেষ নেই, সুতরাং এটি ভেঙে ফেলতে হবে। এমনকি স্বয়ং মুক্তিযুদ্ধবিষয়কমন্ত্রী চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বলেছেন যে, এখানে যে জিয়ার দেহাবশেষ নেই, সেটি ডিএনএ টেস্ট করলেই প্রমাণিত হবে।

লুই কানের মূল নকশা বাস্তবায়নের দোহাই দিয়ে সরকার চাইলে এই সমাধিটি ভেঙে ফেলতে পারে। কিন্তু অস্বীকার করা যাবে না, এখানে জিয়ার দেহাবশেষ থাক বা না থাক, এই স্থাপনাটির সঙ্গে বিএনপির বিশাল আবেগ জড়িত। কারণ যখন জাতীয় সংসদ থেকে রাজপথ, রাজপথ থেকে নির্বাচনের মাঠ— সবখানেই বিএনপি কোণঠাসা, তখন সংকটে জর্জরিত এই দলটির নেতাদের মিলনকেন্দ্র হচ্ছে তাদের দলের প্রতিষ্ঠাতার এই ‘সমাধি’স্থল। যেকোনো অনুষ্ঠানে তারা এখানে ফুল দিতে আসেন, মোনাজাত করেন এবং তারপর দলের নেতারা সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। মাঝে মধ্যে নিজেদের মধ্যে হাতাহাতিও হয় এখানে। সবকিছু মিলিয়ে জিয়ার সমাধি আসলে বিএনপির কাছে তাদের নয়াপল্টন বা গুলশানের রাজনৈতিক কার্যালয়ের চেয়েও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

হিসাব করলে দেখা যাবে, সারা বছর বিএনপির যেসব সংবাদ গণমাধ্যমে আসে, তার অধিকাংশেরই জন্ম এই সমাধিতে। ফলে এখান থেকে যদি জিয়াউর রহমানের সমাধি সত্যি সত্যিই সরিয়ে নেয়া হয় বা স্থাপনাটি ভেঙে ফেলা হয়, সেটি বিএনপির রাজনীতির জন্য একটা বড় ধাক্কা হবে। তবে জিয়ার কবর সরিয়ে মিরপুর অথবা বনানী কবরস্থানে নেয়া হলে বিএনপির সমাধিকেন্দ্রিক রাজনীতির খুব বেশি ক্ষতিও হবে না। কারণ মিরপুরে হোক অথবা বনানীতে— সেখানেও নেতাকর্মীরা নানা উপলক্ষে ফুল দিতে যেতে পারবেন। বরং এই ইস্যুতে কিছুদিন দেশের রাজনীতি তারা গরম করে রাখার উসিলা পাবে।

যদি সত্যিই এই স্থাপনটি ভেঙে ফেলা হয়, বিএনপি যে এর বিরুদ্ধে ব্যাপক জনমত তৈরি করে জোরালো আন্দোলন গড়ে ‍তুলে পারবে, সে সম্ভাবনাও কম। কারণ স্বয়ং তাদের দলের চেয়ারপারসনকে একটি মামলায় জেলে নেয়া হলেও বিএনপি সেভাবে কোনো আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি। সরকার যতই মারমুখী হোক না কেন, রাজপথে দলের নেতাকর্মীরা সেভাবে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারেনি। এর একটি বড় কারণ তাদের অন্তর্কোন্দল এবং নেতৃত্বহীনতা।

খালেদা জিয়া বর্তমানে জামিনে থাকলেও শারীরিকভাবে তিনি পুরোপুরি সুস্থ নন। বয়সও হয়েছে। ফলে দলের নীতিনির্ধারণ ও কর্মপন্থা ঠিক করেন তার ছেলে তারেক রহমান— যিনি একাধিক মামলায় সাজাপ্রাপ্ত এবং বসবাস করেন লন্ডনে। সুতরাং, একটি মূলধারার বড় রাজনৈতিক দলকে যদি কয়েক হাজার মাইল দূর থেকে কোনো একজন নেতার নির্দেশে পরিচালিত হতে হয়, সেটি দলের সিনিয়র ও ত্যাগী নেতাদের পক্ষে মেনে নেয়া কঠিন। এ নিয়ে দলের ভেতরেই নানা অসন্তোষ আছে। ফলে একদিকে দলের নেতাদের বিরুদ্ধে অগণিত মামলা, অপরদিকে দলের এই অভ্যন্তরীণ বিরোধ— সব মিলিয়ে বিএনপির এখন যে হাল, তাতে জিয়ার সমাধি কমপ্লেক্সটি সরকার ভেঙে ফেললেও বিএনপি এর বিরুদ্ধে খুব বেশি কিছু করতে পারবে বলে মনে হয় না।

