লেখাটি প্রকাশের জন্য কানাডার কোনো গণমাধ্যমই ছিল উপযুক্ত স্থান। কিন্তু সেটি তো আর সম্ভব নয়। কেননা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-কানাডাসহ উন্নত বিশ্বকে যতই আমরা বাকস্বাধীনতার স্বর্গরাজ্য বলে দাবি করি না কেন, প্রকৃত বাকস্বাধীনতা সবার জন্য উন্মুক্ত আছে কি না তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করার যথেষ্ট কারণ আছে। এখানে তারাই শতভাগ বাকস্বাধীনতা ভোগ করে যাদের বাকস্বাধীনতা প্রকাশের সুযোগ আছে। আমাদের দেশে যে কেউ চাইলে যেকোনো কিছু মিডিয়াতে বলতে পারে- তা সেটি রাষ্ট্র, সমাজ বা সরকারের বিপক্ষে গেলেও। অথচ এমনটা এসব উন্নত দেশে মোটেও সম্ভব নয়।
আমাদের মতো সাধারণ মানুষও বাংলাদেশের মিডিয়াতে কলাম লেখার সুযোগ পাই বা মতামত প্রদানের সুযোগ পাই যা এখানে অসম্ভব। এখানে মিডিয়ার লাইনে না পড়লে কিছুই তারা প্রকাশ করবে না। এখানে প্রায়ই আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে কিন্তু সেগুলোর খবর সেভাবে না ছেপে নিছক ব্যক্তিগত দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দেয়া হয়। এই টরেন্টো শহরে প্রতিনিয়তই গোলাগুলির ঘটনা ঘটছে এবং অনেকে আহত-নিহতও হচ্ছে। কিন্তু এসব খবর বিস্তারিত কখনই সেভাবে ছাপা হয় না, ফলে আমরা জানতেও পারি না কী কারণে এসব গোলাগুলির ঘটনা ঘটছে এবং এর প্রতিকার বা বিচারই কি হচ্ছে? এ কারণেই লেখার বিষয়টি কানাডার জাতীয় নির্বাচন-সংক্রান্ত হলেও বাংলাদেশের গণমাধ্যমে প্রকাশ করতে হলো। তাছাড়া আমাদের দেশে এক শ্রেণির মানুষ আছেন যারা কথায় কথায় উন্নত বিশ্বের স্বচ্ছ রাজনীতির প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে ওঠেন। তাদেরও উন্নত বিশ্বের অপরাজনীতির বিষয়টি জানা প্রয়োজন।
কানাডার বর্তমান সরকারের মেয়াদ এখনও দুই বছর বাকি আছে। এখানকার পরবর্তী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবার কথা আরও দুবছর পরে। অথচ বর্তমান জাস্টিন ট্রুডোর নেতৃত্বাধীন লিবারেল সরকার দুবছর মেয়াদ বাকি থাকতেই তড়িঘড়ি করে আগামী ২০ সেপ্টেম্বর কানাডার নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেছে। বিষয়টিকে আমাদের দেশের অনেক আলোচক বেশ ইতিবাচক হিসেবে দেখে বলার চেষ্টা করবেন যে, কানাডার সরকারের কোনো ক্ষমতার লোভ নেই। খালি চোখে দেখলে বিষয়টি এরকমই মনে হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু বাস্তব অবস্থা হলো দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার ব্যাবস্থাকে গণতান্ত্রিক মারপ্যাঁচে পাকাপোক্ত করার উদ্দেশ্যেই এই আগাম নির্বাচনের আয়োজন। করোনা সংক্রমণের কারণে বিশ্বব্যাপী যে অতিমারি শুরু হয়েছে আজ থেকে দেড় বছর আগে।
কানাডা অন্যান্য উন্নত দেশের তুলনায় ভালো ম্যানেজ করতে পারলেও এই সংক্রমণ শেষ হয়ে যায়নি। যদিও এর কৃতিত্ব যত না কেন্দ্রীয় সরকারের তার চেয়ে অনেক বেশি প্রাদেশিক সরকারের। বরং কেন্দ্রীয় সরকার শুরুর দিকে ভ্যাকসিন নিয়ে এক ধরনের লেজেগোবরে অবস্থার সৃষ্টি করে ফেলে। এখনও প্যানডেমিক শেষ হয়ে যায়নি। দেড় বছর ধরে স্থবির হয়ে থাকা অর্থনীতির উচ্চগতি এখনও যাচ্ছে না। বেকার সমস্যা যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। আবার সংক্রমণের হার বাড়তে শুরু করেছে। সব কিছু পুরোপুরি খুলে দিলে অবস্থা কী আকার ধারণ করে তা নিয়ে সবাই শঙ্কিত। এদিকে কানাডার জাতীয় ঋণের পরিমাণ ১.৪ ট্রিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। বাজেট ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩১৪ বিলিয়ন ডলার যা জিডিপি (গ্রস ডমেসটিক প্রোডাক্ট বা মোট দেশজ উৎপাদন) এর ১৮%। এমনই এক জরুরি অবস্থার মতো সময়ে দুবছর আগেই জাতীয় নির্বাচনের ঘোষণার এমন কী যৌক্তিকতা থাকতে পারে!
