বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

পৃথিবী গোল না হয়ে সমতল হলে কী হতো?

  •    
  • ২৮ জুলাই, ২০২১ ১৮:৩০

বিশ্বে এমন অসংখ্য লোক আছেন যারা বিশ্বাস করেন, পৃথিবী গোল নয়, ফ্ল্যাট বা সমতল। তাদের ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ হলো, বিজ্ঞান ও আধুনিক মিডিয়া চক্রান্ত করে কখনও দেখাবে না যে, পৃথিবীর আকৃতি আসলে সমতল।

পৃথিবী সৌরজগতে সূর্য থেকে দূরবর্তী তৃতীয় গ্রহ। অন্যসব গ্রহের মতোই এটি নিজ অক্ষের ওপর ঘুরছে। প্রাণের বিকাশ ঘটা গ্রহটির আকার কমলালেবুর মতো, অর্থাৎ বৃত্তাকার দেহের মেরু দেশ কিছুটা চাপা। এটা একেবারে ছেলেবেলার বিজ্ঞান বইয়ের জ্ঞান।মজার বিষয় হলো, বিশ্বে এমন অসংখ্য লোক আছেন যারা বিশ্বাস করেন, পৃথিবী গোল নয়, ফ্ল্যাট বা সমতল। তাদের ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ হলো, বিজ্ঞান ও আধুনিক মিডিয়া চক্রান্ত করে কখনও দেখাবে না যে, পৃথিবীর আকৃতি আসলে সমতল। এই মত সমর্থন করা তাত্ত্বিকদের নিয়ে দুনিয়া জুড়ে গড়ে উঠেছে অসংখ্য ‘ফ্ল্যাট আর্থারস সোসাইটি’।এই ফ্ল্যাট আর্থারদের উদ্ভট দাবি যদি সত্যি হতো, অর্থাৎ পৃথিবী যদি সত্যিই সমতল হলে কেমন হতো? এই প্রশ্নের জবাব খুঁজেছে বিজ্ঞানবিষয়ক জনপ্রিয় সাইট সায়েন্স অ্যালার্ট। পাঠকদের তারা একটি ধারণা দেয়ার চেষ্টা করেছে, সমতল পৃথিবীর বৈশিষ্ট্য কেমন হতো তা নিয়ে।১. বিদায় নিত অভিকর্ষ

বৃত্তাকার পৃথিবীতে সব জায়গায় সব বস্তুর ওপর অভিকর্ষ বলের প্রভাব সমান। সমতল পৃথিবীতে অভিকর্ষের কোনো প্রভাব থাকতো না। কারণ অভিকর্ষ থাকলে সেটার টানেই পৃথিবী বৃত্তাকার হয়ে যেত।১৮৫০ এর দশকে গণিতবিদ জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল হিসাব করে দেখান, সত্যিকার অভিকর্ষ বলের ক্ষেত্রে সমতল পৃথিবীর ধারণাটা টেকে না। যে কারণে সমতল পৃথিবীতে অভিকর্ষ বল কাজ না করার সম্ভাবনাই বেশি।

আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশনের বাইরে অভিকর্ষ শূন্য পরিবেশে কাজ করছেন দুই নভোচারী। ছবি: এএফপি

অথবা চাকতি আকৃতির সমতল পৃথিবীতে অভিকর্ষ সবকিছুকে কেন্দ্র বা উত্তর মেরুর দিকে টানবে। তেমনটা হলে, কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির লামোন্ট-ডর্টি আর্থ অবজারভেটরির ভূতত্ত্ববিদ জেমস ডেভিসের মতে, উত্তর মেরু থেকে আপনি যতটা দূরে থাকবেন আপনার প্রতি চাকতির কেন্দ্রের দিকে সমান্তরাল অভিকর্ষের প্রভাব ততটা বেশি থাকবে। বিশ্বজুড়ে এটা একটা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে।তবে লং জাম্পের বিশ্বরেকর্ড খুব সহজেই ভাঙা যাবে (যদি আপনি উত্তরের দিকে মুখ করে লাফ দেন)।২. বায়ুমণ্ডলের অস্তিত্ব থাকত না