বিএনপি কী পারবে বা পারবে না—তার চেয়ে বড় কথা, এই ইস্যুটি নিয়ে কথা বলা বা এই প্রসঙ্গটির অবতারণা খুব জরুরি ছিল কি না?

মনে রাখা দরকার, জিয়াউর রহমানের নিহত হবার ৫ বছর আগে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট সপরিরারে নিহত হন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বিরুদ্ধ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তাকে দাফন করা হয় জন্মস্থান গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায়। অথচ বাংলাদেশের স্থপতি হিসেবে তার সমাধিটি রাজধানীতেই থাকার কথা ছিল। অথচ যুদ্ধাপরাধীদের পুনর্বাসনকারী জিয়াউর রহমানের কবর সুদূর চট্টগ্রাম থেকে নিয়ে এসে তার জন্মস্থান বগুড়ায় না স্থাপন না করে, সেটি স্থাপন করা হয় দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থান জাতীয় সংসদ ভবন ক্যাম্পাসে।

এমনকি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী কয়েকজন রাজনীতিককেও কবর দেয়া হয় এই সংসদ ভবন এলাকায়। অথচ জেলখানায় শহীদ জাতীয় চারনেতাকেও সংসদ ভবন এলাকায় কবর দেয়া হয়নি। মনে রাখা দরকার, এই ঘটনাগুলো ঘটেছে পঁচাত্তরের পট পরিবর্তনের পরে। অর্থাৎ রাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা সংসদ ভবন এলাকায় জিয়া এবং অন্য বিতর্কিত ব্যক্তিদের কবর দেয়া ছিল ওই সময়ের শাসকগোষ্ঠীর রাজনীতিরই অংশ।

এ দেশে সবকিছুর পেছনেই রাজনীতি থাকে। বিশেষ করে যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে তারা তাদের প্রতিপক্ষকে দমনে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা গ্রহণ করে। সেটি ২০০৪ সালে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতাকে গ্রেনেড মেরে হত্যার পরিকল্পনাই হোক, কিংবা এরপরে একটি বিতর্কিত মামলায় আরেকজন বিরোধীদলীয় নেতাকে সাজা দেয়াই হোক; সেই রাজনীতির ধারাবাহিকতাই হচ্ছে সংসদ ভবন থেকে জিয়ার কবর সরানো বা তার সমাধি কমপ্লেক্স ভেঙে ফেলার দাবি। এখানে লুই কানের মূল নকশার বাস্তবায়নের চেয়ে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলকে আরও বেশি প্রান্তিক করে দেয়া যদি লক্ষ্য হয়ে থাকে, তবে সেটা অশোভন।

হয়তো এই স্থাপনাটি ভেঙে ফেললে বিএনপি এর বিরুদ্ধে জোরালো কোনো আন্দোলন গড়ে তুলতে পারবে না। কিন্তু বিএনপি-আওয়ামী লীগের বাইরে যে বিপুল সাধারণ জনগোষ্ঠী—তাদের কাছে কি এটা কোনো ভালো বার্তা দেবে? এটা ভেবে দেখা দরকার।

বিএনপি এবং তাদের শরিক দলগুলো এই ঘটনাকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করবে এবং কিছু মানুষ বিশ্বাসও করবে। সুতরাং জিয়ার কবর সত্যিই সরিয়ে ফেলা বা এই স্থাপনাটি ভেঙে ফেলা হলে সেটি রাজনৈতিকভাবে বিএনপিকে ক্ষতিগ্রস্ত যেমন করবে, তেমনি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তিও প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে।

লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।

এ বিভাগের আরো খবর