ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামানের সমালোচনা করা যাবে না মর্মে সাবধান করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিজ্ঞপ্তির পর এ নিয়ে সমালোচনার ঝড় উঠেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
একটি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত কার্টুন থেকে যে নিষেধাজ্ঞার সূত্রপাত, সেই নিষেধাজ্ঞাই হাস্যরসাত্মক ট্রোল ও মিমের নতুন উপলক্ষ হয়ে উঠেছে। এসব ট্রোলের বেশিরভাগই করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থীরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র ও ব্র্যাক মাইগ্রেশন বিভাগের প্রধান শরিফুল হাসান তার ফেসবুক টাইমলাইনে লেখেন:
‘এই তো আর সপ্তাহ দুয়েক পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষপূর্তি। এমন মহেন্দ্রক্ষণে আরো একটি রেকর্ড করেছে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়। শত বছরের ইতিহাসে এই প্রথম বোধ হয় কোনো উপাচার্য সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাঠালেন যে, সমালোচনা বা ব্যঙ্গ করলে তিনি আইনি ব্যবস্থা নেবেন।সংবাদ বিজ্ঞপ্তিটি পড়ে আমার ভীষণ হাসি পেয়েছে। …পৃথিবীর ইতিহাসে আর কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে এমন সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিতে হয়েছে কি না আমার জানা নেই। আমার তো মনে হয়, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করার জন্য এই সংবাদ বিজ্ঞপ্তিই যথেষ্ট। খুব দক্ষতার সাথে কাজটি করায় শতবর্ষের অভিনন্দন মাননীয় উপাচার্যকে। আমার মনে হয় সবাই এবার ছা-ছপ সিঙ্গারা খাওয়ার দাওয়াত পেতে পারেন।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র ও কবি ইমতিয়াজ মাহমুদ তার ফেসবুক টাইমলাইনে একটি গল্পের ছলে সমালোচনা করে বলেন:
‘স্কুলে আমাদের এক বন্ধু ছিলো। তার নাম মারুফ (নামটা কাল্পনিক দিলাম)। কিন্তু ক্লাসের সবাই তারে ডাকতো "বলদা মারুফ" নামে।
এই সম্বোধনে ত্যাক্ত-বিরক্ত হয়ে একদিন সে আমাদের ক্লাস টিচারের কাছে গিয়ে সবার নামে নালিশ করলো। স্যার তখন আমাদের বললেন, তোরা কেউ এখন থেকে আর ওরে 'বলদা মারুফ' ডাকবি না, এখন থেকে ওরে সবাই 'ইন্টেলিজেন্ট মারুফ'' ডাকবি।
অচিরেই সবাই তারে নতুন এই নামেই ডাকা শুরু করলো। তারপর ধীরে ধীরে এক সময়ে তার নামের মূল অংশটাও বাদ পড়লো। শুধু ইন্টেলিজেন্ট নামটা টিকে থাকলো।
কিন্ত সুন্দর এই নামটা উচ্চারণ করার সময় সবার মুখেই মুচকি একটা হাসি থাকতো...।
পুনশ্চ: খবরে দেখলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিছে তাদের চা, চপ, সিঙারারে ব্যাঙ্গ করলে তারা ব্যবস্থা নেবে। আমার ধারণা তাদের এই ব্যবস্থার ভয়ে এখন থেকে কেউ আর তাদের চা, চপ, সিঙারারে বিদ্রুপ করবে না।
তবে আশঙ্কা আছে কর্তৃপক্ষ এমন ব্যবস্থা নিতে থাকলে একসময় "ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়" নামটা উচ্চারণ করার সময়ও সবার মুখে মুচকি একটা হাসি থাকবে...।’
দৈনিক দেশ রূপান্তর-এর যুগ্ম সম্পাদক গাজী নাসিরুদ্দিন আহমেদ তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন:
‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি এত ব্যাডাগিরি দেখায় কেন? এক্স স্টুডেন্টদের গ্রুপ দেখলেই তো বোঝা যায় কি জাতের গ্র্যাজুয়েট উনারা পয়দা করেন। আইনি পদক্ষেপের হুমকি দেন! ছা-ছপ বললে বাংলাদেশের কোন আইনটার লঙ্ঘন হয়? হাইকোর্ট দেখানোর গেরাইম্যা কালচার। রাবিশ!’
অনেকে স্ট্যাটাস না দিলেও বিভিন্ন ব্যাক্তিদের কমেন্ট বক্সে এমন সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছেন।
শরিফুল হাসানের পোস্টে কমেন্ট করেছেন রওশন হক। তিনি লিখেছেন: ‘ছা চপ সিংড়ায় সম্মান ধরে রাখতেই এই সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়েছেন।’
শাহাদাত হাসান নামে একজন কমেন্টে বলেছেন: “ঢাবির না, বরং তার নিজের ভাবমূর্তি 'রক্ষা'র বিজ্ঞপ্তি ছিল সেটি।”
মো হারুন উর রশিদ কমেন্টে লিখেছেন: ‘মাননীয় উপাচার্য কি তাকে নিয়ে কৃত ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ দেখেও বুঝেন না যে তিনি বিগত কবছর ধরে কেমন কর্মদক্ষতা দেখিয়ে যাচ্ছেন! যদি না বুঝে থাকেন, তাহলে বিশ্বাস করুন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রাক্তন ছাত্র হিসেবে আমি সত্যিই লজ্জিত!’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রী ও সাংবাদিক শাহানা হুদা তার ওয়ালে লেখেন: “‘সম্মানিত’ কাউর ইজ্জত লই ‘চুদুর বুদুর’ চইলতোনো - প্রেস বিজ্ঞপ্তি।”
সমালোচনা শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক বা বর্তমান শিক্ষার্থীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। বরং তা ছড়িয়ে পড়েছে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যেও।
স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজের সাবেক শিক্ষার্থী সেজান মাহমুদ এই বিষয় নিয়ে একটি কবিতা লিখে তা তার ওয়ালে প্রকাশ করেন,
#খবর_থেকে_ছড়া ১১
বললেন কী বললেন কী
চা-ছপের এই ভিসি!