অভিকর্ষ বল না থাকলে চাকতি পৃথিবী এর চারদিক ঘিরে রাখা গ্যাসের স্তর যা বায়ুমণ্ডল নামে পরিচিত, তাকে ধরে রাখতে পারত না। অভিকর্ষের কারণেই এই আবরণটি আমাদের গ্রহকে ঘিরে থাকে। এই সুরক্ষা বলয় ছাড়া পৃথিবীর আকাশের রঙ হবে কালো। কারণ সূর্যের আলো পড়ার পর প্রতিসরিত হওয়ার আর কোনো মাধ্যম থাকবে না, যার কারণে আমাদের বহু পরিচিত নীল আকাশ আর দেখা যাবে না।বিবিসির সায়েন্স ফোকাসে প্রাণিবিদ লুইস ভিলাজোন লিখেছেন, বায়ুমণ্ডলের চাপ না থাকায় মহাকাশের শূন্যতায় উন্মোচিত হবে গাছ ও সব জীব। নিঃশ্বাস নিতে না পারার কারণে সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুবরণ করবে সব প্রাণি ও উদ্ভিদ।

নাসার আঁকা ছবিতে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে মিথেন গ্যাসের অস্তিত্ব। ছবি: এএফপি

গ্রহের চারদিকে বায়ুমণ্ডল না থাকলে, পৃথিবীপৃষ্ঠের পানি বাষ্পীভূত হয়ে মহাশূন্যে উড়ে যাবে। কারণ এর বাষ্পের চাপ পৃথিবীর বায়ুচাপের সমান হলে পানি ফুটতে শুরু করে। নিম্ন বায়ুমণ্ডলের চাপ মানে, পানির স্ফূটনাঙ্কও কমে আসবে।গ্রহকে উষ্ণ রাখার মতো বায়ুমণ্ডল চারদিকে না থাকলে, ভূ-পৃষ্ঠের তাপমাত্রা হ্রাস পাবে ও অবশিষ্ট পানি জমে যাবে।

তবে সবই যে খারাপ হবে তা কিন্তু নয়। গভীর সমুদ্রের কিমোসিন্থেটিক ব্যাকটিরিয়ার মতো অনুজীব, যাদের বেঁচে থাকতে অক্সিজেন প্রয়োজন হয় না, তারা টিকে থাকবে। সে ধরনের ব্যাকটিরিয়াগুলো মহাকাশে যাত্রা করেও ফিরে এসেছে। ৩. বৃষ্টি হতো আনুভূমিক

পৃথিবীর চাকতির কেন্দ্র বা উত্তর মেরুর দিকে যদি অভিকর্ষ বল কাজ করে, তাহলে বৃষ্টিও সেদিকে হবে। এর কারণ হচ্ছে, অভিকর্ষের জন্যে বৃষ্টি পৃথিবীতে পড়ে। একই কারণে অভিকর্ষের টান সবচেয়ে শক্তিশালী যেদিকে হবে, সেদিকেই বৃষ্টিপাত হবে।একমাত্র চাকতির কেন্দ্রেই বায়ুমণ্ডল আমরা সাধারণ পৃথিবীতে যেমনটা দেখি তেমন আচরণ করবে, অর্থাৎ বৃষ্টি ওপর থেকে নিচে পড়বে। কেন্দ্র থেকে যতটা দূরে যাওয়া যাবে, বৃষ্টি ততটা সমান্তরাল হতে থাকবে।

যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টায় টেনিস সেন্টারের বাইরে বৃষ্টিপাত। ছবি: এএফপি

কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির লামোন্ট-ডর্টি আর্থ অবজারভেটরির মতে, নদী এবং সমুদ্রের পানিও উত্তর মেরুতে প্রবাহিত হবে। যার অর্থ বিশাল সমুদ্রগুলো গ্রহের কেন্দ্রস্থলে জমা হবে ও প্রান্তের দিকে কার্যত কোনো পানি থাকবে না।৪. আমরা সবাই পথ হারিয়ে ফেলতাম

