সভ্যতার ইতিহাসে বেশ কয়েকটি মহামারি হয়েছে, কিন্তু করোনা মহামারির যে প্রভাব, তা সর্বকালের রেকর্ড ছাড়িয়েছে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বলেছে, ১৯৩০ সালের পর এমন কঠিন সময় আর কখনও দেখেনি বিশ্ববাসী।
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে বিপর্যস্ত বিশ্ব অর্থনীতির পাশাপাশি পাল্টে যায় বাংলাদেশের অর্থনীতির সব হিসাব-নিকাশও।
একদিকে জীবন রক্ষার প্রাণান্তকর চেষ্টা, অন্যদিকে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের লড়াই– এই দুই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা করেছিলেন অর্থনৈতিক প্রণোদনা প্যাকেজ।
যদি বলা হয় ২০২০ সালে করোনাকালীন বাংলাদেশের অর্থনীতির সবচেয়ে বড় ও আলোচিত ঘটনা কী, সবাই একবাক্যে স্বীকার করেন ‘প্রণোদনা প্যাকেজ’।আরও পড়ুন: দ্বিতীয় প্রণোদনার পরিকল্পনা চাইলেন প্রধানমন্ত্রী
করোনার প্রভাবে দেশের অর্থনীতি যে ক্ষতির শিকার হয়েছে, তা কাটাতেই বিশাল এ প্যাকেজ বাস্তবায়নের উদ্যাগ নেয়া হয়।
বিভিন্ন ধাপে এ পর্যন্ত মোট ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকার ২১টি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে, যা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৩ দশমিক ৭ শতাংশ।
এই প্যাকেজের বড় একটি অংশ আর্থিক খাতের প্রণোদনা। এতে জড়িত আটটি খাতে বাস্তবায়নাধীন অর্থের পরিমাণ প্রায় ৮৬ হাজার কোটি টাকা।
করোনার কারণে কয়েক মাস থমকে গেলেও আবার পুরোদমে শুরু হয়েছে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। ছবি: নিউজবাংলা
অবশিষ্ট অর্থ দুস্থদের জন্য এককালীন নগদ সহায়তা, ত্রাণ বিতরণ, খাদ্য সহায়তা কর্মসূচি ও কভিড-১৯ প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম কেনাকাটা ও চিকিৎসা সেবায় ব্যয়ের পরিকল্পনা নেয়া হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট বিভাগ এসব প্যাকেজ বাস্তবায়ন করছে। তবে আর্থিক খাতের সব প্যাকেজই বাস্তবায়ন করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
অর্থনীতিবদেরা বলেছেন, এ প্রণোদনা প্যাকেজ অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের টিকা বা ভ্যাকসিন হিসেবে কাজ করেছে, যে কারণে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, ব্যবসা-বাণিজ্য প্রাণ ফিরে পেয়েছে। তবে প্যাকেজটি বাস্তবায়নে কিছু সমস্যা আছে বলেও মনে করেন তারা।
তাদের মতে, উদীয়মান অর্থনীতির দেশ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া বাংলাদেশ উচ্চ প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতায় এগোচ্ছিল। কিন্তু করোনায় এ অর্জনে বড় ধরনের ধাক্কা লেগেছে। সময়মতো প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করায় সামলে উঠছে পরিস্থিতি এবং সঠিক পথেই এগুচ্ছে বাংলাদেশ।আরও পড়ুন: দক্ষিণ এশিয়ায় মাথাপিছু জিডিপির শীর্ষে বাংলাদেশ
করোনার ভেতরে গত ১১ জুন যে বাজেট ঘোষণা করে সরকার, তাতেও অর্থনীতি গতিশীল করতে নানা পদক্ষেপ নেয়া হয় ।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেন, করোনাকালীন এবারের বাজেটের উদ্দেশ্য হচ্ছে ‘অথনৈতিক উত্তরণ এবং ভবিষ্যৎ পথ পরিক্রমা’।
সরকারঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ যাতে সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হয়- সেদিকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে বাজেটে।
করোনায় অন্য দেশগুলোর তুলনায় কম ধাক্কাই খেয়েছে বাংলাদেশ। থেমে নেই দেশটির অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা। ছবি: নিউজবাংলা
বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ,আইএমএফসহ উন্নয়ন সহযোগীরা করোনার মধ্যে বাংলাদেশর অর্থনীতির অগ্রগতির প্রশংসা করেন।
করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলায় নতুন করে বাড়তি প্রণোদনা দেয়ার দাবি উঠেছে তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ-এর পক্ষ থেকে।
সম্প্রতি রাজধানীতে বিজিএমইএ আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুন্সী এ বিষয়ে আশ্বাস দিয়ে বলেন, বিষয়টি সক্রিয় বিবেচনা করছে সরকার।
যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাবেক ঊর্ধ্বতন পরিচালক ও অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখত নিউজবাংলাকে বলেন, প্রণোদনা প্যাকেজ অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে সহায়ক ভূমিকা রেখেছে। পুরোপুরি সুফল পেতে হলে আরও সময় অপেক্ষা করতে হবে।আরও পড়ুন: প্রণোদনা প্যাকেজ: কোন খাতে কত ছাড়
বিভিন্ন দেশের সরকারও নিজস্ব অর্থনীতি বাঁচাতে প্রণোদনা দিয়েছে।
২০ লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে ভারতের মোদি সরকার। এটি সে দেশের মোট জিডিপির ১০ শতাংশ। প্যাকেজের অঙ্কের দিক থেকে বিশ্বের মধ্যে এটি হচ্ছে তৃতীয়, যদিও ভারতের অর্থনীতি এখনো ঝুঁকির মধ্যে।
অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে সবচেয় বড় প্যাকেজ ঘোষণা করে যুক্তরাষ্ট্র; এর পরিমাণ ৯০ হাজার ৮০০ কোটি (৯০৮ বিলিয়ন) ডলার। যুক্তরাজ্য সরকার প্রায় ২০ হাজার কোটি ডলারের প্রণোদনা প্যাকেজ দিয়েছে।
করোনা-পরবর্তী গত জুন পর্যন্ত ঝুঁকির মধ্যে ছিল দেশের রপ্তানি খাত। এরপর থেকে ঘুরে দাঁড়িয়েছে বিশেষ করে রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশ অবদান রাখা এই খাত। সবশেষ চলতি অর্থবছরে নভেম্বরে প্রবৃদ্ধি বা আয় বেড়েছে গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় সাড়ে চার শতাংশ।
করোনা-পরবর্তী অর্থনীতির দুটি সূচকে অভাবনীয় সাফল্য লক্ষ্যণীয়। ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ অতীতের সব রেকর্ড ছাপিয়ে ৪ হাজার ২০০ কোটি ডলারে ( ৪২ বিলিয়ন) পৌঁছেছে।
আরও পড়ুন: রিজার্ভ ৪ হাজার ২০০ কোটি ডলার ছাড়াল
প্রবাসী আয় তথা রেমিট্যান্স ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে, নভেম্বরও রেকর্ড রেমিট্যান্স এসেছে।
সরকারের প্রধান আয়ের উৎস রাজস্ব আহরণ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত শোচনীয় অবস্থায় থাকলেও অক্টোবর এবং নভেম্বরে প্রবৃদ্ধি ইতিবাচক হয়েছে।
করোনার টিকা ক্রয়ে বিশ্বব্যাংক, এডিবি ও আইএমএফের প্রতিশ্রুত সহায়তা আসতে শুরু করায় বিদেশি সাহায্য ক্রমান্বয়ে বাড়ছে বলে জানান অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের কর্মকর্তরা। ফলে সামগ্রিকভাবে করোনার ধাক্কা সামলে এগিয়ে যাচ্ছে অর্থনীতি।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নিবার্হী পরিচালক ও আইএমএফের সাবেক কর্মকর্তা ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, প্রণোদনা প্যাকেজের ইতিবাচক প্রভাব অবশ্যই আছে। এর ফলে প্রাণ ফিরেছে অর্থনীতির। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ও সামাজিক সুরক্ষায় আরও বেশি নজর দেয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি শামস মাহমুদ বলেন, প্রণোদনা প্যাকেজের ফলে দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। প্যাকেজের পূর্ণ বাস্তবায়ন হলে আরো গতি বাড়বে অর্থনীতির।
ঋণনির্ভর এই প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নে কিছু সমস্যার কথা বলছেন অর্থনীতিবিদেরা। অবশ্য ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্ট মহলের সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এরই মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্যাকেজের আকার স্ফীত এবং ঋণ বিতরণের শর্ত শিথিল করেছে সরকার।
তারপরেও ক্ষুদ্র, অতিক্ষুদ্র ও মাঝারি খাত কৃষিঋণ, নিম্ন আয় ও প্রান্তিক চাষি, প্রি-শিপমেন্ট ক্রেডিট স্কিমসহ অন্যান্য খাতে ঋণ বিতরণের চিত্র সন্তোষজনক নয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সবশেষ পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত এসএমই খাতের ২০ হাজার কোটি টাকার মধ্যে ৪৯ শতাংশ ছাড় হয়েছে।
অথচ, বড় ব্যবসায়ীদের জন্য ৪০ হাজার কোটি টাকার তহবিলের পুরোটাই এরই মধ্যে শেষ হয়ে গেছে।
কৃষিখাতে পুনঃঅর্থায়ন স্কিমের আওতায় নভেম্বর পর্যন্ত মোট ঋণের ৫১ শতাংশ বিতরণ হয়েছে। এর পরিমাণ দুই হাজার ৫৬৬ কোটি টাকা। প্রান্তিক ব্যবসায়ীদের ঋণ বিতরণ হয়েছে মাত্র ৩২ শতাংশ।