ছি ছি!
কেউ করিলে মানের হানি
টানতে হবে জেলের ঘানি
মান কি অতো সোজা?
পাবলিকে দেয় ট্যাক্সো-মানি
সঙ্গে কিছু খোঁচাও, জানি
যায় না বুঝি বোঝা?
তাই বলে কি মামলার ভয়,
রক্তচক্ষু ভালো?
প্রাচ্যের এই অক্সফোর্ডে আজ
‘ইনটলারেন্স’ কালো!
ছি ছি ছি ছি!
বললেন কী বললেন কী
চা-ছপের এই ভিসি!
ক্ষ্যামা দিলাম লিখতে ছড়া
একশ ঘায়ের ভয়ে
ফ্রিডম-ট্রিডম শিকেয় তুলি
সস্তা ছপের জয়ে!
ইংরেজি দৈনিক পত্রিকা দ্য ডেইলি স্টার-এ ১৫ জুন প্রকাশিত এক প্রতিবেদন ও কার্টুনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসু ক্যাফেটরিয়াতে স্বল্প মূল্যে পাওয়া চা, চপ, শিঙাড়া নিয়ে ২০১৯ সালে নবীন শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে উপাচার্যের দেয়া বক্তব্যের সমালোচনা করা হয়।
এর প্রতিবাদে জনসংযোগ দপ্তর থেকে পাঠানো বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘সেদিনের বক্তব্যকে খণ্ডিতভাবে প্রচার করা হয়েছে। যমুনা টেলিভিশনের এক সাংবাদিক উপাচার্যের বক্তব্যের মূল অংশ কাটছাঁট করে ক্যাফেটরিয়ার বিভিন্ন খাবার আইটেমের মূল্যমান-সংক্রান্ত বক্তব্যের অংশবিশেষ নিয়ে ১৫-২০ সেকেন্ডের একটি ভিডিও তৈরি করে। যা ভাইরাল হয়ে যায়।
‘সেদিন উপাচার্য মূলত নবাগত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে হাস্যরসে ক্যাফেটরিয়ার সাধারণ, স্বল্পমূল্যের খাবার মেন্যু ও সবার জন্য সমান সুযোগ-সুবিধার অবারিত সেবা কার্যক্রমের কথা বলেছিলেন।’
এ বিষয়ে বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, ‘সম্প্রতি কোনো কোনো দায়িত্বশীল মহল বিভিন্নভাবে বিষয়টি যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করছে, যা খুবই অনাকাঙ্ক্ষিত।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর ব্লগার আরিফ জেবতিক তার স্ট্যাটাসে ছড়ার মতো করে লিখেছেন:
‘ভানুমতীর খেল! ছা-ছপ-ছিঙারা কইলে হবে জেল!’
ছড়াকার রোমেন রায়হান তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে ছড়া লিখেছেন:
‘ভিসিত্র অক্সফোর্ড
রোমেন রায়হান
অক্সফোর্ড আছে যেটা প্রাচ্যে
‘ছা-ছপ-সিঙ্গারা’ খাচ্ছে
সেটা নিয়ে বলো যদি কিচ্ছু
পিছু নেবে ‘ভিসিত্র’ বিচ্ছু
জেলে ভরে দেখা যাবে নাচছে!
অক্সফোর্ড আছে যেটা প্রাচ্যে…’
রোমেন রায়হানের এই ছড়ার পোস্টের নিচে নাফিস রহমান লিখেছেন: ‘আইনী ব্যবস্থা নেয়া হবে কি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, নাকি খাদ্য নিরাপত্তা আইনের আওতায়?’
জনপ্রিয় অনলাইন ফান পেজ ‘ইয়ার্কি ডট কম’ একটি পোস্টে লিখেছে:
‘যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শেখানোর কথা মুক্ত মত আর মুক্তচিন্তার চর্চা, সেখানে তারাই মানুষের কণ্ঠরোধ করতে চাইছে। কেউ সমালোচনার উর্ধ্বে নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ মানুষের সেই বিচারশক্তি ও উপলব্ধি জাগ্রত করা। আর আমাদের প্রাচ্যের অক্সফোর্ড শিক্ষার্থীর স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকারের কবর খুড়ছে। হ্যাঁ, এটাই দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ, সুলভে ছা-ছপ-সিঙ্গারার প্রাপ্তিস্থান।’