পৃথিবী চাকতির মতো হলে এর কোনো স্যাটেলাইট থাকবে না, কারণ কোনো কক্ষপথ থাকবে না তাদের। জেমস ডেভিস বলেন, ‘আমাদের সামাজিক জীবন নির্ভর করে এমন অনেক স্যাটেলাইট কাজই করবে না। সমতল পৃথিবীতে জিপিএস কীভাবে কাজ করবে সেটা আমার জানা নেই।’

যুক্তরাষ্ট্রের একটি জিপিএস কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট। ছবি: সংগৃহীত

সুপারমার্কেটের একেবারে তরতাজা প্রোডাক্ট পাওয়ার জাস্ট-ইন-টাইম থেকে শুরু করে ভ্রমণের তথ্য ও জিপিএস সার্ভিসের জন্য আমাদের নির্ভর করতে হয় গ্লোবাল নেভিগেশন স্যাটেলাইট সিস্টেমস (জিএনএসএস) এর ওপর। আরও গুরুত্বপূর্ণভাবে ইমার্জেন্সি সেবাগুলো জিপিএস সিস্টেম ব্যবহার করে কলারের অবস্থান যাচাই করে। এর অর্থ, জীবন বাঁচাতে স্যাটেলাইট যোগাযোগ-ব্যবস্থা ভূমিকা রাখছে।জিপিএসহীন একটি পৃথিবী কল্পনা করা সহজ নয়। বলাই বাহুল্য আমরা হারিয়ে যাব। ৫. কিছু যাত্রা শেষ হতে সারাজীবন লেগে যেত

ভ্রমণের সময় বেড়ে যাবে, এটা কেবল জিপিএস না থাকার কারণেই নয়, যে দূরত্ব অতিক্রম করতে হবে সে জন্যেও। সমতল-পৃথিবীর বিশ্বাস অনুসারে, আর্কটিক গ্রহের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত, আর অ্যান্টার্কটিকা পৃথিবীর চারপাশে একটি বিশাল বরফের প্রাচীর গঠন করেছে। এই প্রাচীরটি আক্ষরিক অর্থে মানুষকে পৃথিবী থেকে পড়ে যেতে বাধা দেয়। তবে কেউ যদি উড়তে অক্ষম হন ও বিশ্বজুড়ে উড়ে ভ্রমণ করতে বাধ্য হন তবে ভ্রমণের সময় উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাবে।

চিলির সান্তিয়াগো বিমানবন্দর থেকে উড়ছে একটি যাত্রীবাহী বিমান। ছবি: এএফপি

উদাহরণস্বরূপ, অস্ট্রেলিয়া থেকে (যা ফ্ল্যাট-আর্থ মানচিত্রের একপাশে) অ্যান্টার্কটিকার ম্যাকমারডো স্টেশনে (ফ্ল্যাট-আর্থ মানচিত্রের অন্যদিকে) যেতে, আপনাকে পুরো আর্কটিক, উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার ওপর দিয়ে উড়ে যেতে হবে।অ্যান্টার্কটিকার এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাওয়াটাও মুশকিল হয়ে পড়বে কারণ, চতুর্দিকের বরফের প্রাচীর ভ্রমণকে বাধা দেবে।৬. অরোরা থাকত না, আমরা পুড়ে যেতাম

নাসার মতে, বৃত্তাকার পৃথিবীর ভেতর লোহার তৈরি কেন্দ্রকে ঘিরে ঘুরতে থাকা গলিত ধাতব পদার্থের ঘূর্ণনের জন্য বৈদ্যুতিক প্রবাহ তৈরি হয়। এটি পৃথিবীর এক মেরু থেকে আরেক মেরু পর্যন্ত উপস্থিত চৌম্বকীয় ক্ষেত্র সৃষ্টির মূল কারণ।

