আমাদের অতিপরিচিত একক সময়। সময় অতিবাহিত হয়, এর সম্বন্ধে এছাড়া আমরা খুব বেশি একটা কিছু জানি না। বিজ্ঞানভিত্তিক ওয়েবসাইট সাইন্সঅ্যালার্ট এক প্রতিবেদনে সময়ের বৈশিষ্ট্য, প্রকৃতি ও পরিবর্তনের নানা দিক তুলে ধরেছে। নিউজবাংলার পাঠকদের জন্য প্রতিবেদনটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন রুবাইদ ইফতেখার।
সময় বিষয়টি সবার অতিপরিচিত হলেও একে ব্যাখ্যা করা বেশ কঠিন। সাধারণভাবে মনে করা হয়, সময় হলো একজন ব্যক্তির অবস্থান থেকে চারপাশের অবিরাম ও ধারাবাহিক পরিবর্তনের পরিমাপক।
আমাদের চোখের সামনে অনবরত ঘটনাপ্রবাহ; আমাদের গ্রহের চারপাশে চাঁদের আবর্তন, এসব থেকে সময়ের ধারণা পাওয়া গেলেও এর মৌলিক বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করা বেশ জটিল।
এমনকি পদার্থবিদেরাও নিশ্চিত নন সময় অতিবাহিত হলে কী হয়। এ নিয়ে তাদের কিছু হাইপোথিসিস আছে।
সময় কীভাবে কাজ করে?
শত শত বছর ধরে সময়কে ধরা হয়েছে ধ্রুবক, স্বাধীন এক শক্তি, যেন পুরো মহাবিশ্বের অগ্রগতি মাপা হচ্ছে একটি নির্দিষ্ট ঘড়িতে।
সময়ের এই ধারণা পালটে যায় ১৯০৫ সালে আলবার্ট আইনস্টাইনের স্পেশাল থিওরি অফ রিলেটিভিটির মাধ্যমে।
সময়ের বহমানতা স্পেসের (স্থান) সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত এই ধারণা এককালে প্রচলিত ছিল। কিন্তু আইনস্টাইনের যুগান্তকারী থিওরি প্রথমবারের মতো স্পেস ও টাইমকে (স্থান-কাল) সমন্বয় করে একটি একক পরিসরে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়। যার পরিমাপ এর মধ্যে থাকা বস্তুর আপেক্ষিক গতি বা মহাকর্ষীয় শক্তির উপর নির্ভর করে পরিবর্তিত হয়।
যার মানে দাঁড়াচ্ছে সময় আপেক্ষিক।
সময় কি বাস্তব?
একই গতিতে এগোতে থাকা দুজন ব্যক্তি এটা মেনে নেবেন যে, তাদের পার হওয়া দূরত্ব ও সময়ের পরিমাপ সমান। তবে একজন যদি গতি পরিবর্তন করেন তাহলে তিনি অপরজনের সময় ও দূরত্ব পরিবর্তিত হতে দেখবেন।
ফলে এক্ষেত্রে একজনের সঙ্গে অন্যজনের অবস্থান বিবেচনায় নিলে দেখা যাবে সময় মোটেও স্থির সার্বজনীন কোনো একক নয়। এটি একটি আপেক্ষিক পরিমাপ যা বস্তুর দ্রুত বা ধীর গতিতে চালিত হওয়া বা তাদের অভিকর্ষণ বল কম-বেশি হওয়ার উপর নির্ভরশীল।
অভিকর্ষ বল স্পেস ও টাইমকে বাঁকিয়ে দিতে পারে; অভিকর্ষ বল যত শক্তিশালী হবে ততোই এটি স্পেস-টাইমকে বাঁকা করতে পারবে, এবং সময় ততো ধীরে চলতে থাকবে।
এই কারণেই পৃথিবীর মধ্যাকর্ষণ থেকে দূরে ঘুরপাক খাওয়া ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশনে নভোচারীরা পৃথিবীর তুলনায় কিছুটা ধীরে বুড়ো হন।
সময়কে উল্টোমুখী করা সম্ভব?
গতি বা মহাকর্ষীয় টানে সময়ের গতি ধীর হওয়ার বিষয়টি সাদা চোখে পরিমাপ করা বেশ কঠিন। তবে আলোর বেগে কেউ ছুটতে পারলে তার কাছে সময়ের গতি অনেক কমে আসার বিষয়টি প্রকটভাবে ধরা দেবে।
তাত্ত্বিতভাবে, আলোর গতিতে এগোতে থাকা কোনো বস্তুর ক্ষেত্রে দেখা যাবে সেখানে ‘ঘড়ি’ ধীর গতিতে চলছে। আলোর বেগের চেয়ে দ্রুত গতিতে এগোতে থাকলে, তাত্ত্বিকভাবে সেই ঘড়িটি চলবে আমাদের অবস্থান থেকে উলটো দিকে, আর ওই বস্তুটির অবস্থান থেকে আমাদের ঘড়ি উল্টোভাবে চলবে।
টাইম ট্র্যাভেল কি সম্ভব?
