বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

বর্ণবিদ্বেষ নিয়েও সচেতনতা চান বিশেষজ্ঞরা

  •    
  • ৭ ডিসেম্বর, ২০২১ ১৬:৩০

সমাজবিজ্ঞানী ও অধিকারকর্মীরা বলছেন, নারীর মর্যাদা নিশ্চিতের পাশাপাশি বর্ণবাদ ও বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর প্রতি ঘৃণামূলক আচরণ ও শব্দের বিরুদ্ধেও সোচ্চার হওয়ার সময় এসেছে। বন্ধ করতে হবে ‘কালো তালিকা’ বা ‘কালো হাত’-এর মতো শব্দের প্রয়োগ।

নারীর প্রতি ‘অবমাননাকর’ মন্তব্য করে মন্ত্রিত্ব হারিয়েছেন ডা. মুরাদ হাসান। তার বিরুদ্ধে বর্ণবাদী শব্দ ব্যবহারের অভিযোগও উঠেছে।

গত ১ ডিসেম্বর রাতে ‘অসুস্থ খালেদা, বিকৃত বিএনপির নেতাকর্মী’ শিরোনামে এক ফেসবুক লাইভে যুক্ত হন মুরাদ হাসান। সেখানে বিএনপির রাজনীতি সমালোচনার একপর্যায়ে দণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামি ও দলটির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কন্যা জাইমা রহমানকে নিয়ে তিনি বিভিন্ন অশালীন মন্তব্য করেন। এ সময় আফ্রিকান-আমেরিকান জনগোষ্ঠীর প্রতি বিদ্বেষমূলক মন্তব্যও ছিল মুরাদের কণ্ঠে।

সমাজবিজ্ঞানী ও অধিকারকর্মীরা বলছেন, জেন্ডার সংবেদনশীলতার পাশাপাশি বর্ণবাদ ও বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর প্রতি ঘৃণামূলক আচরণ ও শব্দ প্রয়োগের বিরুদ্ধেও সোচ্চার হওয়ার সময় এসেছে।

আন্তর্জাতিক পরিসরেও বর্ণবাদী শব্দ ব্যবহার না করার নীতি গ্রহণ করছে বিভিন্ন রাষ্ট্র। টেকজায়ান্ট প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংস্থাও এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি সতর্ক। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হলেও শব্দের বর্ণবাদী ব্যবহার নিয়ে সচেতন হতে হবে।

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্সভিত্তিক সাইট ভাইসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নভেম্বরের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রের সরকার বিতর্কিত স্পাইওয়্যার প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান এনএসও-এর পণ্য বিক্রি ঠেকাতে প্রতিষ্ঠানটি বিশেষ তালিকাভুক্ত করে। খবরটি প্রচারের সময় নিউ ইয়র্ক টাইমস, দ্য গার্ডিয়ান, রয়টার্স ও সিএনএনের মতো সংবাদমাধ্যমে ব্যবহার করা হয় ‘ব্ল্যাকলিস্ট’ বা ‘কালো তালিকাভুক্ত’ করার মতো বর্ণবাদী শব্দ। এই শব্দ ব্যবহারের সমালোচনা চলছে যুক্তরাষ্ট্রেই।

গুগলের প্রোডাক্ট সিকিউরিটি স্ট্র্যাটেজির গ্লোবাল হেড ও অনলাইন নিরাপত্তা নিয়ে অধিকারমূলক সাইট শেয়ার দ্য মাইক ইন সাইবার ক্যামিলা স্টুয়ার্ট কারেন্ট ভাইসকে বলেন, ‘ব্ল্যাকলিস্ট' কালোকে খারাপের সঙ্গে এবং সাদাকে ভালোর সঙ্গে সম্পর্কিত করে। বর্ণবাদের শিকড় যে কত গভীরে সেটি এ ধরনের শব্দ প্রয়োগ থেকে বোঝা যায়।’

তবে অনেক টেক জায়ান্ট ‘ব্ল্যাকলিস্ট’ বা ‘হোয়াইটলিস্ট’-এর মতো শব্দের ব্যবহার বন্ধে পদক্ষেপ নিচ্ছে। মাইক্রোসফটের এজ ও গুগলের ক্রোম ব্রাউজারের ওপেন সোর্স কোড ক্রোমিয়ামের ডেভেলপাররা ২০১৯ সালে ঘোষণা করেন, কালো=খারাপ এবং হোয়াইট=ভালো এমন ধারণাকেই জোরদার করে ‘ব্ল্যাকলিস্ট’ ও ‘হোয়াইটলিস্ট’। এ কারণে ডেভেলপাররা এখন ‘ব্লকলিস্ট’ ও ‘অ্যালাউলিস্ট’ শব্দ ব্যবহার করছেন। বিশ্বজুড়ে অন্যতম জনপ্রিয় প্রোগ্রামিং ল্যাংগুয়েজ পাইথন ২০১৮ সালে বর্ণবাদী শব্দগুলোর ব্যবহার বন্ধ করে দিয়েছে।

যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল সাইবার সিকিউরিটি সেন্টার (এনসিএসসি) গত বছর এক ব্লগ পোস্টে জানায়, ‘ব্ল্যাকলিস্ট’ ও ‘হোয়াইটলিস্ট’ পরিভাষাতে তীব্র বর্ণবাদ রয়েছে। এ ধরনের শব্দ মানসিকভাবে এমন ধারণা দেয় যাতে মনে হতে পারে, সাদা মানেই ভালো ও নিরাপদ; আর কালো মানে খারাপ, বিপজ্জনক ও নিষিদ্ধ। ‘ব্ল্যাকলিস্ট’-এর পরিবর্ত ‘ব্লকলিস্ট’ বা ‘ডিনাইলিস্ট’ শব্দ ব্যবহারের পক্ষে মত দিয়েছে এনসিএসসি।

যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেকনোলজি (এনআইএসটি) চলতি বছরের শুরুতে পরিভাষার নতুন নির্দেশিকা প্রকাশ করে। সেখানে ‘ব্ল্যাকলিস্ট/হোয়াইটলিস্ট’-এর মতো পক্ষপাতমূলক শব্দ ব্যবহার নিরুৎসাহিত করা হয়েছে।

আরেক সংস্থা ইঞ্জিনিয়ারিং টাস্ক ফোর্স ২০১৮ সালে এক নথিতে উল্লেখ করে, ‘প্রভু-দাসের মতো, ভালো-মন্দ বোঝাতে সাদা-কালোর রূপক ব্যবহার আক্রমণাত্মক। প্রভু-দাসকে বর্ণবাদের গুরুতর উদাহরণ বলে মনে হলেও সাদা-কালো আরও খারাপ শব্দ; কারণ এ দুটি শব্দের প্রয়োগ অনেক বিস্তৃত।’

আন্তর্জাতিক পরিসরে বর্ণবিদ্বেষী শব্দ ও ভাষার প্রয়োগ বন্ধ হওয়ার বিভিন্ন উদ্যোগ চলমান, তবে বাংলাদেশে এ ক্ষেত্রে অসচেতনতার মাত্রা প্রকট বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

দেশের সংবাদমাধ্যমসহ প্রাতিষ্ঠানিক বিভিন্ন জায়গায় ‘কালো তালিকা’ একটি বহুল ব্যবহৃত শব্দ। অনিয়মে অভিযুক্ত বা প্রতিপক্ষের ‘কালো হাত’ ভেঙে দেয়ার দাবি তোলা হয় প্রতিটি রাজনৈতিক দলের মিছিলে। এমনকি বিতর্কিত ব্যক্তিকে ‘ইহুদি’র সঙ্গে তুলনা করাও একটি জনপ্রিয় স্লোগান।

সমালোচনার মুখে দায়িত্ব ছাড়তে বাধ্য হওয়া ডা. মুরাদ হাসান ‘খারাপ ব্যক্তির’ প্রসঙ্গ তুলতে গিয়ে এনেছেন আফ্রিকান-আমেরিকান জনগোষ্ঠীকে। তাদের তিনি ‘কৃষ্ণাঙ্গ’ সম্বোধন করেন ফেসবুক লাইভে। এ ছাড়া উপহাসের ভঙ্গিতে ব্যবহার করেন ‘মক্ষীরানি’র মতো শব্দ।

বাংলা ভাষায় বহুল ব্যবহৃত বর্ণবাদী শব্দ নিয়ে প্রশ্নের জবাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. ফাতিমা রেজিনা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘দীর্ঘ বছরের যে ইতিহাস রয়েছে, সেখানে সাদারা কালোদের নির্যাতন করেছে। এখনও আমরা সেখান থেকে বের হয়ে আসতে পারিনি।’

তিনি বলেন, “‘কালো হাত ভেঙে দাও’ বা ‘কালো অধ্যায়’ না বলে ‘অশুভ হাত বা অধ্যায়’ এ রকম শব্দ ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত শব্দ থেকে আমরা রাতারাতি উত্তরিত হতে পারব বলে আমি মনে করি না। সময় লাগবে। তারপরেও বিষয়টিকে যদি আমরা অভ্যাস হিসেবে নিতে পারি তাহলে হবে।”