সমতল পৃথিবীতে, কোনো নিরেট কেন্দ্র থাকবে না ওইরকম একটা চৌম্বকীয় ক্ষেত্র তৈরি করে সুরক্ষা দেয়াল বা ম্যাগনিটোস্ফিয়ার সৃষ্টি করার জন্য। যার কারণে থাকবে না অরোরাও।

নরওয়ের উনস্তাদের আকাশে নর্দার্ন লাইটস। ছবি: এএফপি

নর্দার্ন লাইটস নামে পরিচিত এই আলোক ছটাগুলো আসলে সূর্য থেকে আসা চার্জযুক্ত কণা ম্যাগনিটোস্ফিয়ারে উপস্থিত অক্সিজেন ও নাইট্রোজেনের কণায় ধাক্কা খাওয়ার ফলে উৎপন্ন হওয়া এনার্জি। তবুও, অরোরার অভাবের চেয়ে বড় মাথাব্যাথা হয়ে দাঁড়াবে সৌর বায়ু থেকে অরক্ষিত হয়ে পড়া পৃথিবী। নাসার মতে, পৃথিবী ও এর পৃষ্ঠের সবকিছুর উপর ক্ষতিকারক সৌর বিকিরণের বর্ষণ হবে। যার কারণে প্রতিবেশী মঙ্গল গ্রহের মতো একটি বন্ধ্যা গ্রহে পরিণত হবে পৃথিবী।

৭. আমাদের সবার আকাশ একরকম হতোসমতল পৃথিবীতে বর্তমান বৃত্তাকার পৃথিবীর মতো বায়ুমণ্ডল বিভক্ত থাকবে না। ফলে উত্তর গোলার্ধ বা দক্ষিণ গোলার্ধে আছি কিনা সেটার ওপর নির্ভর করে দিন বা রাতের তারতম্য হতো না। আর চাকতি আকৃতির গ্রহের যেকোনো জায়গা থেকেই শুধু রাতের আকাশ দেখা যেত।

উরুগুয়ের মন্তেভিদিওর রাতের আকাশে মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির দৃশ্য। ছবি: এএফপি

আমরা যদি রাতের আকাশের একটা অংশই সবসময় দেখতাম তাহলে ভূ-পৃষ্ঠের অনেক আবিষ্কার, যেগুলো পৃথিবী থেকে দৃশ্যমান মহাবিশ্বে আমাদের ৩৬০ ডিগ্রি দেখার সক্ষমতার ওপর নির্ভর করে, হতো না। আমাদের শুধু মহাকাশ-নির্ভর টেলিস্কোপ ব্যবহার করে মহাবিশ্বের দিকে তাকাতে হতো।৮. ঘূর্ণিঝড় বা হারিকেন হতো না

প্রতিবছরই সাইক্লোন, বা হারিকেনে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়। ২০১৭ সালে হারিকেন হার্ভি শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই ১২৭ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি করেছিল। এই সাইক্লোনের ঘূর্ণন তৈরি হয় পৃথিবির কোরিওলিস এফেক্ট থেকে। উত্তর গোলার্ধে সাইক্লোনের ঘূর্ণন ঘড়ির কাঁটার দিকে আর দক্ষিণ গোলার্ধে কাঁটার বিপরীতে।

যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডোর সেন্টার ফর কো-অপারেটিভ রিসার্চ ইন দ্য অ্যাটমস্ফিয়ার প্রকাশিত সাইক্লোন ইয়াসের ছবি। ছবি: এএফপি

সমতল পৃথিবীতে কোনো কোরিওলিস এফেক্ট থাকবে না। যার অর্থ কোনো, হারিকেন, টাইফুন বা সাইক্লোনও থাকবে না। নাসার মতে, এই একই কারণে আমরা বিষুবরেখার ৫ ডিগ্রি উত্তর বা দক্ষিণে কখনই এই ধরনের ঝড় দেখি না, কারণ বিষুবরেখা বরাবর কোরিওলিস এফেক্ট শূন্য।

এ বিভাগের আরো খবর