একটি ব্ল্যাকহোলের প্রান্তসীমার বাইরের স্পেসে সংকুচিত আয়তন, সময়ের প্রবাহকেও পুনর্বিন্যাস করে।
মহাবিশ্বে স্পেসে আমাদের অবস্থানগত বিভিন্ন স্বাধীনতা আছে। ইচ্ছেমতো বিচরণ আমরা করতে পারি, তবে সময়ের একটি একমুখী স্রোতে চলতে আমরা বাধ্য।
গাণিতিক হিসাবে দেখা গেছে, ব্ল্যাক হোলের প্রান্তসীমা অতিক্রম করলে ভেতরে ঢোকা গেলে সেখানে সময় হবে অনড়। ফলে সময়ের সঙ্গে ছুটে চলার বাধ্যবাধকতা থাকবে না, তবে সেই সঙ্গে বাজে বিষয়টি হলো, আমরা তখন স্পেসে বিচরণের স্বাধীনতাও হারাব। এটা অনেকটা টাইম ট্র্যাভেলের মতো।
এই দৃশ্যপট আমাদের সময়ের প্রকৃতি সম্বন্ধে ভালো ধারণা দিলেও, আলোর গতি ও ব্ল্যাক হোলে ভ্রমণে সীমাবদ্ধতা, সময়কে বিপরীতমুখী করার বাস্তবসম্মত উপায় বের করা থেকে আমাদের বিরত করছে।
কেন অতীত ও ভবিষ্যত বিদ্যমান?
স্পেস-টাইম মডেল এক বিন্দু থেকে আরেক বিন্দুতে টাইম ও স্পেসের পরিমাপ দিতে পারে, কিন্তু এগুলো ঘটনার ধারাবাহিকতা নিয়ে সময়ের একগুঁয়ে বাধ্যবাধকতা সম্পর্কে কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারে না।
সময়ের এই বর্ণনা অনুযায়ী, আমাদের মহাবিশ্ব স্পেস-টাইমের একটি একক খণ্ড। এটার একটা শুরু আছে, বিগ ব্যাং। যার আগে আমাদের পদার্থবিজ্ঞানের জ্ঞান প্রয়োগ করা যায় না।
এর একটা শেষও আছে, যখন পরিবর্তনকে আর গুরুত্বের সঙ্গে পরিমাপ করা যাবে না। কিন্তু ‘বর্তমান’ বলে আসলে সময়ের কোনো স্লাইসকে বাস্তবিকভাবে নির্দেশ করা সম্ভব নয়।
এই প্রসঙ্গে আইনস্টাইন লিখেছেন, ‘আমাদের মতো মানুষ যারা পদার্থবিদ্যায় বিশ্বাস করে তারা জানেন যে, অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত অবিরাম এক বিভ্রান্তি মাত্র।’
কসমোলজি ছাড়াও পদার্থবিজ্ঞানের কয়েকটি ক্ষেত্রে সময় রহস্যের কয়েকটি সূত্র থাকতে পারে। যেমন, ১৮৭০ এর দশকে অস্ট্রিয়ান পদার্থবিদ লুডভিগ বোল্টসমান একটা সূত্র প্রস্তাব করেন যেখানে বলা হয় সময়ের সঙ্গে মহাবিশ্বে বাড়তে থাকা বিশৃঙ্খলার যোগাযোগ রয়েছে।
থার্মোডিনামিকসে (তাপগতিবিদ্যা) সময়ের একদিকে ধাবিত হওয়ার এনট্রপির মূলনীতির সঙ্গে এই সূত্রটিতে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করা হয়, কেন সময় সামনে ধাবিত হয়; এর কারণ হয়তো আমাদের মহাবিশ্ব একটা ক্ষুদ্র এনট্রপি ও নিবিড়ভাবে সংযুক্ত শিশু মহাবিশ্ব থেকে উচ্চ বিশৃংখলা সম্পন্ন, বিস্তৃত ও ভবিষ্যতের দিকে ধাবিত একটি মহাবিশ্বে পরিণত হয়।
কীভাবে সময়কে ধীর করা সম্ভব
মহাকাশে ভ্রমণ ও পৃথিবীর মধ্যাকর্ষণ ক্ষেত্র থেকে দূরে থাকা অবস্থাতেও, নিজ আবস্থান থেকে সময়কে ধীর করার একটা উপায় আছে। এর সঙ্গে পদার্থবিদ্যা ও সময়ের প্রকৃতির কোনো সম্পর্ক নেই। এটা আমাদের জীবন কত দ্রুত বা ধীরগতিতে যাচ্ছে তার সঙ্গে সম্পর্কিত।
কয়েকজন গবেষক বলেছেন, নিজেকে নতুন অভিজ্ঞতা বা পরিবেশের মুখোমুখি করালে সময়কে ধীর মনে হতে পারে। আমাদের মস্তিস্ক যে পরিমাণ তথ্য গ্রহণ ও প্রক্রিয়াজাত করতে পারে তার সঙ্গে এটি সম্পর্কযুক্ত। যখন আমরা তরুণ বা নতুন কিছু শিখছি তখন পৃথিবী ধীর হয়ে যায় বলে মনে হয়। আমাদের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে একটা নিয়মে অভ্যস্ত হয়ে পড়ি, যাতে মনে হয় দিন ও বছর দ্রুতবেগে অতিবাহিত হচ্ছে।
মহাকাশযান ছাড়া আসলে এগুলোর কোনোটাই আপনার বুড়ো হওয়ার প্রক্রিয়া ধীর করতে পারবে না। তবে আমরা অনেকে যেমনটা ভাবি তার চেয়েও সময়কে কিছুটা বাঁকানো সম্ভব। এর মানে হলো, স্বল্প পরিমাণ হলেও নিজেদের দিনগুলো কত দ্রুত যাচ্ছে সেটা পরিবর্তন করার সামর্থ্য আমাদের আছে।