ফেসবুক লাইভে মুরাদ হাসানের অসংবেদনশীল ও বর্ণবাদী শব্দ প্রয়োগে ভীষণ ক্ষুব্ধ আমরাই পারি পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধ জোটের প্রধান নির্বাহী জিনাত আরা হক।

তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘উনি (মুরাদ) একটি শব্দ ব্যবহার করেছেন, জাইমা কৃষ্ণাঙ্গদের সঙ্গে থাকেন, এটার মানে কী? কৃষ্ণাঙ্গদের সঙ্গে থাকাটা কি অপরাধ? কৃষ্ণাঙ্গ বলতে উনি কী বুঝিয়েছেন? কৃষ্ণাঙ্গরা খুবই খারাপ? কৃষ্ণাঙ্গরা খুবই সেক্সিস্ট? ওদের সঙ্গে খারাপ মেয়েরা থাকে?

‘আমরা কিন্তু এখন কৃষ্ণাঙ্গ শব্দটাই ব্যবহার করি না। আমরা বলি আফ্রিকান-আমেরিকান। আমরা নিগ্রো বলি না। আমরা ব্ল্যাক বলার সময় চিন্তা করি, বলব কি না। কিন্তু উনি অবলীলায় বলে ফেললেন। এটা আমাদের জন্য খুবই দুঃখজনক, হতাশাজনক।'

জিনাত আরা হক বলেন, “উনি (মুরাদ) ‘মক্ষীরানির’ মতো শব্দ বলেছেন। এ ধরনের কথা বলার মধ্য দিয়ে যে নারীরা প্রান্তিক, যে নারীরা অনেক বেশি বিপর্যস্ত, তাদের আরও বিপর্যস্ত করছেন। এই শব্দগুলো আসলে কারা বলে? যারা লেম্যান, যাদের জানাশোনা কম, সমাজে যারা প্রথাগত আচরণ করে তারা বলে।’'

বাংলা ভাষায় বর্ণবাদী বিভিন্ন শব্দ নিয়ে এই অধিকারকর্মী বলেন, ‘এর মূল কারণ হচ্ছে আমাদের ঔপনিবেশিক মন। আমরা জানতাম সাদা মানে ভালো, সুন্দর, প্রগ্রেসিভ ও ইতিবাচক।‘গায়ের রং কেমন জিজ্ঞেস করলে আমরা উত্তরে বলতাম ময়লা। শ্যামলা বলতাম না। এগুলো মাথার মধ্যে গেঁথে গেছে। তবে আমরা এখন এই বর্ণবাদের বিষয়গুলো বুঝতে পারছি। এটা তো এক দিনে হবে না। আমাদের গবেষণা করে বর্ণবাদী শব্দ চিহ্নিত করে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে দূর করতে হবে।’বর্ণবাদী মানসিকতা দূর করতে সংবাদমাধ্যমের ভূমিকার ওপরেও জোর দিচ্ছেন জিনাত আরা হক।তিনি বলেন, “আপনি যখন কোনো মিডিয়া হাউসে কাজ করছেন, তখন আপনাকেই শব্দগুলো বদলাতে হবে। ‘কালো তালিকা’কে অন্যভাবে লিখতে হবে। আমরা যখন কাজ করি তখন বাবা-মার জায়গায় মা-বাবা বলি। বৈষম্য দূর করতে সচেতনভাবে এগুলো করতে হবে। দায়টা আমাদের সবার। সরকারের জায়গা থেকেও বর্ণবাদী শব্দগুলো পরিহার করতে হবে।”কিছু ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটছে বলে মনে করছেন জিনাত। তিনি বলেন, “শিশু ও নারীবিষয়ক স্ট্যান্ডিং কমিটি যখন বলল, ‘ধর্ষিতা’ বলা যাবে না, ‘ধর্ষণের শিকার’ বলতে হবে; এর মানে সরকার থেকেও প্রস্তাব আসছে। এখন যেমন ‘ব্যাটসম্যান’ না বলে বলা হচ্ছে ‘ব্যাটার’। এটা কিন্তু একটা দীর্ঘ আন্দোলনের ফল। এভাবে খুবই পরিকল্পনা মাফিক প্রচেষ্টাগুলো এগিয়ে নিতে হবে।

‘দীর্ঘদিন আমরা মহিলা বলতাম। তবে এখন আমরা নারীতে এসেছি।‘

অ্যাকাডেমিশিয়ান এবং মিডিয়া ও কমিউনিকেশন নিয়ে যারা কাজ করেন তাদের নারী বা বর্ণবিদ্বেষী শব্দ নিয়ে কাজ করা উচিত বলেও মন্তব্য করেন জিনাত আরা হক।

এ বিভাগের আরো খবর