অনলাইনে কনটেন্ট মেকারদের মধ্যে তিনি নতুনদের একজন, তবে জনপ্রিয়তায় পেছনে ফেলে দিচ্ছেন পুরোনোদের।
তিনি অন্য অনেকের মতো অভিনয় করেন না, কোনো উপদেশবাণী নিয়ে আসেন না বা বিশেষ কোনো কসরতেও নেই তিনি। নেত্রকোণার আঞ্চলিক ভাষায় তার গল্পগুলো মিলিয়ন মিলিয়ন ভিও তৈরি করে।
তার পেজের নাম ‘ভাইসাব’। তিনি মাঠে বসে বা হাঁটতে হাঁটতে কথা বলেন সাম্প্রতিক নানা বিষয়ে, কখনো কখনো স্থানীয়দের সঙ্গে করেন কথোপকথন।
সিরিয়াস ভঙ্গিতে তার রসে ভরপুর এসব কথা একবার কেউ শুনতে শুরু করলে বের হয়ে আসা কঠিন।
‘দুইডা কথা বলি। আমি যহনই সময় সুযোগ পাই তহনই দুর্গাপুর, বিরিশিরি আসি অক্সিজেন নেয়নের লাইগ্যা। এইহানকার জল-কাদায় বেড়ে ওঠা ছেলে। নেত্রকোণার দুর্গাপুর, বিরিশিরি সারা বাংলাদেশ, ইন্টারন্যাশনালি সবাই চিনে। যহনই সুযোগ পাই তহনই আসি।
‘এইহানের মানুষের প্রতি আমার দাবি আছে, অধিকার আছে, মাটির প্রতি টান আছে। কিছু দায়দায়িত্বও আছে। খালি দুর্গাপুর বিরিশিরি না, সারা বাংলাদেশের পর্যটনশিল্পের যে বর্তমান পরিস্থিতি এইডা লইয়া দুই-চাইরডা কথাবার্তা কই। শক্ত লাগব, নরম লাগব, না মিষ্টি লাগব, না তিতা লাগব, এইডা আপনেরা বুঝুইন যে।’
এটি পর্যটনশিল্পের সমস্যা, বিকাশ, করণীয় নিয়ে তৈরি ভিডিও কনটেন্টের শুরুর কথা। চার মিনিট দুই সেকেন্ডের এই ভিডিও কনটেন্টটি শেষও করেছেন একইভাবে আঞ্চলিক ভাষার মাধুর্যতার মিশেলে।
আঞ্চলিক ভাষায় এলাকার সমস্যা, সম্ভাবনা, সফলতা, পর্যটন, দুর্ভোগ, যন্ত্রণা, বিনোদন, খেলাধুলা, সচেতনতা বাড়ানোসহ নানা বিষয় তুলে ধরার পাশাপাশি সমাধানের উপায়ও বাতলে দিচ্ছেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘ভাইসাব’ নামের পেজে সামিউল ভূঁইয়া। পাশাপাশি নিতান্তই রসিকতাও করেন তিনি।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফেসবুকে ‘ভাইসাব’ হিসেবে পরিচিত সামিউলএই ভিডিও কনটেন্টগুলোতে কখনও তিনি একাই কথা বলেন, আবার কখনও তিনি এলাকার গ্রামীণ জনপদের তৃণমূল মানুষের সাক্ষাৎকারও তুলে ধরছেন।
সামিউলের বাড়ি নেত্রকোণার কেন্দুয়া উপজেলার গড়াডোবা ইউনিয়নের দেওপাড়া গ্রামে। করোনাকালীন হাতে অলস সময়। সময়টাকে কাজে লাগাতেই এই পেজের যাত্রা শুরু করেন তিনি।
ভাইসাব পেজে একেকটি বিষয় তুলে ধরে আপলোডের পাশাপাশি তা ‘ভাইসাব স্কোয়াড’ নামে পেজ, ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউবে তা আপলোড করা হচ্ছে। এভাবেই সবার কাছে পৌঁছে যাচ্ছে বিষয়ভিত্তিক একেকটি ভিডিও কনটেন্ট।
‘ভাই এবং ভাবিরা কেমন আছেন আপনেরা? মন আপনের আর ভালা রাহার দায়িত্ব ভাইসাবের- এই স্লোগানকে বুকে ধারণ কইর্যা কচ্ছপের গতিতে আগ্যেইয়া যাইতাছে ভাইসাব।‘