করোনা সংক্রামণের কারণে প্রকৃত প্রয়োজন যাচাইবাছাই না করে বিগত দেড় বছর ধরে এক শ্রেণির মানুষের মাঝে জরুরি অবস্থা মোকাবিলায় দেদারসে অর্থ বিলি করেছেন বর্তমান জাস্টিন ট্রুডোর নেতৃত্বাধীন লিবারেল সরকার। ফলে কানাডার জনগণের বিশেষ করে অর্থ সুবিধা ভোগকারী সেই শ্রেণির মানুষের কাছে জাস্টিন ট্রুডোর নেতৃত্বাধীন লিবারেল সরকারের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে এবং লিবারেল সরকার ভালো করেই জানে যে, এই অর্থ প্রদানের ধারাবাহিকতা বেশি দিন ধরে রাখা যাবে না। এই অর্থ সাহায্য যখন বন্ধ হয়ে যাবে এবং সব কিছু খুলে দেয়ার পর অর্থনীতি যে কী রূপ ধারণ করবে তা কেউ জানে না।
অর্থনীতি যদি সত্যি বৈরী আচরণ শুরু করে তাহলে যে ভয়ংকর অবস্থার সৃষ্টি হবে তাতে অর্থ বিলি করে যে সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জন করা হয়েছে তা নিমিষেই হারিয়ে যাবে। এ কারণেই বিগত দেড় বছর করোনা সহায়তার নামে অর্থ বিলি করে অর্জিত জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে নির্বাচনি বৈতরণী পার হয়ে নিজেদের ক্ষমতাকে আরও বেশি পাকাপোক্ত করার উদ্দেশ্যেই মেয়াদপূর্তির দুবছর আগেই এই নির্বাচন। এটি মূলত আমাদের দেশের নির্বাচনে টাকা দিয়ে ভোট কেনার শামিল। পার্থক্য হলো আমাদের দেশে এসব করা হয় কিছুটা নগ্নভাবে, আর এখানে একই কাজ করা হচ্ছে আইন এবং গণতন্ত্রের ছদ্মাবরণে। আমার সামর্থ্য থাকলে আমি এই অভিযোগটি এখানকার উচ্চ আদালতে নিতাম।
এখানেই শেষ নয়। রাজনীতিতে ধর্ম ও জাতিগোষ্ঠীর ব্যবহার এখানেও হচ্ছে বেশ জোরেশোরে। প্রত্যেকেই কোনো বিশেষ ধর্ম বা জাতিগোষ্ঠীর ভোট পাওয়ার আশায় তাদের উপাসনালয়ে যেয়ে ধরনা দিচ্ছে এবং বিশেষ সুযোগ-সুবিধার প্রতিশ্রুতিও প্রদান করছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মনে প্রাণে বিশ্বাস করুক আর না করুক ধর্মীয় প্রার্থনায়ও অংশ নিচ্ছে। এখানকার রাজনীতিবিদরা একবারও ভাবছে না যে, শুধু ভোটপ্রাপ্তির আশায় এসব অভিনয় করে প্রকারান্তরে মারাত্মক ক্ষতিই করছেন। কারণ অস্বাভাবিক কোনো কিছুই ভালো না। এসব আচরণের মাধ্যমে রাজনীতিবিদরা মূলত আরেক পক্ষকে ক্ষুব্ধ করছে এবং এর ফলে এক ধরনের ধর্মীয় এবং জাতিগত বিদ্বেষ উসকে দেয়া হচ্ছে। একইভাবে পাহাড় সমান বিশ্ব শরণার্থী সমস্যার মধ্য থেকে কিছু শরণার্থী নিয়ে এসে নির্দিষ্ট একটি জাতিগোষ্ঠীর সহানুভূতি এবং ভোটপ্রাপ্তির চেষ্টাও বেশ প্রবল।
আমরা এখানে অভিবাসন নিয়ে এসে যুগের পর যুগ স্থায়ীভাবে বসবাস করলেও আমাদের ভাইবোনদের কোনোদিনই নিয়ে আসতে পারব না। এমনকি আমাদের বৃদ্ধ পিতামাতাকে এখানে নিয়ে আসার জন্য লটারির ওপর নির্ভর করতে হয়। অথচ লাখ লাখ শরণার্থী নিয়ে আসা হচ্ছে প্রতিবছর। অবশ্যই এটি একটি মহতি উদ্যোগ এবং আমরা এজন্য এখানকার নীতিনির্ধারকদের সাধুবাদ জানাই। কিন্তু সেই সঙ্গে আমাদের ভাইবোন না হোক, বৃদ্ধ পিতামাতাকে অন্তত আনার সুযোগ দিলে আমরা আরও বেশি খুশি হতে পারতাম। এ তো গেল কানাডার কথা।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গত নির্বাচনে কী হয়েছে তা সবাই দেখেছে। নির্বাচনি প্রচারে জাতিগত বিভেদ উসকে দেয়া এবং তথ্যপ্রযুক্তির স্বর্গরাজ্য বলে খ্যাত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিলম্বে মেইলিং ব্যালট গ্রহণ এবং ফল ঘোষণার দীর্ঘসূত্রতার দৃশ্য বিশ্ববাসী বেশ ভালোভাবেই উপলব্ধি করেছে। এমনকি ডোনাল্ড ট্রাম্পের ক্ষমতায় আঁকড়ে থাকার শেষ চেষ্টা হিসেবে ক্যাপিটাল হিলে তার সমর্থকদের আক্রমণের ঘটনা নজিরবিহীন।