এভাবেই কিছু কনটেন্টের শুরুতেই ভাইসাবের স্লোগানটি তুলে ধরেন সামিউল। এলাকার মানুষেরও তাকে নিয়ে যেন মাতামাতির শেষ নেই। তৃণমূল মানুষের ভাষায় কথা বলে, তাদের মতোই চলনে, বলনে, কখনও আবার গানের সুরে একেকটি বিষয় তুলে ধরে রং ছড়িয়ে যাচ্ছেন ঘরের ছেলে সামিউল। এতে তাদেরই মনের ভাব, কষ্ট, আশার কথা ফুটে ওঠায় ‘ভাইসাব’ পেজে এখন ৫ লাখ ৯৭ হাজার ফলোয়ার।
একেকটি বিষয় তুলে ধরার পর দুই থেকে চার লাখ ভিউ মামুলি ব্যাপার। কিছু কিছু বিষয়ে এক থেকে আট মিলিয়ন ভিউয়ার তা দেখছেন। হাজারো শেয়ার, লাইক কমেন্টে সমর্থন জানাচ্ছেন ফলোয়াররা।
এতে করে এরই মাঝে পেয়েছেন তারকা খ্যাতি। সামিউলের কাজে সমর্থন জুগিয়ে আপলোড করা বিভিন্ন কনটেন্টে কমেন্ট করছেন অনেকে। তাকে সাধুবাদ জানাচ্ছেন।
এ রকমই পর্যটন নিয়ে দেয়া ভিডিও কনটেন্টে নিজের আইডি থেকে আরেফিন নিশাদ কমেন্টে লিখেছেন, ‘একদম সঠিক কথা তুলে ধরার জন্যে ধন্যবাদ।’ ইয়াসির আরাফাত নামে একজন লিখেছেন, ‘ভাইসাব কথাডি একদম হাছা (সত্য কথা)।’
মো. লুৎফর রহমান লেখেন, ‘অপ্রিয় সত্যটি তুলে ধরেছেন। একদম বাস্তব চিত্র। ধন্যবাদ আপনাকে ভাইসাব।‘
সামিউলের ব্যতিক্রমী এই উদ্যোগ নিয়ে কেন্দুয়া প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক লিয়াকত আলী চৌধুরী কাজল বলেন, ‘কেন্দুয়ার এই তরুণ জেলার নানা বিষয় নিয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে চলেছেন। এটা কিন্তু যেমন ব্যতিক্রম, তেমনি ভালো কাজ। মানুষের মনের কথা উঠে আসছে গণমানুষের কথ্য ভাষায়। আমি তার কাজের প্রশংসা করছি। তা ছাড়া তার তুলে ধরা এলাকার সমস্যাগুলোর সমাধানে প্রশাসন আন্তরিক হবে বলে আশা করছি।’
কেন্দুয়া উপজেলার বাসিন্দা আমিরুল ইসলাম তালুকদার বলেন, ‘আমাদের মতো করে মজা করতে করতে আমাদেরই কথা তুলে ধরছেন। অনেক কঠিন কথা সহজেই বলছেন। তার কথাবার্তা গ্রামের অশিক্ষিত, শিক্ষিত, ছেলে, বুড়ো, নারী সব বয়সের সব ধরনের মানুষই সহজেই বুঝতে পারছেন। তার সচেতনতামূলক ভিডিওগুলো এলাকার সামাজিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে সক্ষম হচ্ছে।‘
নেত্রকোণা শহরের মোক্তারপাড়ার বাসিন্দা সুস্থির সরকার বলেন, ‘গণমাধ্যমের আদলে এলাকার নিজেদের ভাষায় নিজেদের কষ্ট, ভালো লাগার নানা দিক উঠে আসছে সামিউলের মাধ্যমে। লাখ লাখ মানুষ তাকে অনুসরণ করছে।’
‘তার কাজ সুন্দর। তার জন্যে শুভ কামনা রইল’- বলেন পেশায় শিক্ষক সুস্থির সরকার।
ভাইসাব সামিউলের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তার বক্তব্য পায়নি নিউজবাংলা। তিনি বিনয়ের সঙ্গে পরে কোনো একসময় নিজের কথাগুলো গণমাধ্যমের সামনে তুলে ধরবেন বলে জানিয়েছেন।