এসব অপরাজনীতির অভিজ্ঞতা আমাদের ভালোই জানা আছে। কেননা আমরা এসব কাছে থেকে দেখেছি। সত্যি বলতে কি এই অপরাজনীতি এবং অব্যবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্যই আমরা নিজের জন্মভূমি, নিজের আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধব ফেলে এসব দেশে চলে এসেছি। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের যে, এখানেও সেই একই অবস্থা প্রত্যক্ষ করতে হচ্ছে। এক সময় উন্নত বিশ্বের দেশগুলো যেসব কারণে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে দোষারোপ করত এখন তারাই সেগুলো অনুসরণ করছে। এ তো মাত্র শুরু। দিনে দিনে অবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় সেটিই দেখার বিষয়। সবচেয়ে বড় কথা যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পূর্বশর্ত হলো- সচেতন জনগণ, যারা সঠিক ভোটাধিকারের মাধ্যমে রাজনীতিবিদদের যথাযথভাবে দায়িত্ব পালনে বাধ্য করবে
সেই জনগণই এখন আর সচেতনভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করে না। সেটা আমাদের বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশই হোক, আর কানাডার মতো উন্নত দেশেই হোক। কানাডার জনগণ যদি সচেতনভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করে তাহলে এই মহামারির মধ্যেই অকারণে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করে আগাম নির্বাচন করার দায়ে জাস্টিন ট্রুডোর নেতৃত্বাধীন লিবারেল দলকে ভোট না দিয়ে অন্য কোনো দলকে ভোট দেবে। এমনটা করতে পারলে তা শুধু লিবারেল দলের জন্যই যে উপযুক্ত শিক্ষা হতো তাই নয়, সেসঙ্গে অন্য রাজনৈতিক দলগুলোও শিক্ষা পেত।
ফলে ভবিষ্যতে আর কোনো রাজনৈতিক দল এই ধরনের হঠকারী সিদ্ধান্ত জনগণের ওপর চাপিয়ে দেয়ার সাহস পাবে না। কিন্তু বাস্তবে তেমনটা ঘটার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। কেননা আমজনতা ভবিষ্যৎ পরিণতির কথা বিবেচনায় না নিয়ে শুধু নগদ অর্থপ্রাপ্তির কৃতজ্ঞতাস্বরূপ নেচে নেচে ভোট দিয়ে লিবারাল সরকারের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিশ্চিত করে দেব! এর ফলে অপরাজনীতির চর্চাই অনুপ্রাণিত হবে যা ক্রমান্বয়ে খারাপ থেকে খারাপের দিকেই যাবে। যেমনটা আমাদের দেশের সামরিক এবং অগণতান্ত্রিক সরকারগুলো করেছে। আমাদের দেশে সেসব অবৈধ সরকার দীর্ঘদিন এই অপরাজনীতি অনুসরণ করে পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে নিয়ে গেছে যে, এখন শত চেষ্টা করেও সুস্থ গণতান্ত্রিক ধারা পুরোপুরি ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়ে উঠছে না। রাজনীতির যে প্রবণতা উন্নত বিশ্বে শুরু হয়েছে তাতে সেদিন আর বেশি দূরে নেই যখন অপরাজনীতি এখানেও জেঁকে বসবে!
লেখক: ব্যাংকার, কলাম লেখক। কানাডাপ্রবাসী